‘মদভ্যাস’ পাল্টাতে আইনে ঐতিহাসিক বদল, হঠাৎ কেন ‘সাবালক’ হতে চায় বাংলাদেশ?
Bangladesh New Rules For Alcohol Consumption: বাংলাদেশে প্রথম ভাঁটি তৈরি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৭৭ সালে রবার্ট রাসেল কেরু নামের এক ব্রিটিশের হাত ধরেই তা তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালে ওই সংস্থার সরকারিকরণ ঘটায় গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার।
ঢাকা: ১০০ বছরের নিয়ম বদলে ফেলল বাংলাদেশ। মুসলিম প্রধান ‘পূর্ব বাংলা’য় এখন থেকে মদ্য পান ও বিপণন আরও ‘সহজ’ এবং ‘ঝুঁকিমুক্ত’। প্রাচীন সব নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে মদের বিপণনে ‘আধুনিক’ এবং ‘সাবলীল’ হল শেখ হাসিনার সরকার। সুরা-বাণিক মহল বলছে, শৈশব কাটিয়ে সাবালকত্বের পথে হাঁটতে শুরু করল বঙ্গবন্ধুর দেশ।
বলে রাখা ভাল, বাংলাদেশে মদ বহুলাংশে নিষিদ্ধ ছিল। মুসলিমরা মদ্যপান করতে চাইলে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখানোর প্রয়োজন ছিল। এখনও তাই। তবে হিন্দুদের উপর এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এখনও নেই। অমুসলিম একাধিক সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে ছাড়। বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রেও ছিল এই একই রকম ছাড়পত্র। পাসপোর্ট দেখালেই পাওয়া যেত পছন্দসই বিদেশি মদ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রথম ভাঁটি তৈরি করে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৭৭ সালে রবার্ট রাসেল কেরু নামের এক ব্রিটিশের হাত ধরেই তা তৈরি হয়। ১৯৭৩ সালে ওই সংস্থার সরকারিকরণ ঘটায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে যমুনা নামের গোষ্ঠীকেও মদ তৈরির ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সেই সংস্থা আসার পরই নিজের একচেটিয়া বাজার হারায় কেরু। ২০০৯ সালে নিজেদের তৈরি বিয়ার হান্টার নিয়ে এসে আরও খানিকটা বাজার দখল করতে সফল হয় যমুনা ডিস্টিলারি লিমিটেড।
নতুন আইনের উল্লেখ্যনীয় বিষয়গুলো কী কী?
১. ২১ বছর হলেই মদ্যপানে ছাড়।
২. মদের লাইসেন্স ও পারমিট পুনর্নবীকরণের ফি নির্ধারিত হবে প্রকারভেদ (অফ শপ, ক্লাব, বার, রেস্তোরাঁ) অনুযায়ী।
৩. একসঙ্গে ৩ ইউনিটের বেশি মদ বিক্রি করা যাবে না। একজন পারমিট হোল্ডারের একমাসে সর্বাধিক ছাড় ৭ ইউনিট পর্যন্তই। কেবল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই ছাড়ের পরিধি বাড়বে।
৪. কর্তৃপক্ষ এলাকা নির্দিষ্ট করে মদ বিক্রির অনুমতি দিতে পারবে।
৫. নতুন সুরা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০২২ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অনুমতিক্রমেই মদ বিক্রি, মদের বিপণন, বাজারিকরণ ও বিজ্ঞাপন করা যাবে।
৬. জলযান, আকাশপথ, রেল কিংবা সড়কপথে মদ নিয়ে যাতায়তের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ছাড়পত্র।
৭. বার বা ক্লাব ছাড়াও অফ শপে মদ বিক্রি করা যাবে, তবে প্রতিটি বোতলেই স্বাস্থ্য সতর্কীকরণের স্টিকার বাধ্যতামূলক।
৮. পাঁচতারা হোটেলগুলোকে সর্বাধিক ৭টি বার খোলার অনুমতি।
৯. রেস্তোরাঁ, হোটেল, বার ও ক্লাবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি মদ আমদানি করা যাবে। বাকি ৬০ শতাংশই রাখতে হবে দেশি মদ।
১০. মদের দোকান খোলা এবং বন্ধ করার নির্দিষ্ট সময় থাকবে। শুক্রবারে মদের বিকিকিনিতে নিষেধাজ্ঞা। দোকান খোলা যাবে না মহরম ও ঈদের দিনেও।
তথ্যসূত্র: দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস (The Financial Express)
এখন প্রশ্ন, হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন?
২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ১৪ কোটি ৯৩ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১.৯ শতাংশ মানুষের অ্যালকোহলের অভ্যাস ছিল। ৩.৬ শতাংশ পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সুরাপ্রেমী মাত্র ০.৩ শতাংশ। বয়সের হিসেব কষলে, বাংলাদেশে ২৫ থেকে ৪৪ বছরের (৭৬.৩ শতাংশ) যুবক, যুবতীরাই সুরাপ্রেমী। আরও সহজ করে বললে বাংলাদেশে মোট ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ কেবল মদের খদ্দের।
জেলার হিসেবে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, বড়িশালে মদের বিক্রি সর্বাধিক। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবথেকে কম মদ বিক্রি হয়।
বছরের হিসেবে বাংলাদেশ মাথা পিছু মদ প্রয়োজন হয় ০.০২ লিটার। ভারতে যা প্রতি বছরে ৫.৬ লিটার এবং চিনে ৬.০৪ লিটার। মুসলিম প্রধান হয়েও পাকিস্তানে বাংলাদেশের থেকে বেশি মদ বিক্রি হয়। সেখানে মাথাপিছু বছরে মদ প্রয়োজন হয় ০.৩১ লিটার।
উইওন (WION) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ আর্থিক বর্ষে শুধু মদ থেকে আয় করেছে ৬.৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। করোনার পরে লকডাউন পরবর্তী সময়ে সেই আয় বেড়ে হয় ১২.০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় ১০০০ কোটিরও বেশি।
২০২০ সালে জার্নাল অব ইকোনমিক্সের একটি গবেষণা মোতাবেক বাংলাদেশ তার ‘রক্ষণশীল’ মনোভাবের কারণে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাসিনা সরকার সেই ভ্রম সংশোধন করেই ‘উদারীকরণের’ পথে হাঁটল। সরকারের অনুমান, আইন সংস্কারের কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছরে কেবল মদ থেকেই রোজগার করবে ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিশেষজ্ঞদের মতে এই আইনি সংস্কারের হাত ধরেই বাংলাদেশে পরিবর্তন হবে সুরাভ্যাসের। আখেরে যার ফয়দা পাবে সরকার। একদিকে রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি, অন্যদিকে নির্দিষ্ট নিয়মের কারণে মদ নিয়ন্ত্রণেও সচেষ্ট থাকবে প্রশাসন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঢাকা ট্রিবউনকে (Dhaka Tribune) জানিয়েছে, “অতীতে মদের ব্যবহারের বিষয়ে আমাদের নির্দিষ্ট কোনও আইন ছিল না। এই নতুন আইন মদ সেবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উপযোগী ভূমিকা নেবে।” লিকার আইন সংস্কারে আশার আলো ব্যবসায়ী মহলেও। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মহম্মদ মোশারফ হোসেনের কথায়, “চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মদ সরবরাহ করার চেষ্টা করব। বিক্রি বাড়বে বলেই আমাদের আশা।”
Bangladesh News: শহিদ মিনারের সামনে আমরণ অনশনে বসলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিহীন ছাত্র! কারণ কী?