Mamata and Singur Movement: আজ পদ্মকে ‘না’, সেদিন নিজেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরুদ্ধ করে পায়ে জমি পেয়েছেন মমতা
Mamata Banerjee: সেই সময়েই বুদ্ধবাবুরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনঢ় ছিলেন। দিল্লির থেকে প্রবল চাপের মধ্যেও জানিয়েছিলেন, টাটার প্রকল্প বন্ধ করা হবে না।
সিঙ্গুর : ২০০৬ সাল। ডিসেম্বর মাস। আজ থেকে দেড় দশক আগে। কুয়াশা মাখা শহর তিলোত্তমায় তখন উত্তুরে হাওয়ার দাপট। আর কলকাতা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সিঙ্গুরে তখন দানা বাঁধছে এক বিদ্রোহ। তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক করে জ্বলছে অসন্তোষ। শিল্প বনাম কৃষির লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামেদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে এবং বঙ্গভূমে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে এই সিঙ্গুরকেই বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী। আর আজ ফের একবার চর্চায় সিঙ্গুর। আন্দোলনের মাটিতে এবার ধরনায় বিজেপি। সিঙ্গুরে টাটা প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির সামনে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের পাশে ধরনায় বসার পরিকল্পনা ছিল বিজেপির। কিন্তু সেখানে ধরনা মঞ্চ তৈরি করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ বিজেপির। অথচ, আজ থেকে পনেরো বছর আগে এই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ১৫ দিন ধরে অবরুদ্ধ ছিল। সৌজন্যে, তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর ধরনা।
সিঙ্গুরের মন বুঝতে দেরি করেননি মমতা
সেই বছর বিধানসভা ভোটে জেতার পর শপথগ্রহণের দিনেই সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই মতো শুরু হয়েছিল জমি অধিগ্রহণের কাজ। তাতে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি আধিকারিকরা কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। রুখে দাঁড়ান কৃষকরা। এক লাখি ন্যানোর জন্য বহুফসলি চাষের জমি অধিগ্রহণ তাঁরা মেনে নেননি। আর এই অনিচ্ছুক কৃষকদের মনের কথা বুঝতে দেরি করেননি মমতা। সোজা চলে যান সিঙ্গুরে। চোখের পলকে শান্ত সিঙ্গুর রূপ নেয় আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে। মমতার হাত ধরে শুরু হয় কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলন।
সিঙ্গুরে গিয়ে সোজা জাতীয় সড়কের ধারে বসে পড়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। মমতার সেই একটা সিদ্ধান্ত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেবের সরকারকে। চার-পাঁচদিন ধরে রাস্তায় শুধু সারিবদ্ধ ট্রাকের পর ট্রাক। বামফ্রন্টের বিকল্প উন্নততর বামফ্রন্টের দাবি করা একক রাজের সরকারকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল এই আন্দোলন।
ধর্মতলায় মমতার অনশন
এ এক জান কবুল লড়াই। প্রমাদ গুণলেন বুদ্ধবাবুরা। আন্দোলন বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। বুদ্ধবাবুর কথার উপর ভরসা করে যে রতন টাটা ন্যানো কারখানার কথা ঘোষণা করে দিয়েছেন। অতএব চলল উর্দিধারীদের লাঠি, কাঁদানে গ্যাসের শেল। বেধড়ক মার। সিঙ্গুরের বিডিও অফিস থেকে মমতাকে টানতে টানতে বের করে দেওয়া হল। সিঙ্গুরের এই দিনের ঘটনার অভিঘাত পৌঁছে গিয়েছিল দিল্লি পর্যন্ত। কেবল জাতীয় রাজনীতিই নয়, আন্তর্জাতিক আঙিনাতেও পরিচিতি পেল সিঙ্গুর। আর রাজনৈতিকভাবে মমতাকে আরও কিছুটা অক্সিজেন জোগাল।
সেদিনের ঘটনার পর কলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন মমতা। কিন্তু দমে যাননি। শহরে ফিরেই ফের ঝাঁঝ বাড়ালেন আন্দোলনের। অবস্থান বিক্ষোভে বসে পড়লেন মেয়ো রোডে। শুরু করলেন অনশন। শরীর ভাঙতে শুরু করে। টানা অভুক্ত থাকার জেরে রক্তচাপ অস্বাভাবিকরকম কমে যায়। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। দু’জনেই আলাদা আলাদা ভাবে মমতাকে অনশন প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন। মমতাকে সেই সময় চিঠি লিখেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও। লিখেছিলেন, কৃষকদের স্বার্থের জন্য মমতার জীবনটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে টানা ২৫ দিন অভুক্ত থাকার পর ২৬ তম দিনে অনশন প্রত্যাহার করেন মমতা। তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর এই লাগাতার অনশন এবং সিঙ্গুর আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বাংলায় বামেদের দূর্গকে একেবারে টলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়েই বুদ্ধবাবুরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনঢ় ছিলেন। দিল্লির থেকে প্রবল চাপের মধ্যেও জানিয়েছিলেন, টাটার প্রকল্প বন্ধ করা হবে না।
১৫ দিন ধরে অবরুদ্ধ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে
এরপর ২০০৭ সাল। বছরের শুরুর দিকেই টাটা গোষ্ঠী কারখানা তৈরির কাজ শুরু করে। হাইকোর্টের রায়ও ছিল বুদ্ধবাবু-রতন টাটাদের সঙ্গেই। সিঙ্গুর থেকে জমি অধিগ্রহণ করে রাজ্য সরকার কোনও ভুল করেনি বলে জানিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। রায়ে কিছুটা মুষড়ে পড়েছিলেন সিঙ্গুরের গ্রামবাসীরা। বহুফসলি জমি এভাবে নষ্ট হবে! আর ঠিক সেই সময়েই আবারও তাঁদের মনে নতুন করে লড়াইয়ের সাহস জোগালেন তাঁদের মমতা ‘দিদি’। আবার চলে গেলেন সিঙ্গুরে। ধরনায় বসে পড়লেন সানাপাড়ায়। টানা ১৫ দিনের ধরনা। অবরুদ্ধ হয়ে গেল দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। পিছু হটল টাটা। বাধ্য হল কাজ বন্ধ করে দিতে।
আজ সেই ঘটনার প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে এসে আবারও চর্চায় সিঙ্গুর। কৃষকদের বিভিন্ন দাবি দাওয়াকে সামনে রেখে তিনদিনের ধরনায় বসছে বঙ্গ বিজেপি। যে মাটিতে এককালে কৃষক আন্দোলনের বীজ পুতেছিলেন মমতা, আজ সেই মাটিতেই মমতার বিরুদ্ধে সুর চড়াচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তবে এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। এককালে সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় যে মাস্টারমশাইয়ের কাঁধে অনেকটা ভর করতেন মমতা, আজ সেই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যই বিজেপিতে। যদিও বয়সজনিত কারণেই হোক, বা অন্য কোনও কারণে, আজ বিজেপির ধরনা মঞ্চে দেখা যায়নি তাঁকে। সব মিলিয়ে ২০০৬ সালের সিঙ্গুর আর ২০২১ সালের সিঙ্গুরের মধ্যে অনেকটাই ফারাক। এখন দেখার বিজেপি এই সিঙ্গুর-ধরনাকে কাজে লাগিয়ে মমতা বিরোধী পালে হাওয়া লাগাতে পারে কি না।