মহালয়া আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালির কাছে প্রায় সমার্থক শব্দ। এই একটা দিনই হয়তো ভোর চারটের সময় সবচেয়ে বেশি বাঙালি ঘুম থেকে ওঠেন। তথ্য বলছে, গোটা দুনিয়ায় এক বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনাল ছাড়া মহিষাসুরমর্দিনীর ধারেকাছে আরও কেউ নেই। না অলিম্পিকও নেই মহিষাসুরমর্দিনীর ধারেকাছে।
১৯৩২ সালে আকাশবাণীতে মহালয়ার সকালে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান শুরু হল। সেই সময় কী ভেবেছিলেন আকাশবাণীর তত্কালীন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার? তিনি ভেবেছিলেন, একটা নতুন কিছু শুরু হচ্ছে। মানুষের পছন্দ হলে ভাল, না হলে মহিষাসুরমর্দিনী বন্ধ হয়ে যাবে। চাকরি থেকে রিটায়ার করার ১৬ বছর পর, ১৯৫৬ সালে নৃপেন্দ্রনাথ লিখছেন, মহিষাসুরমর্দিনী মহাভারতের কর্ণের মতো। যাঁরা মহাভারত পড়েন, তাঁরা বাকিদের ভুলে গেলেও কর্ণকে ভুলতে পারেন না। তেমনই আকাশবাণী কোনওদিন হারিয়ে গেলেও মহিষাসুরমর্দিনী বাঙালির মনে থেকে যাবে চিরকাল।
এই বিষয়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহালয়ার সকালে এমন কোনও অনুষ্ঠান তৈরি যে হবে, এমন কোনও ভাবনাই অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো কর্তৃপক্ষের ছিল না। আকাশবাণীর আড্ডায় এসে এই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন মহাস্থবীর জাতকের লেখক, সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। প্রেমাঙ্কুর বললেন, মহালয়ার দিন দুর্গাপুজোর শ্লোক আর স্তোত্রকে গানের আকার দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! উপস্থিত সবাই সায় দিলেন। সেই প্রস্তাব পাশও হয়ে গেল। জানা যায়, মাত্র তিন সপ্তাহে ২০ থেকে ২২টা গান লিখে ফেলেন বাণীকুমার। বাণীকুমার অর্থাত্ বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের হাতেই সেই অর্থেই মহিষাসুরমর্দিনীর ভিত তৈরি শুরু। লেখালিখির পর তাতে সুর দেওয়া। হরিশচন্দ্র বালী, রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক সুর দেন বেশিরভাগ গানেই। একটি গানে সুর দেন সাগীর খাঁ। এরপর এল চণ্ডীপাঠ। সেজন্য সেরা মানুষ হাতের কাছেই ছিলেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ব্রাহ্মণ ছিলেন না। ফলে তিনি চণ্ডীপাঠ করলে গোঁড়া ব্রাহ্মণরা আপত্তি করতে পারেন, তেমন একটা আশঙ্কা ছিলই। তবে নৃপেন্দ্রনাথ সেসবে আমল দেননি। সাফ বলে দেন, স্তোত্রপাঠের আবার বামুন, কায়েত কী? কেউ বলতে এলে বলে দেব, আপনি নিজে বীরেনের মতো করে দেখান দেখি। সেই সময় রেকর্ডিংয়ের জন্য আগে থেকে কোনও স্ট্রাকচার ঠিক ছিল না। আবার বাদ্যযন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উর্দুভাষী। তারা নোটেশন ফলো না করে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজাচ্ছিলেন। ঠিক হয়েছিল, তাতে ভাল হলে ভাল। না হলে ফের নোটেশন মতো বাজিয়ে রেকর্ডিং হবে। কিন্তু প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে রেকর্ডিংয়ের পর বোঝা যায়, সবটাই নিখুঁত হয়েছে। নৃপেন্দ্রনাথ পরে বলেন, আমি সবাইকে বলছিলাম, মা দুর্গা আমাদের দিয়ে কাজটা করিয়ে নিলেন। বাকিটাও মায়ের হাতেই ছেড়ে দাও। অনেকেই হয়ত জানেন, প্রথম দু’বছর ষষ্ঠীর দিন ভোরে সম্প্রচারিত হয়েছিল মহিষাসুরমর্দিনী। দু’বছরের পর মহালয়ার ভোর থেকে সম্প্রচার শুরু হয়। দেবীপক্ষের আগে মহিষাসুরমর্দিনীর সম্প্রচার শাস্ত্রসম্মত কি না, তা নিয়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল। এই নিয়ে বাগবাজারে এক বিতর্কসভায় দু-পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছিল। আর বীরেন্দ্রবাবুর জায়গায় উত্তমকুমারকে দিয়ে অনুষ্ঠান করানোর ঘটনা, সে তো সব বাঙালিরই জানা।
যা জানা যায়, আকাশবাণীর হাতে মহিষাসুরমর্দিনীর ৮ থেকে ১০টি রেকর্ডিং আছে। প্রতি বছর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন রেকর্ডিং বাজানো হয়। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের রেকর্ডিংটাই সবচেয়ে বেশিবার বাজানো হয়েছে। ১৯৬৬-র রেকর্ডিংটাও বাঙালিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। তবে ২০২২ সালের পুজোয় বাজানো হয়েছিল ১৯৬২ সালের রেকর্ডিং। অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে বীরেনবাবুর উদাত্ত চণ্ডীপাঠ। তবে আমাদের খুব চেনা কয়েকটা গান সেখানে নেই। আর সেই কারণেই বোধহয় গতবছর, ২০২৩ সালে চেনা ছকে ফিরেছিল আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। তবে এবার কী হয়, সেটাই দেখার।