‘আমি মুসলিম, হিন্দু ভাই-বোনের থাকার সমস্যা হলে সাহায্য করব’, বলছেন শোয়েব কবীর
যেখানে ধর্মের ব্যাপার আছে, সেখানে অশান্তি বাড়তে বেশি সময় লাগে না। আজকের দিনে মানুষ বিভিন্ন ব্যাপারে সেনসিটিভ। এই যে ওয়াকফ সংক্রান্ত জটিলতা, এটা আগামী দিনে অন্য রূপ নিতে পারে। আজকে একটা পরিবারে একজন মারা গেলেন। এখানে শুধু একজনের প্রাণ গেল না। পুরো পরিবারের মধ্যে বিষ ঢুকে গেল। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তার রেশ থাকবে। মানে উন্নতির পরিবর্তে বিষয়টা অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল।

শোয়েব কবীর বাংলা ছবির অভিনেতা। পাশাপাশি রাজনীতিতে পদ সামলাচ্ছেন তিনি। মুর্শিদাবাদে তাঁর শিকড়। TV9 বাংলাকে অভিনেতা জানালেন তাঁর মনের কথা। অভিনেতার কথায়,
”আমি মুর্শিদাবাদের সালার নামে একটা জায়গায় বড় হয়েছি। ওখানে আমার দেশের বাড়ির। সদর শহর বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছি আমি। ওই স্কুল ব্রিটিশ আমলে তৈরি। জীবনের অনেকটা সময়, মানে দশ বছর ওখানেই থেকেছি। পরবর্তীকালে তৃণমূল কংগ্রেস দলের একটা পদের দায়িত্ব নিয়েছি। তাই এখনও যাওয়া-আসা লেগেই থাকে। মুর্শিদাবাদের সঙ্গে সম্পর্কটা কতটা নিবিড়, এটা বলে বোঝানো মুশকিল। শুধু আমার শিকড় ওখানে বলে নয়, রাজনীতির কারণেও জায়গাটার উপর দায়িত্ব আছে। মুর্শিদাবাদ অদ্ভুত একটা জেলা। ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্ব কম নয়। এই জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, কত ধরনের সংস্কৃতি মিশেছে। এই জেলাটা খুব প্রাচীন জেলা।
২০২২ সালে আমি ‘অপরাজিত’ ছবিতে কাজ করেছিলাম। সেখানে সায়নী ঘোষের সঙ্গে আমার আলাপ। আমার তখন একটা সাহায্যের দরকার ছিল। ওঁকে যোগাযোগ করেছিলাম। তখন সায়নীদিই প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আমি রাজনীতিতে আসছি না। ওঁর বক্তব্য ছিল, একজন শিক্ষিত ছেলে যদি রাজনীতিতে আসে এবং নিজের কাজের ছাপ রাখতে পারে, তা হলে সেটা উভয়পক্ষের জন্যই ভালো হবে। প্রথমে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তারপর আগ্রহ পাই। প্রথমে আমাকে স্টেট কমিটিতে আনা হয়। এখন আমি মুর্শিদাবাদে ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ুথ, টিএমসি। আমরা অনেক সময়ে একটা এসি রুমে বসে থেকে শহরের বিভিন্ন জিনিসপত্র সম্পর্কে মত তৈরি করি। আমরা ঠিক বুঝতে পারি না, গ্রামের মানুষ, ছোট শহরের মানুষদের কী সমস্যা। ছোট-ছোট জিনিস নিয়ে ওঁরা কতটা বাধা পান। আমি একটা পঞ্চায়েতের ভোটে যোগ দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করি। সাংসদ হয়ে ইউসুফ পাঠান যখন এলেন, তখনও অনেকটা সময় কাটিয়েছি। এখন আমি রাজনীতিতে তুলনায় পোক্ত। মুর্শিদাবাদকে এত কাছ থেকে দেখেছি চিরকাল। এলাহাবাদ শহরের সঙ্গে মিল পাই। অনেক জ্ঞানী মানুষ এখানে আছেন। শহরটা সম্পর্কে গর্ব অনুভব করার কারণ তো আছেই।
মুর্শিদাবাদের উপর বিভিন্ন ঘটনা আঘাত এনেছে অতীতে। তবে এরকম প্রথমবার হচ্ছে, যখন আমি দেখছি, ধর্ম একটা ইস্যু। আমি কোনওদিন দেখিনি হিন্দুভাইরা মুসলিমভাইদের সঙ্গে লড়াই করছেন। যেখানে এই ঘটনা ঘটেছে, সামশেরগঞ্জ, ওখানে আমার নিজের দাদু ডাক্তার ছিলেন। আমরা যে বাড়িটায় থাকতাম, সেখানে নীচে একটা জুতোর দোকান ছিল। যখন পয়লা বৈশাখের মরসুম আসত, বা কোনও বড় পুজো হতো তখন আমার দাদুকে আমন্ত্রণ জানাতেন হিন্দু প্রতিবেশীরা। আমাদের ঈদে প্রতিবার আমার দাদুর বন্ধু সব সময়ে আসতেন। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড পাপাই ঘোষ, তিনি বহরমপুরে থাকেন। বরাবর একটা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক থেকেছে। তাই ধর্মের নামে এরকম রাজনীতি হবে, সেটা কোনওভাবেই কাম্য নয়। একটা ছোট কথা আমার মনে হয়, আজকের দিনে ওই জায়গাগুলোর দায়িত্ব যাঁদের উপর আছে, সুযোগ্য নেতৃত্ব যাঁরা আছেন, সেটা রাজনীতির কেউ হতে পারেন বা প্রশাসনের কেউ হতে পারেন, সেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। শাসক দল এবং বিরোধী দল, দু’জনের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। এখন মানবিকতার দিক থেকে পুরোটা দেখা উচিত। এই অশান্তির জেরে যদি একটা প্রাণও যায়, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমিত শাহ বা নওশাদ সিদ্দিকী কেউই খুশি হবেন না। ওখানে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে, বা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা এখনই দায়িত্বশীল লোকদের কড়া পদক্ষেপের মাধ্যমে সামাল দিতে হবে। যেখানে ধর্মের ব্যাপার আছে, সেখানে অশান্তি বাড়তে বেশি সময় লাগে না। আজকের দিনে মানুষ বিভিন্ন ব্যাপারে সেনসিটিভ। এই যে ওয়াকফ সংক্রান্ত জটিলতা, এটা আগামী দিনে অন্য রূপ নিতে পারে। আজকে একটা পরিবারে একজন মারা গেলেন। এখানে শুধু একজনের প্রাণ গেল না। পুরো পরিবারের মধ্যে বিষ ঢুকে গেল। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তার রেশ থাকবে। মানে উন্নতির পরিবর্তে বিষয়টা অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। মানবজাতির ক্ষেত্রে এটা তো কাম্য নয়। তাই দুই ধর্মের মানুষকেই শান্ত হতে হবে। নিজের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। শেষে বলি, আমি একজন মুসলিম। যদি কোনও হিন্দু ভাই বা বোনের থাকার সমস্যা হয়, বা মুসলিম ভাই-বোনের থাকার সমস্যা হয়, আমাকে যোগাযোগ করতে পারেন। বহরমপুরে আমার একটা তিনতলা বাড়ি আছে। আমার ছোট্ট ক্ষমতার ভিতরে, আমি সব রকমভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব।”
