বাংলা ছবির প্রচারের ধারা বদলকে কীভাবে দেখেন নেপথ্যের কারিগররা?

গোড়ার কথা সেই একই। ক্রিয়েটিভি এবং কমিউনিকেশন। অন্তত এমনটাই মনে করেন ধারা বদলের নেপথ্যের কারিগররা।

বাংলা ছবির প্রচারের ধারা বদলকে কীভাবে দেখেন নেপথ্যের কারিগররা?
'গুমনামী'তে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, 'সোয়েটার'-এ ইশা সাহা এবং 'অব্যক্ত'-তে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 19, 2020 | 10:11 AM

মাঝ আকাশে বিমানের মধ্যে মিউজিক লঞ্চ দেখেছেন? কোনও মেট্রো স্টেশনে প্রেস কনফারেন্স? অথবা প্রবল গরমের সময় মোবাইল স্ক্রল করলেই আপনার প্রিয় নায়িকার উল বোনার ভিডিও?

হ্যাঁ, এই সব কিছুই আপনি দেখেছেন। দেখেছেন বাংলা ছবির (Tollywood) দর্শক। ছবির প্রোমোশনের (film promotion) জন্যই এ হেন আয়োজন করেছিলেন নির্মাতারা। আর অদ্ভুত কান্ডকারখানা দেখেই প্রাথমিক ভাবে ছবিটির প্রতি উৎসাহী হয়েছেন দর্শক। ছবি ভাল লেগেছে নাকি খারাপ, সে বিচারের ভার তো পরের। অন্তত ছবিটি সম্পর্কে দর্শকের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলতেই আলাদা করে তৈরি হয় প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজি। যুগের চাহিদা অনুযায়ী প্রচারের ধরন বদলে ফেলেছেন দায়িত্বে থাকা কুশীলবরা। ছবি মুক্তির আগে শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকার সাক্ষাৎকার নয়। বরং ছবিকে কেন্দ্র করে বিবিধ চমক তৈরি করেন তাঁরা। ছবির গল্প, দর্শকের চাহিদা এবং পরিবেশন মাধ্যমের কথা মাথায় রেখেই এই পরিকল্পনা করেন ক্যামেরার আড়ালে থাকা কিছু পেশাদার। গত কয়েক বছরে যাঁরা এই বদলের সাক্ষী।

আরও পড়ুন, প্রত্যেক ছবির গল্প আলাদা, তাহলে প্রোমোশন এক হবে কেন?

যে কোনও ছবির প্রচার পরিকল্পনার সময় কোন কোন বিষয় নিয়ে আলাদা করে ভাবা হয়? কী পদ্ধতিতে তৈরি হয় প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজি? এই প্রসঙ্গে প্রযোজনা সংস্থা ‘এসভিএফ’-এর পাবলিক রিলেশনের দায়িত্বে থাকা অহনা কাঞ্জিলাল বললেন, “আগে যেটা হত, আমরা অনগ্রাউন্ডে অনেক বেশি ফোকাস করতাম। দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার জন্য আর্টিস্টদের অনগ্রাউন্ড অ্যাক্টিভিটির উপর জোর দিতাম। মিউজিক লঞ্চ, ট্রেলার লঞ্চ, বিভিন্ন রকমের প্রেস অ্যাক্টিভেশন সব অনগ্রাউন্ড হত। শুট এখনও আমরা করছি। কিন্তু ডিজিটালে এখন অনেক বেশি ফোকাস করেছি।”

আরও পড়ুন, অভিষেক বচ্চনের কোন কোন সিক্রেট শেয়ার করল ইনায়ৎ?

অহনা জানালেন, তাঁদের প্রযোজনা সংস্থার তরফে ২০১৯-এ সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘গুমনামী’ মুক্তির আগে নেতাজীর মূর্তি উন্মোচন করা হয়েছিল। ২০১৩-এ কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চাঁদের পাহাড়’ মুক্তির পরে পাবলিক স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে নির্দিষ্ট শো-এ টিকিট না কেটেই ছবিটি দেখতে পেরেছিলেন দর্শক। কিন্তু এখন প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাঁর কথায়, “ওয়েব ব্রাউজিং এখন ৭০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অডিয়েন্স আগের থেকে অনেক বেশি। ফলে কীভাবে কনটেন্ট প্রোমোট করব, সেটা নিয়ে এখন অনেক বেশি সতর্ক আমরা। প্যানডেমিকের বিষয়টাও সকলের মাথায় আছে। ফলে আমরা কী বলছি, কী করছি সেটার বিষয়ে অনেক সতর্ক থাকতে হচ্ছে। ডিজিটাল মিডিয়াতেই এখন বেশি ফোকাস করছি। ৩০ শতাংশ অফলাইন মিডিয়ার কাজ করছি।”

আরও পড়ুন, বউ বলেছে, এতদিন তো আমি জানতামই, এবার গোটা পৃথিবী জানে ‘মকবুল’ কত অনুগত: সাজি চৌধুরি

ডিজিটাল মিডিয়া যে ছবির প্রচারের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ তা এক কথায় মেনে নিলেন প্রযোজনা সংস্থা ‘পিএসএস এন্টারটেনমেন্ট’-এর কর্ণধার অনিমেষ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবির প্রচারের পেশাদার হিসেবে কেরিয়ার শুরু করে এখন তিনি প্রযোজক। তাঁর সংস্থা একাধারে ছবির প্রচার এবং প্রযোজনার কাজ করে। তিনি বললেন, “ছবির পাবলিসিটির ক্ষেত্রে আগে প্রথাগত ধারণা ছিল, একটা প্রেস কনফারেন্স করে দিলে বা একটা জায়গায় কলাকুশলীরা এলে সেখানে মিডিয়াকে ডাকলে মিডিয়া কভার করলেই পাবলিসিটি। কিন্তু এখন যেটা হয়েছে, দর্শকের কাছে পাবলিসিটির সংজ্ঞা এবং মাধ্যম, দুটোই বদলে যাচ্ছে। এখন আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল মিডিয়া। শুধু প্রিন্ট বা ইলেকট্রমিক মিডিয়া নয়।”

animesh-ahana-preetam

যাঁরা প্রতিনিয়ত নতুন ভাবনা ভাবছেন, অনিমেষ, অহনা এবং প্রীতম।

২০১৪-এ মুক্তি পেয়েছিল সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘চতুষ্কোণ’। সেই ছবির প্রচারের দায়িত্বে থাকা ‘পিএসএস এন্টারটেনমেন্ট’ সে সময় গুগল হ্যাংআউটকে কাজে লাগিয়েছিল বলে দাবি করলেন অনিমেষ। যা নাকি সেই সময় টলিউডে কেউ করেননি। তিনি মনে করেন, “সাবজেক্টের সঙ্গে অডিয়েন্সকে যুক্ত করা আমাদের চ্যালেঞ্জ। সেটা ভেবেই প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজি প্ল্যান করি আমরা। এখন অডিয়েন্সের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডাইভার্ট করার হাজারটা অপশন রয়েছে। সেই ডাইভার্সনটা বন্ধ করে কীভাবে কোন অ্যাঙ্গেলে স্টোরি করলে ছবিটার স্বার্থে ভাল হবে, সেই চেষ্টা করি। আসলে প্রচারের সাফল্য এখন পুরোটাই নির্ভর করে ক্রিয়েটিভির উপর।”

আরও পড়ুন, “অতিমারির আবহে ভার্চুয়াল প্রোমোশন সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং”

সোশ্যাল মিডিয়া কেন্দ্রিক প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজি তৈরি করার পক্ষেই মত দিলেন পিআর এজেন্সি ‘অ্যাডভার্ব’-এর প্রীতম চট্টোপাধ্যায়। তবে বেশ কয়েক বছর টলিউডে কাজ করার পর তাঁর মনে হয়েছে, বাংলা ছবির প্রচার নিয়ে আরও পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। “যে কোনও প্রজেক্টকে স্ক্রিপ্ট লেভেল থেকেই খুব সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে অ্যাডভার্ব। কিন্তু বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাব সব সময়ই ছিল। যখন আমরা কাজ করতে শুরু করলাম, তখন বুঝিনি। পরে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি। হিন্দি বা দক্ষিণী ছবির ক্ষেত্রে একটা প্রজেক্টের সঙ্গে একটা সমান্তরাল স্টোরি লাইন তৈরি করে প্রোমোশন হচ্ছে। ধরুন, ‘দঙ্গল’-এর বডি ট্রান্সফরমেশন, ‘গজনি’-র হেয়ারস্টাইল, ‘কেদারনাথ’-এ সারা আলি খানের অ্যাফেয়ার। আমরা মানে টলিউড এখনও এই রাস্তায় হাঁটতে পারল না। হয়তো বাজেটের সমস্যা, অথবা প্রযোজক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান না।”

আরও পড়ুন, নেপথ্যের কারিগররা কি আড়ালেই থাকবেন? হেয়ার স্টাইলিস্টের মৃত্যুতে ফের উঠল প্রশ্ন

এক কথায় ছবির প্রচারের ধারা বদলে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। তবে এই পরিবর্তন হঠাৎ নয় বলেই মনে করেব অহনা। তাঁর কথায়, “এখন যতটা দর্শকের হাতে মোবাইলের মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়া যায় ডিজিটালি, সেই চেষ্টা করছি। কিন্তু এই পরিবর্তন প্যানডামিকের পরে আসেনি। এটা ধীরে ধীরে হচ্ছিলই। প্যানডেমিকের পরের কয়েক মাসে বিজ্ঞাপনী প্রচার বা ডিজিটাল প্রচারে দর্শক অনেক বেশি ইনভলভ হয়েছে। মানুষের অভ্যেস বদলেছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে মানুষ অনেক বেশি কানেক্ট করতে পারছে। সেই অনুযায়ী আমাদের প্রোমোশন স্ট্র্যাটেজিও বদলে গিয়েছে।”

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবির প্রোমোশনের মাধ্যম বদলেছে ঠিকই। বদলেছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গোড়ার কথা সেই একই। ক্রিয়েটিভি এবং কমিউনিকেশন। অন্তত এমনটাই মনে করেন ধারা বদলের নেপথ্যের কারিগররা।