Sheikh Hasina’s Aynaghar: হাসিনার ‘আয়নাঘর’, গায়ে কাঁটা দেওয়া এক কালো কুঠুরি!

Sheikh Hasina's Aynaghar: আয়নাঘর নামটা খুবই সুন্দর। মনে হতে পারে আয়নায় মোড়া যেন রূপকথার কোনও জায়গা। কিন্তু, এই রূপকথাসূলভ নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে গুম, অত্যাচার, বিনা বিচারের বছরের পর বছর আটকে রাখার ভয়ানক কাহিনি। হাসিনার আমলে, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিরোধী, সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সেনাকর্তা থেকে শুরু করে, বহু মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে এখানে।

Sheikh Hasina's Aynaghar: হাসিনার 'আয়নাঘর', গায়ে কাঁটা দেওয়া এক কালো কুঠুরি!
প্রতীকী ছবি Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Aug 12, 2024 | 2:54 PM

২০১৬ সালের মে মাস। বাংলাদেশের গাজীপুরে একটি গাড়ির মেরামতের দোকানে বসেছিলেন শেখ মহম্মদ সেলিম। কাজের সূত্রে থাকতেন মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বিয়ে করতে। পরিবারের বাস-গাড়ির ব্যবসা। আচমকা ২৯ মে সকালে ওই গাড়ি সারাইয়ের দোকান থেকে তাঁকে একটি বাসে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ৪-৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি। তাঁর হাত বাঁধা হয়েছিল পিছমোড়া করে, চোখও কাপড় দিয়ে বেঁধে তার উপর পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটি কালো টুপি। ফলে, সেলিমের কোনও ধারণাই ছিল না, কারা তাঁকে ধরেছেন, কেন তাঁকে ধরা হয়েছে, বা, তাঁকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে, হাসিনুর রহমানের গল্পটা ছিল অনেকটাই আলাদা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সেনার এক প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। সামরিক বাহিনীতে বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন ‘বীর প্রতীক’ খেতাবও। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা’র দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর, ২০১৮ সালে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। দুজনকেই আলাদা আলাদা সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। তবে, তাঁদের গন্তব্য ছিল অভিন্ন, ‘আয়নাঘর’। আয়নাঘরে ঢোকার পর থেকে দীর্ঘদিন তাঁদের কোনও খোঁজ ছিল না পরিবারের কাছে। হঠাতই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন। তবে এই দুজনই নন, আরও অনেকেই তাঁদের মতো মিলিয়ে গিয়েছিলেন আয়নাঘরে। ২০২৪-এর ৫ অগস্ট দুপুরে, সামরিক হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়েছেন। তারপর থেকে, এই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া মানুষদের অনেকেরই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই ফিরছেন ঘরে।

একাত্তরের যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের ‘জামাতে ইসলামি’ দলের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য, মির কাসেম আলিকে। তাঁর ছেলে, আহমদ বিন কাসেম আরমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ২০১৬-র ৯ অগস্ট, মিরপুর থেকে কিছু সাদা পোশাকের সশস্ত্র লোক তাঁকে গুম করেছিল। এর কয়েকদিন পরই, ২৩ অগস্ট একইভাবে গুম করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা কর্তা, বিগ্রেডিয়ার (বরখাস্ত) জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমিকে। তিনি জামাতে ইসলামির প্রাক্তন আমির, প্রয়াত গোলাম আজমের ছেলে। মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল গোলাম আজমকে। জেলেই তাঁর মৃত্যু হয়। আর ২০১৯-এর ৯ এপ্রিল, নারায়ণগঞ্জ থেকে সাংগঠনিক কাজ সেরে ঢাকায় ফেরার পথে গুম করা হয়েছিল, ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র নেতা মাইকেল চাকমাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম-সহ গোটা বাংলাদেশের সব জাতির জনগণ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন তিনি।

গুম হওয়ার আগে ও আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আহমদ বিন কাসেম আরমান

তিনজনেরই এতদিন কোনও খোঁজ ছিল না। কেউ জানতেন না তাঁরা কোথায়। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। তবে, সবটা বদলে গিয়েছে ৫ অগস্ট। শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পরই, ম্যাজিকের মতো নিকটজনদের কাছে ফিরেছেন তাঁরা তিনজন। তিনজনকেই রহস্যজনক পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে। তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। শুধু এই তিনজন নন। হাসিনার দেশ ত্যাগের পর, আয়নাঘর থেকে অন্তত ২৮৪ জন মুক্তি পেয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে, এখনও সেখানে আরও অনেকে বন্দি বলে দাবি করেছেন আয়নাঘর থেকে বের হওয়া আইনজীবী, আহমদ বিন কাসেম আরমান। কী এই আয়নাঘর? কারা বন্দি থাকত সেখানে? আসুন জেনে নেওয়া যাক শেখ হাসিনার এই রহস্যময় কালো কুঠুরির আদ্যোপান্ত –

গুম হওয়ার আগে ও আয়নাঘর থেকে মুক্তির পর বাংলাদেশের প্রাক্তন সেনা কর্তা, বিগ্রেডিয়ার (বরখাস্ত) জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমি

আয়নাঘর নামটা খুবই সুন্দর। মনে হতে পারে আয়নায় মোড়া যেন রূপকথার কোনও জায়গা। কিন্তু, এই রূপকথাসূলভ নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে গুম, অত্যাচার, বিনা বিচারের বছরের পর বছর আটকে রাখার ভয়ানক কাহিনি। আসলে, আয়নাঘর হল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতর বা ডিজিএফআই-এর আওতাধীন এক গুপ্ত গুম ঘর। গুপ্ত গুম ঘরেটির কোডনেম ছিল আয়নাঘর। কীভাবে এই কোডনেম এল তা স্পষ্ট নয়। হয়ত বা, বাংলাদেশি সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ‘আয়নাঘর’ উপন্যাস থেকে। সেই উপন্যাসেও একটি আয়নাঘরের কথা বলেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। সেটি ছিল জানলাবিহীন ছোট্ট একটা কামরা, যার দেওয়াল জুড়ে প্রাকান্ড সব আয়না ছিল। জানালা নেই, তাই দরজা বন্ধ করলেই সেই ঘর অন্ধকার হয়ে যেত। তাই ঢুকতে হত প্রদীপ বা মোমবাতি নিয়ে। দরজা বন্ধ করে প্রদীপ বা মোম জ্বাললেই এক অদ্ভূত জাদু পরিস্থিতি তৈরি হত। উপন্যাসের চরিত্র লিলিয়ানের মনে হয়েছিল, আয়নার ভিতর দিয়ে কে যেন তাকে দেখছে। হাসিনার আয়নাঘরের কক্ষগুলিও ছিল এমনই। তবে, কোনও আয়না ছিল না।

মুক্তি পেয়েছেন মাইকেল চাকমা, তার আগে তাঁর মুক্তির দাবিতে হয়েছে অনেক আন্দোলন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা অনেক প্রচেষ্টা করেছিলেন। গত পনেরো বছরে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয়ের ব্যাপক বৃদ্ধিতে স্পষ্ট, তাঁর সেই চেষ্টা কাজেও দিয়েছিল। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জোর দিয়েছিলেন পরিকাঠামো উন্নয়নে। কিন্তু, তাঁর বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি ‘স্বৈরাচারী’। কোনও ধরনের বিরোধিতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর আমলে, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিরোধী, সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সেনাকর্তা থেকে শুরু করে, বহু মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে বলে, অভিযোগ ছিল। ঢাকার মানবাধিকার সংগঠন, ‘অধিকার’-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে, সেই দেশে প্রায় ৩৪৪ জন ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছিল। পরে, তাদের মধ্যে ৪০ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সরকারি হেফাজতে পাওয়া গিয়েছিল ৬৬ জনকে। আরও ২০৩ জন ছিলেন নিখোঁজ। তাঁরা কোথায়, কেউ জানত না। এদের অনেকেই আয়নাঘরে বন্দি ছিল বলে মনে করা হয়। বিচার বহির্ভূতভাবে আটকে রাখা এবং হত্যার এই সকল ঘটনা নিয়ে, সময়ে সময়ে হাসিনা সরকারের নিন্দা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বা ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে’র মতো বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। ১০ বছর ধরে আটক থাকা ৮৬ জনের নামের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

আয়নাঘরের রহস্য ফাঁস করেছিলেন, পরিবহণ ব্যবসায়ী শেখ মহম্মদ সেলিম এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান

তবে, ওই অবধিই। আটকদের কোনও খোঁজ তারা দিতে পারেনি। আসলে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই আয়নাঘরের অস্তিত্বর কথাও কেউ জানত না। ২০২২ সালে, ‘নেত্র নিউজ’ নামে সুইডেনের এক সংবাদ সংস্থা এবং জার্মান সংবাদ সংস্থা ‘ডয়চেভেল’, আলাদা আলাদাভাবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের এই গোপন বন্দিশালা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাদেরকেই বলা যায় আয়নাঘরের ‘হুইশল ব্লোয়ার’। আজ পর্যন্ত খুব কম বন্দিই আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছে। সামান্য কিছু বন্দিকে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে, হাসিনা বাংলাদেশে থাকাকালীন, এই মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারও মুখ খোলার সাহস হয়নি। আরও কড়া শাস্তির ভয়ে তাঁরা মুখে কুলুপ দিয়েছিলেন। তবে, নেত্র নিউজের কাছে আয়নাঘরের রহস্য ফাঁস করেছিলেন, শেখ মহম্মদ সেলিম এবং হাসিনুর রহমান। যে পরিবহণ ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কাহিনি দিয়ে এই লেখা শুরু হয়েছে।

তাঁদের বয়ান থেকেই এই গুপ্ত জেলখানার খুঁটিনাটি জানা গিয়েছিল। জানা গিয়েছিল এর অবস্থান। জানা গিয়েছিল, এই জেলখানায় কীভাবে রাখা হত বন্দিদের। কতটা অত্যাচার করা হত। অত্যাচার ঢাকতেই বা কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। সেলিম বুঝতেপরেননি আয়নাঘরের অবস্থান। শুধু জানতেন, কাছাকাছি কোনও জায়গায় সারাদিন বিমান ওঠানামা করে। তবে, হাসিনুর রহমান নিজেই সেনায় ছিলেন। ২০১২ সালে, ২৮ বছর ধরে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়ার পর, তাঁকেই ‘সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা’র দায়ে বরখাস্ত করা হয়েছিল। এরপর, ২০১৮ সালে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। ডিজিএফআই-এর কাউকে আটক করার আইনি এক্তিয়ার নেই। তাই, ওই পরিচয়েই এই সংস্থার সদস্যরা তাঁকে এক প্রকার গুম করেছিল। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, তাঁকে ছেড়ে হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর ঘরের লোক হওয়ায়, আয়নাঘরের অবস্থান তিনি ঠিকই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেতে অবস্থিত ডিজিএফআই সদর দফতর। হাসিনুর ও আরও বিভিন্ন মানুষের বয়ান অনুযায়ী, তার মধ্যেই এক জায়গায় অবস্থিত আয়নাঘর। আমেরিকার ‘ম্যাক্সার স্যাটেলাইট’-এর মাধ্যমে, ঢাকার সেনানিবাসের মধ্যে আয়নাঘর জেলখানার ছবিও দেখা গিয়েছে।

আমেরিকার ‘ম্যাক্সার স্যাটেলাইট’-এর মাধ্যমে, ঢাকার সেনানিবাসের মধ্যে আয়নাঘর জেলখানার ছবিও দেখা গিয়েছে

জানা যায়, এই বন্দিশালায় মোট ৩০টি সেল বা কক্ষ রয়েছে। আরও আছে বেশ কয়েকটি সাউন্ড-প্রুফ কক্ষ। অর্থাৎ, যে ঘর থেকে আওয়াজ বাইরে আসে না, বা, বাইরের আওয়াজ ভিতরে আসে না। সেখানে বন্দিদের নির্যাতন করা হয়। জেলখানাটির একেকটি সেকশনে আছে পাঁচটি করে কক্ষ। প্রতি পাঁচটি কক্ষের সঙ্গে রয়েছে একটা করে শৌচাগার। শৌচাগারে, একটি লো প্যান, একটি হাই প্যান এবং একটি করে কমোড আছে। খাবার-দাবার ভালই ছিল। বন্দিদের দেওয়া হত বিস্কুট, জল, মাংস ইত্যাদি। কারাগারে ছিল বেশ কয়েকটি বড় বড় এগজস্ট ফ্যান। প্রতি পাঁচটি কক্ষের সঙ্গে থাকত সেই ধরনের দুটি করে এগজস্ট ফ্যান। দিন-রাত সেই ফ্যানগুলি চলত। তাই শুধু তারই আওয়াজ পাওযা যেত। কিন্তু, ফ্যানগুলি বন্ধ হলেই বিভিন্ন কক্ষ থেকে ভেসে আসত কান্নার শব্দ। কক্ষগুলিতে কোনও জানালা ছিল না। ছিল দুটি করে দরজার কড়া প্রহরা। প্রথম দরজাটি ছিল লোহার শিকের, পরের দরজাটি কাঠের। কাঠের দরজাটিতে ছিল একটি করে ছিদ্র। গোটা কুঠুরিকে ওই একটি ছিদ্র দিয়েই সামান্য আলো-বাতাস আসত। ডিজিএফআই-এর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো এই জেল পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। সন্দেহের বশে বহু মানুষকে তুলে নিয়ে এসে এই গোপন কারাগারে মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর আটক রাখা হত। এরপর তাদেরকে এমনভাবে আদালতে পেশ করা হত, যেন তাদের সবে মাত্র গ্রেফতার করা হয়েছে।

আয়নাঘরের বিভিন্ন ছবি

কী ধরনের অত্যাচার করা হত আয়নাঘরে? হাসিনুর রহমান প্রাক্তন সেনা কর্তা হওয়ায়, কিছুটা খাতির পেয়েছিলেন। শেখ মহম্মদ সেলিমের ভাগ্য ততটা প্রসন্ন ছিল না। অথচ, তাঁকে ভুলবষশতঃ ধরেছিল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা বিভাগ। ইকবাল হোসেন নামে নিষিদ্ধ জিহাদি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ’-এর এক সদস্যকে ধরার লক্ষ্য ছিল তাদের। সে সেলিম ছদ্মনাম ব্যবহার করত। তার সঙ্গেই পরিচয় বিভ্রাট হয়েছিল এই সেলিমের। সেলিম জানিয়েছেন, এক ভোরবেলা তাঁকে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এক মহিলা তাঁকে জেরা করেন। তাঁর নাম, বাবার নাম, তাঁর পরিচয়, জন্ম তারিখ জানতে চাওয়া হয়। তাঁকে পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সদস্য বলে ঠাউরেছিল প্রতিরক্ষা গোয়েন্দারা। সেলিম জানিয়েছিলেন, তিনি আইএসআই-এর নামই শোনেননি কোনোদিন। গোয়েন্দারা তা মানতে চাননি। সেলিমের বয়স সংক্রান্ত তথ্যও ভুয়ো বলে মনে করেছিল তারা। আর এই বিভ্রান্তি দূর করতে শুরু হয়েছিল বেধড়ক মার। সেলিম বলেছিলেন, তাঁর পায়ে যাচ্ছেতাই ভাবে মারা হয়। তিনি মার খেয়ে একদিকে কাত হয়ে গেলে, অন্যদিকে দিয়ে মারা হয়।

এই সেই কুখ্যাত আয়নাঘর

এই পর্যায়ে তাঁর ডাক ছেড়ে কাঁদা আর যন্ত্রনায় চিৎকার করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। এরপর, ওই মহিলা জেরাকারী হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেলিম কখনও পঞ্চগড়ে গিয়েছেন কিনা? তাঁকে বলা হয় গোপালগঞ্জের এক জায়গায় তিনি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য বোমা পুঁতে রেখেছিলেন। সেই অভিযোগও অস্বীকার করেন সেলিম। তাতে অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়েছিল। কিন্তু, ক্রমে ডিজিএফআই বুঝতে পারে তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। তারা ভুল সেলিমকে ধরে এনেছে। এরপর তাঁকে ঢাকা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশও তাকে নিস্তার দেয়নি। সেলিমের নামে ভুয়ো মামলা দায়ের করা হয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, সোজা মালয়েশিয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন সেলিম।

সেলিম বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেলেও, বহু মানুষেরই সেই সৌভাগ্য হয়নি। গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সেলিম জানিয়েছিলেন, তাঁকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরের দেওয়ালে তাঁর আগে ওই ঘরে থাকা বহু মানুষ তাদের নিজেদের কথা লিখে রেখেছিলেন। মাংসের হাড় বা অন্য কোনও ধারাল বস্তু দিয়ে কক্ষের দেওয়ালে তারা অনেক কথাই লিখেছিল। কেউ কেউ ফোন নম্বর লিখে বলেছিলেন, তাঁদের বাড়িতে পারলে একটা খবর দিতে। বলে দিতে, তাঁদের আয়না ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। বলে দিতে, তাঁদের গুম করেছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দারা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ২০০৯ সালেই প্রথম, সেই দেশে এই ধরনের বিচার বহির্ভুতভাবে আটকে রাখা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে এই অগণতান্ত্রিক কাজ করার অধিকার দেওয়া হল?

কী ছিলেন, কী হয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল বাসিনুর রহমান

শুধু রাজনৈতিক বিরোধীরাই নন, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের বহু মানুষও দাবি করেছেন, আওয়ামি লিগ শাসিত বাংলাদেশকে বিরোধী শূন্য করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আর তাই কখনও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকা, কখনও জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নির্বিচারে গুম করে দেওয়া হয়েছে অজস্র মানুষকে। আগে যাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ছাড়াও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক তথা শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়, বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন, সাইফুল ইসলাম – তালিকাটা দীর্ঘ। এঁদের অনেককেই মুক্তি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। হাসিনা দেশত্য়াগের পর, তাঁরা এক এক করে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। মারুফ জামান জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১৬ মাস তিনি আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন। তাঁর দাবি, আয়নাঘর তৈরি ছিল শেখ হাসিনার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা, মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মস্তিষ্ক প্রসূত। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) হাসিনুর রহমানও গুমের ঘটনার মূল হোতা হিসেবে সিদ্দিকের নামই করেছেন।

এই ঝকঝকে ভবনের ভিতরেই নাকি কুখ্যাত আয়নাঘর

হাসিনার দেশত্যাগের পর আজ আয়না ঘর থেকে একের পর এক বন্দি মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা নিখোঁজ ছিলেন, তাঁরা ঘরে ফিরেছেন। তবে, তারপরও এখনও বহু মানুষেরই খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামি লিগ সরকারের শাসনে, যাদেরকে গুম করা হয়েছে, সেই সকল ঘটনাগুলিকে জনসমক্ষে আনাই ছিল তাদের লক্ষ্য। হাসিনা বিদায়ের পর তারা দাবি করেছে, সকল রাজনৈতিক বন্দিদের পাশাপাশি আয়নাঘরের বন্দিদেরও মুক্তি দিতে হবে। এরপরই, রহস্যজনক পরিস্থিতিতে পরপর মুক্তি পান আইনজীবী আহমদ বিন কাসেম আরমান, বিগ্রেডিয়ার (বরখাস্ত) জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমি, মাইকেল চাকমারা। হাসিনা বিদায়ের পরই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেতে, ডিজিএফআই সদর দফতরের সামনে মানববন্ধন করেছিল ‘মায়ের ডাক’। তাদের হাতে ছিল গুম হওয়া মানুষদের ছবি। ডিজিএফআই তাদের জানিয়েছে, আয়না ঘরে আর কেউ আটক নেই। তাহলে নিখোঁজরা কোথায়? কেউ জানে না। বিএনপি নেতা ‘নিখোঁজ” সাজেদুল ইসলাম সুমন-কে খুঁজে বেরাচ্ছেন তাঁর বোন তথা মায়ের ডাক-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক, সানজিদা ইসলাম তুলি। কুমিল্লার বিএনপি নেতা নিখোঁজ সাইফুল ইসলামকে খুঁজে বেরাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী শাহনাজ আক্তার। তাঁদের কোনও খোঁজ কোনোদিন নাও পাওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়নাঘরের অনেকেই এনকাউন্টারের শিকার হয়েছেন। হাসিনার শাসনে এই জাতীয় ঘটনার কোনও তদন্ত হয়নি বললেই চলে। আয়নাঘরে বন্দি অনেকেরই আবার দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু হয়েছে বলেও শোনা যায়। তারপর তাদের লাশ সেখান থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে সরিয়ে দেওয়া হত। কেউ জানতেও পারত না। কারণ যাদের আটক করা হত, খাতায় কলমে তাদের কোনও তথ্য রাখা হত না। হাসিনার আস্থাভাজনরাই এই আয়নাঘরের দায়িত্বে থাকতেন। কাজেই কোনও কথা বেরও হত না। তাই, আয়নাঘর থেকে আর কাউকে নাও পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য মনে করা হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের এই একটিই নয়, বাংলাদেশ জুড়ে অন্তত ২৩টি এই ধরনের গোপন গুমখানা আছে। সেগুলিতেও থাকতে পারেন কেউ কেউ।

আয়নাঘরের কালো কুঠুরী

গত শতাব্দীতে দীর্ঘদিন আলজেরিয়া ছিল ফ্রান্সের দখলে। আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, আন্দোলন দমনে প্রায় একই ধরনের গুম করার পদ্ধতি অবনম্বন করেছিল ঔপনিবেশিক ফ্রান্স। পরবর্তীকালে এই ফরাসি কায়দা দক্ষিণ আমেরিকার স্বৈর শাসকরাও অবলম্বন করেছিল। গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদোর, চিলি, আর্জেন্টিনার মতো দেশে, বামপন্থী বিপ্লবী নেতাদের ধরে ধরে গুম করে দিতেন ওই দেশগুলির স্বৈর শাসকরা। ওই সকল দেশের সামরপিক গোয়েন্দা বিভাগ, গণতন্ত্রকামী বিপ্লবীদের বিমানে করে অতলান্তিক সাগরে নিয়ে গিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিত। ফরাসীরা ফেলত ভূমধ্যসাগরে। বিপ্লবীদের বিমানে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার এই পদ্ধতি পরিচিত ছিল ‘গোস্ট ফ্লাইট’ বলে। ‘গোস্ট ফ্লাইট’-এর যাত্রীরা ভূতের মতোই যেন হাওয়ায় উবে যেত। ২০০৯-এ আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশেও অনেক মানুষ একই ভাবে ভূতের মতো উবে গিয়েছেন আয়নাঘরে। তাদের ছবি কি এখনও ধরা পড়ে আয়নায়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন তুলি-শাহনাজরা।

আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)