বিশ্লেষণ: টিকা নিয়ে রক্তারক্তি, বঙ্গ জুড়ে অনিয়ম, গাফিলতি কোথায়?

TV9 Explained: প্রশ্ন উঠছে কেন টিকা নিতে এইভাবে মানুষের ঢল? কেনই বা টিকার জন্য পদপিষ্ট হচ্ছেন অনেকে? রক্তারক্তি কাণ্ডের সাক্ষী থাকছে বাংলা?

বিশ্লেষণ: টিকা নিয়ে রক্তারক্তি, বঙ্গ জুড়ে অনিয়ম, গাফিলতি কোথায়?
অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 05, 2021 | 7:08 PM

পশ্চিমবঙ্গ:  রাজ্যে পর্যাপ্ত করোনা টিকা রয়েছে এমন কথা আগেই ঘোষণা করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। টিকার আকাল সেই অর্থে আপাতত মিটলেও বারবার উঠে এসেছে টিকাকরণে বেনিয়মের ছবি। হালেই, ধুপগুড়ি স্বাস্থ্য়কেন্দ্রে টিকা নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়েছেন ২৯ জন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন পুলিশ আধিকারিকরাও।  একই ছবি ধরা পড়েছে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজেও। সেখানে কেউ পদপিষ্ট না হলেও লাইনে ধ্বস্তাধ্বস্তি বিশৃঙ্খলার ছবি সামনে এসেছে। সোনারপুরের কালিকাপুর পঞ্চায়েতে ভ্যাকসিন লাইনে চরম বিশৃঙ্খলা। কুপন বিলিতে হুড়োহুড়ি, হাতাহাতি। মালদার গাজোলে এমনকী নদিয়ার শান্তিপুরে টিকা নিতে কাতারে কাতারে ছুটে আসছেন মানুষ এমন ছবিও ধরা পড়েছে TV9-এর ক্য়ামেরায়।

প্রশ্ন উঠছে কেন টিকা নিতে এইভাবে মানুষের ঢল? কেনই বা টিকার জন্য পদপিষ্ট হচ্ছেন অনেকে? রক্তারক্তি কাণ্ডের সাক্ষী থাকছে বাংলা? পর্যাপ্ত টিকার জোগান থাকা সত্ত্বেও বারবার কেন দেখা যাচ্ছে এই অনিয়ম? গাফিলতি কোথায়? কী বলছে জেলার চালচিত্র? সে সব ফাঁকফোঁকর খুঁজে দেখল গ্রাউন্ড জ়িরোয় দাঁড়িয়ে TV9 বাংলা ডিজিটাল।

ধুপগুড়ি থেকে সোনারপুর সর্বত্রই একটি সাধারণ সমস্যার কথা সামনে এসেছে, তা হল পরিকাঠামো ও যোগাযোগের অভাব। তবে, এই যোগাযোগের অপ্রতুলতা কি পরিস্থিতির দরুন নাকি এর নেপথ্যে কাজ করছে অন্য কোনও ‘ম্য়ান-মেড’ অবস্থা, যার ফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ? কোভিড টিকাকরণ নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য় দফতরের স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। নির্দেশিকা রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকেরও।

কী বলা হচ্ছে নির্দেশিকায়? 

কোভিড- ১৯ ভ্যাকসিন ইন্টালিজেন্স নেটওয়ার্ক(কো-উইন) ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নাম নথিভুক্তিকরণ ছাড়াও কতজন টিকা নিয়েছেন, কতজন টিকা পাবেন, কতজনকে টিকা দেওয়া বাকি রয়েছে, সমস্ত তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয়, রাজ্য ও জেলাস্তরে ২৯ হাজার কোল্ডচেইন পয়েন্টে সঠিক তাপমাত্রায় কত ডোজ় মজুত রয়েছে, সে সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভবপর হচ্ছে।

** বর্তমানে কোভিড ১৯ টিকাকরণ ক্ষেত্রে ‘ওপেন ভায়াল নীতি’নেই। অর্থাৎ একটি ভায়াল খোলার পর এটি একটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। টিকাদানকারীকে প্রতিটি ভায়াল খোলার তারিখ, সময় চিহ্নিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং ভায়াল খোলার ৪ ঘন্টার মধ্যে সমস্ত খোলা টিকার শিশিগুলি ব্যবহার  বা বাতিল করতে হবে।

** সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি টিকা পর্বে কমপক্ষে ১০০ জন সুবিধাভোগী যাতে টিকা পান তা সুনিশ্চিত করতে হবে । প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন জনবহুল অঞ্চলের ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক টিকা গ্রহণকারী সুবিধাভোগীদের জন্য টিকাপর্বের আয়োজন করতে বলা হয়েছে । টিকার অপচয় রোধে ছোট ছোট জ়োনে ভাগ করে টিকাপ্রদানে জোর দেওয়া হয়েছে।

** রাজ্য সরকার নির্দেশিত নীতিতে ধাপে ধাপে রাজ্য়ে টিকাকরণ প্রক্রিয়া চলছে। প্রথম ধাপে, সাংবাদিক, পুলিশ, চিকিত্‍সকদের মতো প্রথম সারির কর্মী বা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কারদের টিকাকরণ, দ্বিতীয় ধাপে ষাাটোর্ধ্ব ও প্রবীণদের টিকাকরণ, তৃতীয় ধাপে ‘সুপার স্প্রেডার’ হতে পারেন এমন ব্যক্তিবর্গ, চতুর্থ ধাপে ১২ বছর অনুর্ধ্ব শিশুদের মায়েদের টিকাকরণে জোর দিয়েছে রাজ্য।

এখন, এই টিকাকরণ যদি ধাপে ধাপে হয়ে থাকে, নিয়ম মেনে হয়ে থাকে তাহলে সর্বসাধারণের কাছে টিকাকরণের খবর পৌঁছনোর সিংহভাগ দায়িত্ব থাকছে ব্লকস্তরীয় নেতৃত্বের উপর।

ঘটনা ধরে খোঁজা যাক গাফিলতি:

মঙ্গলবার, করোনা টিকা নিতে জলপাইগুড়ি জেলার নতুন ব্লক বানারহাটের শালবাড়ি ১, শালবাড়ি ২ এবং সাকোয়াঝোরা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতে টিকা কেন্দ্রের আয়োজন করা হয়। প্রত্যেকটি টিকাকেন্দ্রে ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে শালবাড়ি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের দুরামারিতে। সব মিলিয়ে প্রবল হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হন মোট ২৯ জন। এঁদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে খবর।

সবাই অন্ধকারে!

টিকার আসায় ভোর থেকেই লাইন দিয়েছিলেন টিকাপ্রাপকেরা। তাঁরা কেবল জানতেন টিকা দেওয়া হবে। টিকার দুটি ডোজ় দেওয়া হতে পারে এমন খবরও পেয়েছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু, ক’জন টিকা পাবেন, কত পরিমাণ টিকা দেওয়া হবে, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারেই ছিলেন সকলে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, টিকা নিয়ে বিতর্কটা কোথায় দানা বাঁধছে? ধুপগুড়ির জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, মঙ্গলবার দুরামারি চন্দ্রকান্ত হাই স্কুলে যে টিকাকরণের শিবির চলছিল বা এইধরনের কোনও পরিকল্পনা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়েছে তা জানতেন না খোদ ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক। এমনকী, চন্দ্রকান্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সজল কান্তি সরকার বলেন, “আমার স্কুলে শিবির করা হবে অথচ আমি জানি না। জানলে কিছু উদ্যোগ নিয়ে সহযোগিতা করা যেত।” প্রশ্ন এখানেই, কার উদ্যোগে তবে এই টিকাকরণ চলল বা শিবিরের আয়োজন করা হল?

নেপথ্যে ‘দুয়ারে সরকার’?

ধুপগুড়ির ওই স্বাস্থ্য়কেন্দ্রে ওই দিন স্বাস্থ্যকর্মী যাওয়ার আগেই চলে গিয়েছিলেন আমজনতা। টিকা নিতে গিয়ে পদপিষ্ট হওয়ার পর ঘটনাস্থলে যান স্বাস্থ্য়কর্মীরা। কেন এই দেরি? সূত্রের খবর, ধূপগুড়ির ওই স্কুলে কিছুদিন আগেই দুয়ারে সরকারের শিবির হয়েছিল। সেই শিবিরটিকেই ফের ব্যবহার করতে চেয়েছিল প্রশাসন। সেই মোতাবেক এসডিপিও গ্রাম পঞ্চায়েতদের নির্দেশ দেন। ধূপগুড়ির পাঁচটি গ্রামের গ্রাম পঞ্চায়েতরা সেই খবর কোনও পরিকল্পনা না করেই ছড়িয়ে দেন নিজেদের এলাকায়। জানিয়ে দেওয়া হয়, টিকা এসেছে। টিকাকরণ হবে। তাহলে কি ‘ফার্সট কাম, ফার্স্ট সার্ভ’ নীতিই প্রযোজ্য হচ্ছে গ্রামীণ অঞ্চলে? আমজনতার কাছে অন্তত বার্তা যাচ্ছে খানিকটা এইরকমই। ফলে, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা না পাওয়ায় এই সংক্রান্ত কোনও নির্দেশ পেলেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সকলে। যে-কোনও মূল্যেই আগেভাগে করাতে হবে বিনামূল্যে টিকাকরণ। কোনও কিছু না ভেবেই তাই ছুটছেন মানুষ। তোয়াক্কা করছেন না অপর কোনও নির্দেশের। মঙ্গলবারের ঘটনাটিও এর ব্যতিক্রম নয়। যদিও, সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা নেতৃত্ব।

নোটিস বোর্ড টাঙিয়েই দায়িত্ব খালাস!

টিকাকরণকে কেন্দ্র করে হাসপাতাল চত্বরেই নোটিস বোর্ড টাঙায় মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেখানেই লেখা থাকে টিকাকরণের কথা। মেডিক্যাল কলেজের বাইরে সেই নোটিস ছড়িয়ে যায় মুখ থেকে মুখে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, প্রত্যেক এলাকায় মাইকিং করে টিকাকরণ কর্মসূচির কথা প্রচার করার মতো লোকবল ও অর্থ সাহায্য নেই। ফলে, একটি নোটিস পেলেই ছুটে ছুটে আসছেন এলাকাবাসী। বেনিয়ম দেখলেই শুরু হয়ে যাচ্ছে বিক্ষোভ।

সোনারপুরের কালিকাপুরে প্রায় একই ছবি। সেখানেও ১২০০ জনকে টিকা দেওয়ার কথা। কিন্তু কুপন নিতে ভিড় করেন প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ। পদপিষ্ট হলেও কিছু বলার নেই। স্থানীয়দের অভিযোগ, টিকা চেয়েও টিকা মেলেনি। ফলে, নোটিস পেতেই টিকা নিতে ছুটে ছুটে আসা ও সংগ্রহ করার চেষ্টা। সেখান থেকেই সমস্যা।

তাড়াহুড়ো করে অঙ্ক মেলানো

শুধু ধুপগুড়ি মুর্শিদাবাদ বা সোনারপুরেই এমন বিতর্ক নেই। বিতর্কের ঝড় বাংলা জুড়ে। সমস্যাটা কোথায়? সোনাপুরের কথাই ধরা যাক। সেখানকার ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক জানিয়েছেন, অধিকাংশ সময়েই টিকা যে আসছে বা টিকার স্টক ফুরিয়ে গেলে তা পুনরায় সঞ্চয় করা হচ্ছে, সেই খবরই আসছে রাতে। সরকারি নীতি ও নিয়মে টিকার জোগান পূর্তি হলে তারপর কমপক্ষে ১৪-১৫ দিন পর্যন্ত ওই সঞ্চিত টিকা ব্যবহারযোগ্য। তাই টিকা এলেই দিয়ে দিতে হবে এমন তাড়াই মূল এমনটা নয়। আগেভাগে টিকাকরণ করতে হবে এমন চিন্তা যেমন রয়েছে তেমন রয়েছে সঞ্চিত টিকা শেষ করেই দ্রুত টিকা মজুত করা। হিসেবের অঙ্ক মেলাতে গিয়েই এই বিপত্তি। সূত্রের খবর, সোনারপুরে টিকা এসে পৌঁছনোর পরের দিনের মধ্যেই টিকাকরণ কর্মসূচি শেষ করতে যান প্রশাসকেরা। ফলে, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা থেকে শুরু করে টিকাকরণের গোটা কর্মসূচিটির নেপথ্যে থাকে প্রশাসকের পরিকল্পনার অভাব।

বাড়ি বাড়ি সঠিকভাবে নোটিস ডেকে নির্বাচন করা সম্ভব নয় যে কারা টিকা পাচ্ছেন বা কারা নয় এমনটাই ঠারেঠোরে জানিয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সঠিক তথ্য় না পেয়ে টিকাকেন্দ্রে ভিড় বাড়ান প্রয়োজনাতিরিক্ত মানুষ। যদিও, এ প্রসঙ্গে সোনারপুরের ব্লক আধিকারিককে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্পষ্ট জানান, দুয়ারে সরকারের কাজে ব্যস্ত ওই আধিকারিক। তাই এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না। তাহলে, টিকা নিয়ে এই তুমুল তাণ্ডব কি বঙ্গ জুড়ে চলতেই থাকবে? দায় এড়িয়ে যাবেন সকলে? প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট মহলের। আরও পড়ুন: ভোট পরবর্তী হিংসা তদন্তে নিহত আইএসএফ কর্মীর বাড়িতে সিবিআই