চোখের সামনে চার মৃত্যু, ব্রাউন সুগার, পাতা, সিরিঞ্জ হাতে কী সিদ্ধান্ত নেন অনিন্দ?
Anindya Chatterjee: অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন, তবে গুগুল করে কিংবা তাঁর পরিচয় পত্রে খোঁজ করলে ২৩ জানুয়ারি দেখাবে না। তবে কীসের জন্মদিন অভিনেতার? এটা তাঁর নতুন জীবন। কীভাবে? সবটাই জানালেন নিজে।
২৩ জানুয়ারি, অভিনেতা অনিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন, তবে গুগুল করে কিংবা তাঁর পরিচয় পত্রে খোঁজ করলে ২৩ জানুয়ারি দেখাবে না। তবে কীসের জন্মদিন অভিনেতার? এটা তাঁর নতুন জীবন। কীভাবে? সবটাই জানালেন নিজে। ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা তিনি। যদিও বড়পর্দা থেকে ওটিটি, দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি। তবে জীবনের কঠিন সময় আজও ভোলেননি অভিনেতা। যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ তিনি অন্ধকার থেকে ফিরে এসে নতুন করে কেরিয়ার তৈরি করেছেন, জন্মদিনে সেই স্মৃতিতে আরও একবার ফিরলেন অভিনেতা। সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, “আমার জন্মদিন । এই জন্মদিনটাই আমার সবচেয়ে কাছের । কেন ?? কারণ কালকে আমার নেশামুক্তির ১৭ বছর । ২৯শে ডিসেম্বর তো বায়োলজিক্যাল বার্থডে। কিন্ত কালকের দিনটা আমার কাছে অনেক অনেক বেশি স্পেশাল ।”
তিনি আরও লেখেন, “আমার কাছে এখনও জলের মতো স্পষ্ট ২০০৮ সালে আজকের এই দিনটা । আর দেখতে পাই বলেই হয়তো আজকে এটা লিখতে পারছি । ব্যাঙ্কসাল কোর্টে হাজিরা দিয়ে আমাকে রিহ্যাবে ফিরতেই হতো । ৯টার বনগাঁ লোকাল আর আমাকে যেতে হত হাবড়া । সঙ্গে ছিল শেষবারের মতন নেশা করবো বলে একটু ব্রাউন সুগার, পাতি বাংলায় কয়েকটা পাতা আর একটা সিরিঞ্জ, একটু তুলো একটা চামচ । হাবড়া স্টেশনে নেমে একটু এগোলেই সেই রিহ্যাব যেখান থেকে আমার ভাল থাকার লড়াই শুরু হয়েছিল । তার আগে প্রায় ২৮ বা ২৯ টা ডিটক্স আর রিহ্যাব হয়ে গেছে । যেদিন ছাড়া পেতাম সেদিনকেই রিলাপস, এরকম একটা প্যাটার্ন ছিল । আমাদের ভাষায়ে আমরা বলি ক্রনিক রিলাপসী । ৬/৭ বছর ধরে অনবরত ঘুরতে থাকা একটা বৃত্ত । নয় বাইরে নেশা করছি নয় তালা চাবির ভিতরে ভাল আছি । তালা চাবির বাইরে বেরোলেই আবার নেশা । না নিজে বিশ্বাস করতাম যে আমি কোনওদিন ভাল হতে পারবো, না আমাকে কেউ বিশ্বাস করতো যে আমি কোনওদিন নেশা ছেড়ে দেবো । উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের আর কতই বা ক্ষমতা ? বাড়ির সব কিছুই মোটামুটি ততদিনে প্রায় শেষ । সে মায়ের সোনার গয়না হোক বা বাবার সঞ্চয় । এরপরে বাইরের লটরবহর তো আছেই । লোহা, অ্যালুমিনিয়াম,কাঁসার জিনিস তখন আমার কাছে সোনার মতনই দামী । যে কোনও গাড়ির লক খুলতে লাগতো ঠিক তিন মিনিট । একটা নোকিয়ার মোবাইল মানে ক্যাশ ২/৩ হাজার । সেটাই অনেক তখন আমার কাছে । এরকম একটা সময় আমি আমি বুঝতে পারছিলাম এভাবে যদি চলতে থাকে আমি ২৮ বছর অবধিও টানতে পারবো না আর চোখের সামনে চারটে ইউজিং পার্টনারকে পরপর মরতে দেখে একটু ভয়ও পেয়েছিলাম । এতটাই বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলাম যে আমার সেই রিহ্যাবে যাওয়া আর সেখানে আবার কয়েকমাস চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আরও কয়েকদিন টানতে পারতাম । কিন্তু পারিনি।”
তাঁর কথায়, “আর এই উপলব্ধিটাই আমাকে একটু হলেও সাহস যুগিয়ে ছিল। এভাবেই আমার ভাল থাকার শুরু । শুরুটা সত্যি কঠিন ছিল । না কেউ বিশ্বাস করতো, না নিজে বিশ্বাস করতাম যে নেশা করা ছেড়ে দেবো । জীবনের ধ্যানজ্ঞান ভালোবাসা তো ছিল একটাই, নেশা। ওটাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আর নেশা আমাকে মারতে চেয়েছিল । আমি সেদিন নেশার কাছে হেরে গেছিলাম । আর হেরে গেছিলাম বলেই হয়ত আজকে আমি জিতছি । আজকে যখন রাস্তায় লোকে সেলফি তুলতে চায় , অটোগ্রাফ চায় , ভালবাসা দেয় তখন আমি নিজেকে দেখি আর পুরোটাই কেমন স্বপ্নের মতন লাগে । আদৌ এটা সত্যি হচ্ছে তো ? কোথায় সেই ছেলেটা আর কোথায় আজকের আমি । হয়তো আরও কিছু করতে পারতাম । হয়তো আরও একটু জীবনটা গোছাতে পারতাম , পারিনি কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনও খারাপ লাগা নেই । যা আছে , যে টুকু সম্মান আর ভালবাসা আমাকে সমাজ ফিরিয়ে দিয়েছে আমি সেটা নিয়েই খুশি । বাকিরা এগোক না, ক্ষতি কি আমার শুরু তো অনেক নিচ থেকে আর আমার লড়াইটাও একটু হলেও আলাদা, একটু হলেও কঠিন । আমার লড়াই সেই বাঁদরটার সঙ্গে যে আজকেও আমার মধ্যে আছে । যাকে আমাকে প্রতিনিয়ত বশে রাখতে হয় । তার জন্যে যদি দামী গাড়ি বাড়ি একটু দেরি হয় , হবে । নাহলেও আমার কোনো আপত্তি নেই । মা চলে যাওয়ার আগে আমার নেশামুক্ত দেখে গেছে কিন্ত বাবা চলে যাওয়ার আগে আমার ঘুরে দাড়ানো প্রত্যক্ষ করে গেছে । গর্ব করে সবাইকে বলতো আমি অনিন্দ্যর বাবা । বোনের ও গর্ব আমি । আর কি চাই ?”
এই লড়াইয়ের বাস্তব ছবিটা আরও একবার সকলের সামনে তুলে ধরলেন অভিনেতা। বোঝালেন, চাইলে সকলে পারেন। শুধু লড়াইটা নিজের সঙ্গে নিজের। তাই আরও বহু মানুষকে এই অন্ধকার থেকে ফেরাতে কলম ধরা তাঁর। লিখলেন, “এভাবেই এক একটা দিনের লড়াই আমার চলতে থাকুক । অভিনেতা বা সেলিব্রিটি অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় তো আমি ফেসবুকে , শুটের লোকেশনে বা বাড়ির বাইরে বেরোলে। বাড়িতে আয়নার সামনে এখনও আমি সেই বাঁদর ছেলেটাই । ওকে দমিয়ে রাখতে পারলেই আমি বাকিটা সামলে নেব । আমার উপলব্ধ ঈশ্বর আমাকে এভাবেই আমাকে আগলে রাখুক । আর ভালো থাকুক পৃথিবী । আমার কাছের মানুষগুলো । আমার বন্ধুরা । আর যারা এখনও নেশার কবল থেকে বেরোনোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে । এটাই প্রার্থনা ।”