বিশ্লেষণ: লড়াই সবে শুরু তালিবানের! বন্দুকের নলে ক্ষমতা মিললেও পারবে কি ধরে রাখতে?

বিপুল আর্থিক সঙ্কটের মুখে তালিবান সমস্ত ব্যাঙ্ক খোলার নির্দেশ দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে কত টাকা তুলতে পারবেন আফগানবাসীরা, তাও স্থির করে দিয়েছে তালিবান। তবে এই সামান্য বিধিনিষেধ আরোপ করে দেশে অর্থ সঙ্কট মেটানো যাবে না।

বিশ্লেষণ: লড়াই সবে শুরু তালিবানের! বন্দুকের নলে ক্ষমতা মিললেও পারবে কি ধরে রাখতে?
আদৌই রাজত্ব ধরে রাখতে পারবে তো তালিবান?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 09, 2021 | 12:45 PM

কাবুল: ২০ বছর পর ফের আফগানিস্তানের মসনদ দখল করেছে তালিবান। তবে সামনে এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি। সরকার গঠন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে তালিবানকে। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই ক্ষমতা দখলের দুই সপ্তাহ পর অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করেছে তালিবান। এ বার সামনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি ধাপ পার করতে পারলে তবেই তা সফল প্রশাসক হিসাবে নিজেদের পরিচিত করতে পারবে তালিবান।

১৫ অগস্ট ক্ষমতা দখবের পর থেকেই তালিবানি শীর্ষনেতাদের তরফে বারংবার জানানো হয়েছে যে, তারা আর যুদ্ধ চান না। শান্তিপূর্ণভাবে সরকার গঠনই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দেশবাসীকেও ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি  দেওয়া হচ্ছে যে, দেশে সুশাসন স্থাপন করা হবে। শরিয়া আইন মেনেই নারীশিক্ষা ও চাকরির অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে। তবে ২০ বছর আগের তালিবানকে মনে রেখেই এখনই বিশ্বাস করতে রাজি নয় আফগানবাসী।

সরকার ঘটনের প্রথম ধাপ পার করলেও এখনও তালিবানের পথে বিছানো আছে একাধিক কাঁটা। এগুলি হল-

১. অর্থসঙ্কট: 

আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠনের পরই তালিবানের সামনে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল দেশের অর্থসঙ্কট দূর করা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের জিডিপির ৪০ শতাংশই বিদেশী সাহায্যের মাধ্যমে আসত। দেশের যাবতীয় উন্নয়নকাজও বিভিন্ন দেশের অর্থসাহায্যেই করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলেছে ভারত, ৪০০-রও বেশি প্রকল্পে কাজ করছে ভারত। দেশের সড়ক পথ থেকে শুরু বাঁধ, স্কুল-কলেজ থেকে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, সবকিছুরই উন্নয়নের পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ভারতের। তবে তালিবান আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পরই সেই সমস্ত উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ থমকে গিয়েছে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্থ ও খাদ্য সাহায্যও।

বিপুল আর্থিক সঙ্কটের মুখে তালিবান সমস্ত ব্যাঙ্ক খোলার নির্দেশ দিয়েছে। প্রতি সপ্তাহে কত টাকা তুলতে পারবেন আফগানবাসীরা, তাও স্থির করে দিয়েছে তালিবান। তবে এই সামান্য বিধিনিষেধ আরোপ করে দেশে অর্থ সঙ্কট মেটানো যাবে না। আফগানিস্তানের অর্থভাণ্ডারের একটি বড় অংশই আটকে রয়েছে বিদেশে। এতদিন নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ দ্বারাই এতদিন আফগানিস্তানের অর্থভাণ্ডার নিয়ন্ত্রিত হত। ঘানি সরকারের পতনের পরই ওয়াশিংটনের তরফে আফগানিস্তানের অর্থভাণ্ডারে তালিবান যাতে হাত লাগাতে না পারে, তার জন্য অ্যাকউন্টের গতিবিধি বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে চিন, রাশিয়ার মতো নতুন মিত্র দেশের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে তালিবান।

২. গৃহযুদ্ধ: 

একের পর এক প্রদেশ দখল নিয়ে গোটা আফগানিস্তানেই কবজা করেছিল তালিবান। কিন্তু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে দেশে যে একমাত্র তারাই নেই, তা বুঝিয়ে দিয়েছে আইসিস খোরাসান। তালিবানের চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করা আইসিস-কে’র লক্ষ্য শুধু আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ না থেকেই গোটা বিশ্বে ইসলামিক আইন ছড়িয়ে দেওয়া। কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাও জাহির করেছে আইসিস-খোরাসান বাহিনী। এতদিন মার্কিন বাহিনীর সাহায্যেই দেশের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমন করত আফগান সরকার। কিন্তু মার্কিন বাহিনীও আফগানিস্তানের মাথার উপর থেকে সাহায্যের হাত তুলে নেওয়ায় একাই দেশের সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে সামাল দিতে হবে তালিবানকে। ফলে যে কোনও সময়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

৩. প্রতিরোধ বাহিনী:

গোটা আফগানিস্তান দখল করে নিলেও কাবুলের উত্তরে অবস্থিত পঞ্জশীরের দখল নিতে পারছিল না তালিবান। সেখানে আহমেদ মাসুদের নেতৃত্বে প্রতিরোধ বাহিনী তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। প্রতিরোধ বাহিনীর ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার কারণে বেশ অস্বস্তিতেও পড়েছিল তালিবান। অবশেষে সোমবার পঞ্জশীর দখল করেছে তালিবান। তবে হার মানতে নারাজ প্রতিরোধ বাহিনীও। শীর্ষনেতা আহমেদ মাসুদ অডিয়ো বার্তায় জানিয়েছেন, পঞ্জশীরেই রয়েছে প্রতিরোধ বাহিনী এবং তারা তালিবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। পঞ্জশীর থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে একাধিক অঞ্চলেই স্থানীয় বাসিন্দারা তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেছে। ৩৪টি প্রদেশ দখল করলেও তা কতদিন নিজেদের দখলে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা গিয়েছে।

৪. আফগানবাসীর বিশ্বাস অর্জন: 

২০ বছর আগে শাসনকালে যে চরমপন্থী মনোভাব দেখিয়েছিল, তা এখনও আফগানবাসী মনে রেখেছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরই তালিবান বারংবার জানানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কঠোর শাসন, হিংসাত্মক রূপ আর নেবে না তারা। জনদরদী সরকার গঠনই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু বিগত দুই সপ্তাহেই বাস্তবে ঘটেছে ঠিক উল্টো ঘটনাগুলিই। বিনা কারণে স্থানীয়দের মারধর, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আফগান সেনা বা মার্কিন বাহিনীকে মদতদাতাদের খোঁজ ও খুনের ঘটনাই তালিবানের পরিবর্তিত রূপের প্রমাণ দিচ্ছে। ক্ষমতা বা অস্ত্রের চোখ রাঙানিতে দেশের নাগরিকদের বিশ্বাস অর্জন করা যাবে না, তা বুঝে গিয়েছে তালিবান। তাই দেশবাসীর মনজয় করতে চাইছে তালিবান।

৫. সরকার বিরোধী মিছিল:

২০ বছর আগে তালিবান সরকারের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করতে ভয় পেতেন আফগানবাসীরা। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে আফগানবাসী, বিশেষত মহিলাদের মনোবল বেড়েছে। তালিবানের বন্দুকের সামনে দিয়েই  সরকার বিরোধী মিছইল বের করছেন তারা। গতকালই মহিলাদের একটি মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় তালিবান। তবে দিনের পর দিন একই ধরনের আন্দোলন হওয়ায় উদ্বেগে রয়েছে তালিবান।

৬. শরিয়া আইন:

আফগানিস্তান সরকারের যাবতীয় নিয়ম শরিয়া আইন অনুসরণ করেই স্থির করা হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম নেতা আখুন্দজাদা। কিন্তু কয়েক হাজার বছর শরিয়া আইন নাকি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত আধুনিক আইন অনুসরণ করা হবে, তা বনিয়ে সংশয় রয়েছে। আফগানবাসীও এই শরিয়া আইন কতটা অনুসরণ করবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

৭. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:

কেবল সরকার গঠন করেই তালিবাবনের দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। নতুন ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক পাইয়ে দিতে হবে তালিবান। এই পথ মোটেও সোজা নয়, তালিবানরা ক্ষমতা দখলের পরই একাধিক দেশ জানিয়ে দিয়েছে তারা তালিবান সরকারকে সমর্থন করবে না।  এই পরিস্থিতিতে বাকি দেশগুলির কাছে নিজেদের উগ্রপন্থী পরিচয় ঝেড়ে ফেলে সঠিক সরকার দখল করতে চায় তালিবান।

৮. দেশের কাঠামো:

তালিবানদের কাছে বন্দুকের জোর থাকলেও শিক্ষার অভাব প্রকট। ক্ষমতা দখলের পরই বহু চিকিৎসক, শিক্ষক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। তালিবান নিজেও এই কথা স্বীকার করে নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল উদ্ধারকার্য চালানোর নামে দেশের সম্পদদের কেড়ে নিচ্ছে বিদেশী শক্তি। বর্তমানে একটি শক্তিশালী সরকার গঠনের জন্য় দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রকেও শক্তিশালী করতে হবে। তবে শরিয়া আইন চাপিয়ে ইতিমধ্যেই শিক্ষাক্ষেত্র থেকে মহিলাদের কার্যত বঞ্চিত করার পথে হাঁটছে তালিবানরা। এ দিকে, কাবুল বিমানবন্দরের হামলার পরই মহিলা চিকিৎসক-স্বাস্থ্য়কর্মীদের কাজে ফেরাতে বাধ্য হয়েছিল তালিবানরা। আগামিদিনেও একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করলে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল আরও খারাপ হবে। এই পরিস্থিতি শোধরানোও তালিবানের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: টিকা নিয়ে রক্তারক্তি, বঙ্গ জুড়ে অনিয়ম, গাফিলতি কোথায়? 

আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: ফের কি গৃহযুদ্ধ আফগানিস্তানে? জঙ্গি তালিবানের নয়া শত্রু ‘আইসিস-কে’, কেন উদ্বেগে নয়া দিল্লি?