AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Sumana Pramanik: নারী হতে চেয়েছিলেন, শুধু শরীর দিয়ে নয় জীবনের কঠিন অঙ্ক কষে আজ সুমন থেকে সুমনা

Sumana Pramanik: ছেলেদের অনাথ আশ্রম, স্বাভাবিক ভাবেই সেখানেও খুব একটা ভাল স্মৃতি নেই তাঁর। বন্ধুদের কাছ থেকে জুটেছে শুধুই টোন-টিটকিরি। তবু একটা বিষয়ে কখনও হাল ছাড়েননি সুমনা, সেটা হল পড়াশোনা।

Sumana Pramanik: নারী হতে চেয়েছিলেন, শুধু শরীর দিয়ে নয় জীবনের কঠিন অঙ্ক কষে আজ সুমন থেকে সুমনা
| Updated on: Feb 16, 2025 | 11:40 AM
Share

কৃষ্ণনগর: সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে, সেট বা স্টেট এলিজিবিটি টেস্ট(SET) পরীক্ষার ফলাফল। সেই পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে উর্ত্তীর্ণ হয়েছেন সুমনা প্রামাণিক। হঠাৎ করে কেন সুমনার কথা বলছি? কে সে? আরও অনেকেই তো সেট পাস করেছেন। আসলে সুমনার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বড় হতে হয়েছে তাঁকে। কারণ তাঁর লিঙ্গ পরিচয়। সুমনা একজন রূপান্তরকামী।

ছোট্ট ছেলে সুমন। আর পাঁচটা ছেলের মতোই বাড়িতে বড় হচ্ছিল। বাড়ির বড় ছেলে বলে কথা। কিন্তু জীবনটা বেশিদিন আর আনন্দের থাকল না। বাড়ির বড় ছেলের স্বভাব ছোটবেলা থেকেই একটু মেয়েলি। তাই অচিরেই বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির ভাত। ক্লাস ২ তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অনাথ আশ্রমে। ছেলেদের অনাথ আশ্রম, স্বাভাবিক ভাবেই সেখানেও খুব একটা ভাল স্মৃতি নেই তাঁর। বন্ধুদের কাছ থেকে জুটেছে শুধুই টোন-টিটকিরি। তবু একটা বিষয়ে কখনও হাল ছাড়েননি সুমনা, সেটা হল পড়াশোনা।

ছোটবেলা থেকেই তুখড় বুদ্ধি এবং মেধার অধিকারী সে। ক্লাসে বরাবরই র‍্যাঙ্ক করতো। মাধ্যমিকে ৮২ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেন সুমনা।

এর পরেই শুরু হল জীবনের আরেক অধ্যায়। মাধ্যমিক দিয়েই, করিমপুর ছেড়ে কৃষ্ণনগরে চলে আসেন সুমনা। প্রথমে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থাকলেও, সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। ক্লাস ১২ থেকেই নিজের ভাত নিজে জোগার করে নিতে শুরু করেন সুমনা। তারই সঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা। টিউশন পড়িয়ে সেই পয়সায় নিজের খাওয়া-থাকার খরচ থেকে শুরু করে লেখাপড়া করেছেন সবই। যদিও সুমনা জানান বলেন, “তাঁর কঠিন এই সময়ে পাশে পেয়েছেন কিছু ভাল মানুষকে।”

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হলেন কলেজে। ছোটবেলা থেকেই অঙ্ক করতে খুব ভালোবাসতেন সুমনা। তাই ঠিক করলেন অঙ্ককেই জীবনের পাথেয় করে এগিয়ে যাবেন। অঙ্কতেই স্নাতক হন তিনি।

এদিকে সেই সময় চলছে জীবনের চরম লড়াই। ছোটবেলা থেকেই নিজের মধ্যে যে মহিলা স্বত্বা ছিল, সে যে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা তা ক্লাস ৯ থাকতেই বুঝতে পেরেছিল সুমন। বাইরে থেকে পুরুষ হলেও তাঁর মন যে আসলে নারীর মতোই, তা বুঝতে পারেন সুমন। কলেজে উঠেই সিদ্ধান্ত নেন আর নয়, এবার বাস্তবেই সুমনা হয়ে উঠবেন তিনি।

তখনই জীবনে আরও একবার ধাক্কা খেতে হল সুমনাকে। যে শিক্ষিকা, কোনও টাকা ছাড়াই এতদিন টিউশন পড়াতো তাঁর কাছেও চরম অপমানিত হতে হল সুমনাকে। সুমনার নারী স্বত্বাকে সমাজের আরও অনেকের মতোই ‘মানসিক রোগ’ বলে দেগে দিলেন তিনিও।

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক নিয়ে স্নাতকত্তোর স্তরের পড়াশোনা শুরু করেন সুমনা। এমনকি ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে প্রথম অঙ্কে গোল্ড মেডেল পান সুমনা। সুমনা জানান, মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় সুপারিশ করেন সুমনার নাম।

সুমনা বলেন, “এই কঠিন সময়ে পরিবারকে পাশে না পেলেও অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিতা সিনহার মতো সমাজকর্মীরাও আমার পাশে দাড়িয়েছিলেন।”

স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ করার পর বিএড করেন সুমনা। ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয় সেট পরীক্ষা দেওয়া। দীর্ঘ ৫ বছরের প্রচেষ্টায় অবশেষে সম্প্রতি পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েছেন সুমনা। এরই সঙ্গে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে ‘ইনভাইটেড লেকচারার’ হিসাবে কলেজে পড়ান তিনি।

টিভি ৯ বাংলা ডিজিটালকে সুমনা বলেন, “আমার ইচ্ছে ডিফেরেনশিয়াল ইকুয়েশন নিয়ে পিএইচডি করার। এখন আমি সেই চেষ্টাই করছি।”

শুধু পড়াশোনাই নয়, এর সঙ্গে তাঁর হাতের কাজ দুর্দান্ত। মাটির মূর্তি বানাতে অত্যন্ত পটু তিনি। নিজের হাতেই তৈরি করেন দারুণ দারুণ মূর্তি। ট্রান্সজেন্ডার হিসাবেই একদিনের জন্য লোক আদালতের বিচারকের পদ পেয়েছিলেন সুমনা।

সুমনা বলেন, “আজ আমার সাফল্য দেখে অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, কিন্তু খারাপ সময় তারাই কেউ পাশে ছিলেন না। ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে খারাপ সময়ে চাইলেই আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করার পথ বেছে নিতে পারতাম, বা অন্য কোনও পথে চলে যেতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করে আজ এই জায়গায় এসেছি। আমার পথ মোটেও সহজ ছিল না। এটা সমাজের সেই সব মানুষদের গালে একটা চর, যারা বলেছিল নারী হতে চাওয়া আমার মানসিক রোগ।”

প্রেমের জীবনেও বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে সুমনাকে। বাহ্যিক সৌন্দর্য্য দেখে পুরুষরা হয়তো তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছেন বারবার, কিন্তু কেউই মন বোঝার চেষ্টা করেন না। খানিকটা আক্ষেপের সুরেই সুমনা বলেন, “জীবনে যতবার ভালোবাসা এসেছে, আমি ভুল মানুষকেই বেছে নিয়েছি।” এখন সেট পরীক্ষায় সাফল্যের পরে নিজের কেরিয়ার নিয়েই বেশি ব্যস্ত সুমনা। সুমনা বলেন, “ট্রান্সজেন্ডাররা যে শুধু ভিক্ষে করে না তা প্রমাণ করতেই আরও অনেকটা পথ হাঁটতে চাই। আমার মনে হয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের আর্থিক ভাবে প্রতিষ্ঠীত হওয়াটা ভীষণ জরুরি।”