Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: একাদশ পর্ব, কলকাতা থেকে পারমাদন ফরেস্ট ১১০ কিলোমিটারের রাস্তা
Bibhutibhushan Wildlife Sanctuary: পারমাদন যাওয়ার তিনটি রাস্তা আছে, তার মধ্যে দীর্ঘতম রাস্তাটি হল ডানকুনি-চুঁচুড়া-কল্যাণী তারপর হরিণঘাটা হয়ে পারমাদন। আর অন্যটি হল রাজারহাট-মধ্যমগ্রাম-বারাসত পৌঁছে সোজা হরিণঘাটা হয়ে পারমাদন।

কলকাতা থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার দূরে গ্রামবাংলার মধ্যে অবস্থিত একটি ছোট্ট জায়গা, যেখানে আপনি সময় কাটাতে পারবেন অভয়ারণ্যের মধ্যে থাকা হরিণ এবং নানা ধরনের পশু-পাখির সঙ্গে। এছাড়াও আপনি এখানে ইছামতি নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ দিয়ে নৌকায় ভ্রমণ করতে পারবেন। সঙ্গে রয়েছে সেই ঐতিহাসিক নীলকুঠি, যা নীল বিদ্রোহের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চারিপাশে জঙ্গলের মাঝে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই ভৌতিক ভগ্নপ্রায় নীলকুঠি, যার আশপাশে কোনও রিসোর্ট বা টেন্টিং ক্যাম্পে থাকলে রাতে তার চিৎকারের আওয়াজ শোনা যায়। এছাড়াও শোনা যায় রাতের নিশাচর প্রাণীর ডাক। তার সঙ্গে ঝিঁঝিপোকা তো আছেই। এক কথায় এই গ্রামে একরাত না কাটালে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছুই বোঝা যায় না।
আমি এই জায়গায় সর্বপ্রথম ১২ বছর আগে গিয়েছিলাম। আর কিছুদিন আগে, মানে বর্ষাকালে যাওয়ায়, পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম অনেকটাই। বারো বছর আগের এই গ্রামটিতে এখনকার মতো হোটেল বা রিসোর্ট ছিল না, পাকা বাড়িও ছিল না। তবে এই নীলকুঠি, ইছামতি নদী আর অভয়ারণ্য আজও সেই একই রকমই আছে, শুধু হারিয়েছে কিছু বড়-বড় গাছপালা। সময়ের পরিবর্তনে দিন-দিন গ্রাম পাহাড় পর্বত নদী-নালা এবং রাস্তাঘাটের আমূল পরিবর্তন হচ্ছে। ঠিক যেমন বাইক নিয়ে ২০১৮ সালে লাদাখ যাওয়া আর ২০২২ সালে লাদাখ যাওয়ার মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। জানি পরিবর্তন দরকার। কিন্তু এই পরিবর্তনে কোথায় যেন অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে, নিজের মনকে প্রশ্ন করলে তা খুঁজে পাওয়া যায় একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষের মধ্যে। তাই সময় নষ্ট না করে একটু সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন প্রকৃতির কাছে, তা না হলে সে-ও একদিন হারিয়ে যাবে এই পরিবর্তনের জেরে।
তাই আর দেরি না করে চলুন বেরিয়ে পড়ি পারমাদনের উদ্দেশ্যে। পারমাদন যাওয়ার তিনটি রাস্তা আছে, তার মধ্যে দীর্ঘতম রাস্তাটি হল ডানকুনি-চুঁচুড়া-কল্যাণী তারপর হরিণঘাটা হয়ে পারমাদন। আর অন্যটি হল রাজারহাট-মধ্যমগ্রাম-বারাসত পৌঁছে সোজা হরিণঘাটা হয়ে পারমাদন। আর তিন নম্বর রাস্তাটি, যেটা দিয়ে আমরা ফিরব দমদম-বারাসত-হাবড়া বনগাঁ হয়ে পারমাদন। শনিবার সকাল সকালে কলকাতা থেকে বেরনোর ফলে আমি দু’নম্বর রাস্তাটাই ব্যবহার করলাম। কারণ এটি ছোট এবং রাস্তাটাও বেশ ভাল।
কলকাতা থেকে পারমাদন ফরেস্ট অঞ্চল ১১০ কিলোমিটারের রাস্তা। তা-ও এই রাস্তা অতিক্রম করতে বাইকে মোটামুটি সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যাবে, তাই আর দেরি না করে বাইক নিয়ে সোজা দমদম-মধ্যমগ্রাম-বারাসাত হয়ে হরিণঘাটা থেকে সোজা চাকদহ চৌরাস্তা থেকে আমরা ডান দিক নিলাম। এখানে রাস্তা বেশ ভাল, তবে মাঝেমধ্যে রাস্তার কাজ হচ্ছে আর চাকদহ চৌরাস্তার মোড়ে ওভারব্রিজের কাজ হওয়ার কারণে একটু সময় আপনাকে খরচ করতেই হবে। যাওয়ার পথে চাকদহ রাজবাড়িটা ঘুরে আসবেন। শুনেছি এটি একটি পরিতক্ত ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ি। দু’বারই যাওয়ার পথে আমি মিস করে গিয়েছি এই জায়গাটা। তারপর আইসমালি-চাকদহ রাস্তা দিয়ে সোজা চলে এসে ইছামতি নদী পেরিয়ে করে আপনি উঠবেন দুত্তাফুলিয়া হেলেঞ্চা রাস্তায়, তারপর ঠিক ৫০০ মিটার পরেই প্রথম ডান দিক নিয়ে পৌঁছে যান বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যে।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর
বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্য (আগের নাম পারমাদন অভয়ারণ্য) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁ মহকুমায় অবস্থিত এটি। অভয়ারণ্যটি বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত। এখানে নির্দিষ্ট পার্কিং স্পটে আপনার বাইক রেখে মাথাপিছু ১২০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চলে আসুন এই অভয়ারণ্যের মধ্যে যেখানে রয়েছে প্রচুর চিত্রা হরিণ। এই অভয়ারণ্যটি তৈরির শুরুতে আলিপুর চিড়িয়াখানা থেকে চারটি হরিণকে আনা হয়। তারপর তারা বংশবিস্তার করে ধীরে-ধীরে তাদের সংখ্যা বেড়ে হয় ২০১। এরপর ২০০০ সালের বন্যায় অসংখ্য হরিণের মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও এই অভয়ারণ্যে আরও কিছু দর্শনীয় স্থান আছে, তাদের মধ্যে অভয়ারণ্যের মাঝে রয়েছে একটি বিশাল বড় ওয়াচ টাওয়ার। যেখানে আপনি ক্যামেরার বড় লেন্স সেট করে বসে থাকতে পারেন। এই অভয়ারণ্যের পাশ দিয়ে বইছে ইছামতি নদী। আর নদীটির ঠিক ও পারেই রয়েছে মঙ্গলগঞ্জ। আর এই মঙ্গলগঞ্জেই রয়েছে নীল চাষীদের ওপর ব্রিটিশদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের চিহ্ন ধারণ করে-রাখা একটি ভৌতিক ধ্বংসপ্রায় নীলকুঠি। ভৌতিক বলার কারণ এখানে গ্রামবাসীরা রাতের অন্ধকারে নানা ধরনের আওয়াজ—কেউ যেন ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, আবার কখনও-কখনও এই ইছামতি নদীতে নানা ধরনের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।
এই বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যে আরও দেখতে পাবেন সুন্দর-সুন্দর গাছ, তাতে ফুটে রয়েছে নানা ধরনের ফুল। এছাড়াও খাঁচার মধ্যে আপনি অনেক ধরনের পাখি দেখতে পাবেন, আর এই বিশাল অভয়ারণ্যে দেখতে পাবেন নানা ধরনের পাখি, প্রজাপতি, সাদা ময়ূর আরও অনেক কিছু। এই অভয়ারণ্যটি ৬৪ হেক্টর জমি জুড়ে অবস্থিত। বিশাল-বিশাল গাছের সারির পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি নদীর উপরে তার ছায়া সত্যিই অসাধারণ, আর এক কথায় ছবি বা ভিডিয়ো করার জন্য আদর্শ স্পট। এই বিশাল বড় জায়গা ঘুরে দেখতে আপনার অনেকটা সময় চলে যাবে।
এরপর বাইক নিয়ে চলে আসুন মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে বিভূতিভূষণ অভয়ারণ্যের ঠিক উল্টোদিকে মঙ্গলগঞ্জ নীলকুঠিতে। যদিও নীলকুঠিটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে বহু অত্যাচারের সাক্ষ্য বহন করে আছে। এখানে আরও দেখতে পাবেন নীলকর সাহেবদের পালাবার জন্য তৈরি গুপ্ত সুড়ঙ্গ, যা নদীতে গিয়ে মিশেছে। আমি নীলকুঠিটি ভাল করে ঘুরে, ছবি তুলে রাতে যেহেতু আবার আসব, তাই বেশিক্ষণ সময় না দিয়ে খুঁজে নিলাম আজকের রাত্রি নিবাস বা থাকার জন্য কটেজ অথবা রিসর্ট। এই নীলকুঠিকে ঘিরে অনেক ধরনের পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। আমি যখন ২০১০ সালে এসেছিলাম, তখন এসব কিছুই ছিল না। এছাড়াও থাকার জন্য টেন্টের ব্যবস্থা আছে। কটেজের ভাড়া ১৪০০ টাকা এবং তিনজনের থাকার জন্য ১৩০০ টাকা মাথাপিছু। তাতে আছে চার বেলা খাবারও। তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আজকের মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম আশেপাশের গ্রাম সফরে।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর
দু’পাশে বড় বড় গাছপালা ঝোপঝাড়, তার মধ্য দিয়ে মাটির রাস্তা। রাস্তার এক প্রান্ত চলে গিয়েছে মঙ্গলগঞ্জ গ্রামে এবং অন্য প্রান্ত নদীর ধারে। আপনি ৫০ টাকার বিনিময়ে এখানে প্রায় এক ঘণ্টার মতো নৌকায় ভ্রমণ করতে পারবেন এই প্রকৃতির মাঝে। নদীর একপাশে নীলকুঠি এবং অন্য প্রান্তে পারমাদান অভয়ারণ্য, আর তারই দু’পাশে ঘন অরণ্য। নৌকা চড়ার সময় অনেক সুন্দর-সুন্দর ছবি তুললাম। নদীর ওপর এই ঘন জঙ্গলের প্রতিচ্ছবি খুবই সুন্দর।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর
ঠিক সন্ধের মুখে ফিরে আসলাম কটেজে। সঙ্গে-সঙ্গে পেয়ে গেলাম পকোড়া, মুড়ি এবং চা। তারপর আর কী… খোলা আকাশের নিচে তারা গুনতে-গুনতে গান শোনা আর চারপাশের প্রকৃতির মাঝখানে হারিয়ে যাওয়া। মাঝে আবার খানিকটা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে প্রকৃতি আরেকটু জীবন্ত হয়ে উঠেছে। শোনা যাচ্ছে আরও বেশি করে ঝিঁঝি পোকার শব্দ আর ব্যাঙের ডাক। আর রাতের হাজারো তারার সঙ্গে ওই জঙ্গলের জোনাকির আলো। তবে ভৌতিক কিছু লক্ষ্য করিনি এখানে। গ্রামবাসীদের মুখে নানা ধরনের ভৌতিক ঘটনা শোনা যায়। সে সবই শুনতে-শুনতে এবার চলে এল—ঠিক রাত দশটার সময়—রাতের খাবার। আরেকটু অন্ধকারের মধ্যে সময় কাটিয়ে প্রায় ১১র নাগাদ ঘুমোতে গেলাম।

ছবি: সঞ্জীব নস্কর
সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে সকাল দশটার সময় বেরিয়ে পড়লাম পেট্রোপোলের উদ্দেশ্যে, যেটি ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বনগাঁ হয়ে সোজা বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত যায়। বাংলাদেশ বর্ডার এই কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম বনগাঁ-হাবড়া-বারাসত হয়ে কলকাতা। তা-ও মোটামুটি ৯৫ কিলোমিটারের রাস্তা অতিক্রম করতে আপনার তিন ঘণ্টা সময় লেগেই যাবে।।
