TV9 Explained: আল আকসা, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আরও এক মন্দির-মসজিদ বিতর্ক
al-Aqsa Mosque: এই আল আকসা মসজিদ বা টেম্পল মাউন্ট নিয়ে বিতর্কের তুলনা করা যেতে পারে, ভারতের বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কের সঙ্গে। বাবরি মসজিদের মতোই, আল আকসা মসজিদও ইহুদুদের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

জেরুসালেম: গত শনিবার ইজরায়েলে প্যালেস্টাইনপন্থী হামাস গোষ্ঠীর অতর্কিত হামলা এবং তার জবাবে গাজায় ইজরায়েলের পাল্টা হামলার জেরে, নতুন করে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য। ৫০ বছর পর ফের যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করেছে ইজরায়েল। প্যালেস্টাইনের দখল কাদের হাতে থাকবে, এটাই ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের মূল ভিত্তি। তবে, অনেকেরই জানা নেই, প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলা এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশেষ স্থান। মুসলিমরা যাকে বলে আল-হারাম আল-শরিফ। আর ইহুদিরা বলে, হার হা-বাইত বা টেম্পল মাউন্ট। সাধারণভাবে অবশ্য এলাকাটি আল আকসা মসজিদ চত্বর নামে পরিচিত। কারণ, এখানেই রয়েছে আল আকসা মসজিদ। আর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে বারবার উঠে এসেছে এই মসজিদের নাম। এই আল আকসা মসজিদ বা টেম্পল মাউন্ট নিয়ে বিতর্কের তুলনা করা যেতে পারে, ভারতের বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কের সঙ্গে। বাবরি মসজিদের মতোই, আল আকসা মসজিদও ইহুদুদের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
আল আকসার অবস্থান
আসলে, আল আকসা মসজিদ চত্বরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থান রয়েছে। এর কোনোটি মুসলিমদের কাছে, কোনোটি ইহুদিদের কাছে, আবার কোনোটি খ্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। অর্থাৎ, এই জায়গায় সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তিনটি ধর্মেরই ইতিহাস। জেরুজালেমের ওল্ড সিটির একেবারে কেন্দ্রস্থলে ১৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে অবস্থিত আল -আকসা প্রাঙ্গণ। একটি পাহাড়ের চুড়ায় অবস্থিত এই মসজিদ চত্বর।
আল আকসা কেন মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
মক্কা ও মদিনার পর আল-আকসা মসজিদকেই ইসলাম ধর্মে তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহর কাছে গমনের আগে এই মসজিদেই নামাজ পাঠ করেছিলেন হজরত মহম্মদ। এই মসজিদ চত্বরে মুসলিমদের দুটি পবিত্র স্থান – সোনালি রঙের ‘ডোম অব দ্য রক’ এবং আল-আকসা মসজিদ অবস্থিত। ডোম অব দ্য রকের ভিতরে একটি বিশেষ পাথর আছে, যে পাথরের উপর থেকেই হজরত মহম্মদ উর্ধ্বাকাশে যাত্রা করেছিলেন বলে মনে করেন মুসলিমরা। আল-আকসায় প্রথমে একটি ছোট মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর। পরে ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে এখানে প্রথম একটি বড় আকারের মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। ভুমিকম্পে দুবার এই মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেলেও, পরে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়। বেশ কয়েকবার সংস্কারও করা হয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে মুসলমানরা এই মসজিদে নমাজ পাঠ করতে আসেন।

ডোম অব দ্য রক
কেন টেম্পল মাউন্ট ইহুদিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
অন্যদিকে ইহুদিদের বিশ্বাস, তাদের পয়গম্বর আব্রাহাম তাঁর পুত্র ইসমাইলকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করার জন্য এই ‘টেম্পল মাউন্ট’-এই নিয়ে এসেছিলেন। এরপর, এখানেই ইহুদিদের প্রথম ও দ্বিতীয় পবিত্র মন্দির ছিল। তাদের দাবি, বাইবেলে যে রাজা সলোমনের উল্লেখ রয়েছে, ৩,০০০ বছর আগে তিনিই এখানে প্রথম ইহুদি মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। সেটি ধ্বংস করেছিল ব্যাবিলনীয়রা। আর, ২০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন, রাজা হেরোড দ্য গ্রেট। পরে, ৭০ খ্রিস্টাব্দে সেই মন্দিরটি ধ্বংস করেছিল রোমান বাহিনী। ইহুদিদের দাবি, সেই ধ্বংসাবশেষের উপরই তৈরি হয়েছে আল আকসা মসজিদ। বর্তমানে, আল আকসা মসজিদ চত্বরের পশ্চিমে একটি দেওয়াল রয়েছে, যা পশ্চিমের দেওয়াল নামে পরিচিত। এই দেওয়ালটি দ্বিতীয় মন্দিরের অংশ ছিল বলে দাবি করে ইহুদিরা। এখানেই, এসে প্রার্থনা করতে দেখা যায় গোটা বিশ্বের ইহুদিদের। এছাড়া, আল আকসাতেই ‘ফাউন্ডেশন স্টোন’, অর্থাৎ এমন এক পাথর, যা থেকে গোটা পৃথিবীর উদ্ভব হয়েছিল, সেই পবিত্র পাথরও আল আকসা প্রাঙ্গনেই রয়েছে বলে মনে করে ইহুদিরা। প্রসঙ্গত এই ইহুদিদের এই ‘ফাউন্ডেশন স্টোন’ই, মুসলিমদের ‘ডোম অব দ্য রক’-এর ভিতরে রাখা পাথর।

ডোম অব দ্য রকের গা লাগোয়া এই পশ্চিমের দেওয়ালই ইহুদিরা তাদের প্রাচীন মন্দিরের অংশ বলে দাবি করে
কেন খ্রিস্টানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
খ্রিস্টানরা আবার মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, এই স্থানেই ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল যীশু খ্রিস্টকে। আর এখানকার এক গুহাতেই তারপর তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল এবং তিনি পুনর্জীবিত হয়েছিলেন। কাজেই খ্রিস্টানদের কাছেও এলাকাটি অত্যন্ত পবিত্র। এখানে একটি খ্রিস্টান ব্যাসিলিকাও ছিল, যা ইহুদি মন্দিরের সঙ্গেই ধ্বংস করেছিল রোমানরা। এমনটাই মনে করা হয়।
আল আকসার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আল আকসা প্রাঙ্গন প্যালেস্টাইনি প্রতিরোধের প্রতীকও হয়ে উঠেছে। আল আকসা প্রাঙ্গনকে তাঁদের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র বলে মনে করেন প্যালেস্টাইনিরা। আনন্দ হোক বা শোক, এই প্রাঙ্গনেই জড়ো হন প্যালেস্টাইনিরা। ১৯২৩-এ এখানেই তৈরি হয়েছিল প্যালেস্টাইনের প্রথম জাদুঘর, ‘ইসলামিক মিউজিয়াম’। এই জাদুঘরে বিরল প্রত্নতাত্ত্বিক ও শৈল্পিক নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে কোরানের কিছু বিরল পাণ্ডুলিপিও।
আল আকসার দ্বন্দ্বের ইতিহাস
১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের সময়, আল আকসা প্রাঙ্গন দখল করেছিল ইজরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের বাকি অংশ এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে আল আকসা প্রাঙ্গনকেও যুক্ত করেছিল তারা। তবে ইজরায়েলিদের এই পদক্ষেপকে স্বীকৃতি দেয়নি আন্তর্জাতিক মহল। তার আগে আল আকসা প্রাঙ্গন ছিল জর্ডন রাজবংশের হাতে। এখনও পূর্ব জেরুজালেম ইজরায়েলের দখলে থাকলেও, আল-আকসা বা টেম্পল মাউন্ট এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করে জর্ডন-প্যালেস্টাইনের এক ওয়াকফ সংস্থা।
Israeli forces detained Palestinian women protesting against the settlers who forced their way into the Al Aqsa Mosque complex in occupied East Jerusalem to celebrate the Jewish holiday of Sukkot pic.twitter.com/RR6y0ciefD
— TRT World (@trtworld) October 2, 2023
তবে এই মসজিদ সংক্রান্ত বিরোধ বারবরই ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ঠিক হয়েছিল আল-আকসায় মসজিদে অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারবে না। আর ইহুদিদের প্রার্থনা করতে পারবে পশ্চিমী প্রাচীরে। এখনও পর্যন্ত এই ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রাখার বিষয়েই সম্মত হয়েছে মুসলিম ও ইহুদিরা। তবে, আরবদের অভিযোগ কার্যক্ষেত্রে তা করে না ইজরায়েলি সরকার। বরং আল আকসা মসজিদে তাদের প্রবেশ অনেকটাই সীমিত করেছে ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
১৯৯৬ সালে, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণের কাছে ইহুদিদের প্রবেশের জন্য একটি নতুন সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। প্যালেস্টাইনিরা অভিযোগ করেছিল, এর ফলে পবিত্র স্থানটি অপবিত্র হয়েছে। এর ফলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। তিন দিনে ৮০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
On April 5th, Israel unleashed its militias who storm Al Aqsa Mosque and brutally attack Muslim night worshipers of Ramadan, injuring dozens and arresting many others.
In the holy month, in the third most important mosque, on women.
Free Palestine 🇵🇸pic.twitter.com/xQUpNDK1IS
— 𝗣𝗮𝗻𝘁𝗵𝗲𝗿 (@MadridPanther) October 7, 2023
২০০০-এ, ইজরায়েলে তৎকালীন বিরোধী দলনেতা এরিয়েল শ্যারন, ইসরায়েলি সাংসদদের একটি দলকে নিয়ে টেম্পল মাউন্ট বা আল-হারাম আল-শরিফ কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন। প্যালেস্টাইনিরা প্রতিবাদ করেছিল। ফের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যা আল-আকসা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত।
These mother and sister wanted to pray only and soldiers told them to leave and they can’t pray at Al Aqsa Mosque and yet Jewish people were allowed to enter.
How dare you stop them to Pray to their God! ~Have some Mercy#IStandWithPalestine #FreePalastine #IsraelPalestineWar pic.twitter.com/r7JEhn2QOd
— Fazal.Ellahi (@Fazlance) October 9, 2023
২০২১-এ আল আকসা নিয়ে ১০ দিনব্যাপী সংঘর্ষ চলেছিল হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে। ২০০ জনেরও বেশি প্যালেস্টাইনি নাগরিক এবং ১০ জন ইজরাইলি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে, রমজান মাসের সময়ও আল আকসায় নামাজ পড়তে চাওয়া প্যালেস্টাইনিদের উপর ইজরায়েলি পুলিশের দমন-পীড়নের খবর পাওয়া গিয়েছিল। ৩৫০ জনেরও বেশি প্যালেস্টাইনিকে গ্রেফতার করেছিল ইজরায়লি পুলিশ। আল আকসা প্রাঙ্গন খালি করতে পুলিশ রাবার বুলেট এবং স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করেছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ইজরায়েলি পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল প্যালেস্টাইনি নাগরিকরা।
আসলে, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গনে সামান্য কোনও ঘটনাই বড় সংঘর্ষের রূপ নিতে পারে। গত এক দশকে, এই এলাকাতেই সমস্ত বড় মাপের প্যালেস্টাইনি বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। এবারও হামাস তাদের অভিযানের নাম দিয়েছে, ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’।
