
কথায় বলে জহুরি জহর চেনে… রিচা ঘোষের (Richa Ghosh) ক্ষেত্রে এই কথাটাই যেন এক্কেবারে ফিট। সঙ্গে রাখতে হয়, যাঁকে তিনি ঝুলন গোস্বামী (Jhulan Goswami)। চাকদা এক্সপ্রেস বলে জনপ্রিয় ঝুলন। তাঁরই খোঁজ রিচা। যে মেয়ে আজ বিশ্বজয় করে বাংলার স্বপ্নপূরণ করেছে। ঝুলনের কেরিয়ার যখন মধ্যগগনে, সেই সময় তিনি বাংলার নানা প্রান্ত থেকে ক্রিকেটে প্রতিভাবান মেয়েদের খোঁজার দায়িত্ব নেন। সেই সময় খুঁজে বের করেন তিনি রিচার মতো প্রতিভাকে। আর আজ সেই রিচা ২২ বছর বয়সে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে গিয়েছেন। ইডেন গার্ডেন্সে রিচাকে সংবর্ধনা দিয়েছে সিএবি। সেই জমকালো অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেট টিমের প্রাক্তন দুই অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও ঝুলন গোস্বামী। সেই মঞ্চ থেকেই রিচাকে তুলে আনার গল্প শুনিয়েছেন ঝুলন।
রিচাকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে ভারতীয় কিংবদন্তি ঝুলন গোস্বামী বলেন, “মঞ্চে উপস্থিত মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের আইকন সৌরভ স্যার, আমাদের সোনার মেয়ে রিচা, ওর পরিবার, আমাদের কলকাতা কমিশনার অব পুলিশ, ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ স্যার ও সিএবির প্রত্যেককে সম্মান জানাই। ছোট্ট একটা স্টোরি বলতে চাই। আমার মনে হয় আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত। ২০১৩ সালে ভারতীয় দল ভাল করে খেলতে পারেনি। সেই সময় আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বাংলার ক্রিকেটের উন্নতিও হচ্ছিল না। সেই সময় সিএবির সেক্রেটারি বিশ্বরূপ দে, বাবলু স্যার, গৌতম স্যারকে আমি অনুরোধ করেছিলাম যে আমরা কি জেলায় ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম করতে পারি? সেই সময় তাঁরা সম্মতি প্রদান করেছিল। সেই সূত্রে প্রথম আমার রিচাকে দেখা।”
এই প্রসঙ্গে ঝুলন বলেন, “ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের হাত ধরে প্রথম শিলিগুড়িতে যাই অনূর্ধ্ব ১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৬-র ট্রায়ালের জন্য। সেখানে প্রথম একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখি। তারপর আমি কলকাতায় ফিরে জানাই, আমাদের কাছে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার রয়েছে। যাদের ভাল করে ট্রেনিং দিলে, ভারতীয় দলের হয়েও খেলতে পারবে। এরপর সেই ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের তুলে নিয়ে আসি আমরা। নানা জেলার ক্রিকেটাররা সেখানে আসে। আর সেখান থেকেই রিচার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ও খুব প্রতিভাবান, খুব শক্তিশালী একজন ক্রিকেটার, আমার দেখা অন্যতম প্রতিভাবান ক্রিকেটার ওই বয়সে।”
ভারতীয় কিংবদন্তি ঝুলন বলেন, “যখন ও প্রথম বাংলা টিমে নির্বাচিত হয়, সেই সময় সৌরভ স্যার প্রেসিডেন্ট। অভিষেক স্যার সেক্রেটারি ছিলেন। আমি একটা সময় বলেছিলাম সিনিয়র টিমে ওকে নিয়ে আসতে চাই। অনেকে আমাকে সমর্থন করেনি। অনেকে বলেছিল, ও অনেক ছোট এত তাড়াতাড়ি ওকে সিনিয়র টিমে আনার দরকার নেই। তবে সেই সময় অফিসিয়ালরা আমাকে সমর্থন করেছিল। তাঁরা বলেছিল, ওকে মনে হলে তুমি নিয়ে যাও। সুযোগ দাও। এরপরের সিরিজ থেকেই ইতিহাস। এরপর ভারতীয় দলে খেলে, টি-২০ বিশ্বকাপ খেলে। আমার দেখা বাংলার সেরা প্লেয়ার। এই বয়সে ও সবকটা ট্রফি জিতেছে। বাংলার হয়ে সেরা ক্রিকেটার ও। ওডিআই বিশ্বকাপ জিতেছে, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে, ডব্লিউপিএল কঠিন টুর্নামেন্ট সেখানে ও একা দলকে জিতিয়েছে।”
ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হয়েছে স্মৃতি-রিচাদের হাত ধরে। এই প্রসঙ্গে ঝুলন বলেন, “৫০ বছর ধরে, প্রায় ৪৭ বছর ধরে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট টিম যে স্বপ্ন দেখেছিল, সেটা পূরণ হল। আমার সামনে লোপাদি, মিঠুদি, গার্গীদি, রুনাদিরা রয়েছে। ওদের সময় থেকে মেয়েদের ক্রিকেট শুরু হয়েছিল, সেই সময় থেকে আমরা স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম, এখন যে টিমটা আছে রিচা, হরমন, দীপ্তি, স্মৃতি, জেমাইমা এরা সকলে মিলে আমাদের স্বপ্নটা পূরণ করেছে। ওদের সক্কলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর একটা কথা বলব, রিচা এই জার্নি এখান থেকে শুরু হল। অনেক প্রত্যাশা বাড়বে। সিএবি নিরন্তনভাবে মেয়েদের ক্রিকেটকে যেভাবে সাপোর্ট করে যাচ্ছে, সৌরভ স্যারের নেতৃত্বে সিএবি, বিসিসিআই মেয়েদের ক্রিকেটকে যেভাবে সমর্থন করে চলেছে তার ফল আজ ওরা পাচ্ছে। আশা করব এখান থেকে আরও একটা নতুন সফর শুরু হবে। তরুণদের ওরা অনুপ্রাণিত করবে, উৎসাহিত করবে, ভবিষ্যতে যেন আরও আমরা রিচার মতো সুপারস্টার প্লেয়ার পাই। এইরকম একটা মুহূর্ত মেয়েদের ক্রিকেটে ইতিহাস। অনেক অনেক কষ্ট করেছে ওর মা-বাবা, যে ত্যাগ স্বীকার ওরা করেছ, যার জন্য আর রিচা এই জায়গায় পৌঁছেছে, তাঁদেরকে (কাকু-কাকিমাকে) অনেক অনেক ধন্যবাদ।”