নেপথ্যের কারিগররা কি আড়ালেই থাকবেন? হেয়ার স্টাইলিস্টের মৃত্যুতে ফের উঠল প্রশ্ন
দর্শকের মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিবর্তন কোথাও শুরু হওয়া প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রির ভিতর থেকে। এমনটাই মনে করছেন বিভিন্ন শিল্পী।
‘নায়িকার (Actress) মেকআপটা ভারী সুন্দর। এত অল্প বয়সে ৬০ বছরের চরিত্র করছেন, বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু।’
অথবা ‘চরিত্রের জন্য অভিনেতার (Actor) ঠিক এই লুকটাই প্রয়োজন। এত ভাল উইগ পরানো হয়েছে, মিলে গিয়েছে, তাই না?’
সিনেমা (cinema), সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, নাটক যে কোনও মাধ্যমে দারুণ পারফরম্যান্স দেখার পর এই আলোচনা চলতেই থাকে সিনেপ্রেমীদের মধ্যে। রিভিউতে কখনও-কখনও আলাদা করে মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ার ড্রেসার বা ক্যামেরা পার্সনের প্রশংসা হয় বটে। কিন্তু বড় পরিসরে তাঁরা নেপথ্যেই থেকে যান। ক্যামেরার আড়ালে থেকে কাজ করলেও আসলে তাঁরাই কারিগর। তাঁরা না-থাকলে কিছুই তৈরি হত না। কিন্তু টাইটেল কার্ডে নাম দেখানোর সময় বাদ পড়ে যান নেপথ্যের কারিগরেরা। লাইমলাইট, ক্যামেরার ঝলকানি থেকেও তাঁরা ব্রাত্য। ইন্ডাস্ট্রির বাইরে তাঁদের সাধারণ দর্শক চেনেন না। এমনকি বিপদের দিনে কখনও-কখনও এড়িয়ে যায় ইন্ডাস্ট্রিও।
আরও পড়ুন, অভিষেক বচ্চনের কোন কোন সিক্রেট শেয়ার করল ইনায়ৎ?
এ ঘটনা নতুন নয়। টলিউডের প্রবীণ হেয়ার স্টাইলিস্ট শেখর অধিকারীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কই আরও একবার প্রকাশ্য়ে। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে প্রয়াত হলেন শেখর। এই গুণী শিল্পীকে চেনেন শুধু ইন্ডাস্ট্রির সদস্যরা। এই বিষয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাঁকে কি আমরা আদৌ মনে রাখব?’
ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা সুদীপ্তার। এতগুলো বছর ধরে একই জিনিস তিনি দেখেছেন। এর কোনও পরিবর্তন নেই। তাই নিজের মতো করে সরব হয়েছেন। সুদীপ্তা লিখেছেন, ‘কলাকুশলীদের এমনিও মনে রাখে না কেউ। সিনেমার শেষে কলাকুশলীদের নাম দেখার ভদ্রতা আমাদের দেশে প্রায় কেউই দেখান না। সিনেমা হলগুলোও আলো জ্বালিয়ে দেয় সিনেমা শেষ হলেই। যাতে তাড়াতাড়ি প্রেক্ষাগৃহ খালি হলে পরের শো’টা শুরু করা যায় আর কি। টিভিতে তো আজকাল পরিচালক, অভিনেতা, কলাকুশলী কারও নামই দেখানো হয় না। ওই… একটু সময় বাঁচে আর কি। ওটিটি-তে আবার টাইটেল ‘স্কিপ’-ও করা যায়। আমাদের সময়ের অনেক দাম তো। কৃতজ্ঞতা জানানোরও মোটে সময় নেই আমাদের হাতে। শেখরদাকে, শেখরদাদের মনে রাখার সময় পাবো কি আমরা?’
ইন্ডাস্ট্রির অন্দরের পরিস্থিতি ঠিক কেমন? প্রশ্ন ছোড়া হল হেয়ার স্টাইলিস্ট হেনা মুন্সিকে। ২৬ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। হেনা তখন সবেমাত্র শেখরের সৎকার সেরে ফিরছেন। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা শেষে হেনা বললেন, “শেখরদার রঙিন জীবন। শেষ দিকটা কষ্টকর গিয়েছে। নিজের কেউ ছিলেন না। ইন্ডাস্ট্রির লোকেরাই তাঁর আত্মীয়। মিস শেফালির কাছে মানুষ। এত বছরে এত পরিচয়, এত অভিজ্ঞতা। এত বড়-বড় আর্টিস্টের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। আজ কেউ নেই। অঞ্জনা বসু এসেছিলেন। বাকি সবাই শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। কেউ আসেননি।”
নাম না-দেখানো বা দর্শকের না-দেখার অভ্যেস নিয়ে এত বছর পর আর কোনও অনুযোগ নেই হেনার। বরং বললেন, “খুব তাড়াতাড়ি মানুষ মানুষকে ভুলে যাচ্ছে। প্রত্যেকদিন প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে। যে চোখের সামনে থাকছে, শুধুমাত্র তাকেই মনে রাখছে। যে থাকছে না, তাকে ভুলে যাচ্ছে। গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে ‘সিনিয়র’ শব্দটার। সিনিয়র মানে আর কাজটা ভাল ভাবে করতে পারবে না, এমন মনে করছেন অনেকে। সামনে দেখা হলে হাত জোড় করে নমস্কার করছেন, এইটুকুই।” হেনার সংযোজন, “কাজ দেওয়াটা যেন দয়া করে। ঘোড়া দৌড়চ্ছে যতদিন, ততদিন দাম। আর আমাদের নাম কোথাও যায় না। সিনেমাতে থাকে। কিন্তু নিজের সিনেমার কাজ দেখতে গেলে দেখি, যখন নাম দেখানো হচ্ছে, সামনে থেকে সবাই উঠে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। পর্দাও নেমে যায়। ইন্ডান্ট্রির বাইরে আমাদের কেউ চেনেন না।”
আরও পড়ুন, বউ বলেছে, এতদিন তো আমি জানতামই, এবার গোটা পৃথিবী জানে ‘মকবুল’ কত অনুগত: সাজি চৌধুরি
ইন্ডাস্ট্রির পরিচিত মেকআপ আর্টিস্ট লোকনাথ দাস। ১০ বছর ধরে কাজ করে তাঁরও অভিজ্ঞতা একই। “আমাদের যে পরিচিতি পাওয়া উচিত, সেটা আমরা সেভাবে পাই না। এখন তো সিরিয়ালে নাম দেখানোই হয় না। সিনেমায় নাম যায়। কিন্তু সে নাম কেউ দেখেন না। নতুন কিছু ছবিতে দেখছি মেকিং দেখানো হয়। সেখান থেকে লোকে চিনতে পারেন অনেক সময়। শুধু মেকআপ আর্টিস্ট বা হেয়ার ড্রেসার নন, ক্যামেরা টেকনিশিয়ন বা অনেকেই থাকেন, যাঁদের কেউ চেনেন না। শেখর মামাকেই দেখুন। এত সিনিয়র ছিলেন, কিন্তু বুঝতে দিতেন না। বন্ধুর মতো মিশতেন।,” বললেন লোকনাথ।
আরও পড়ুন, প্রত্যেক ছবির গল্প আলাদা, তাহলে প্রোমোশন এক হবে কেন?
টলিউডে ১০ বছর ধরে হেয়ার ড্রেসার হিসেবে কাজ করছেন নীতা মল্লিক। তাঁর কাছে শেখর ছিলেন অভিভাবকের মতো। নেপথ্যের কারিগরদের পরিচিতি পাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “আমরা তো জোর করে বলতে পারব না, আমরা এই কাজটা করেছি, আমাদের নাম দিন। এটা তো নির্মাতাদেরই উচিত।”
হয়তো ঠিক বলছেন নীতা। হয়তো ঠিক লিখেছেন সুদীপ্তাও। কিন্তু এর সমাধান সূত্র টলিউডের কাছে এখনও অধরা। হয়তো টলিউডও সমাধান দিতে পারবে না। দর্শকের মানসিকতার পরিবর্তনও প্রয়োজন। কিন্তু সেই পরিবর্তন কোথাও শুরু হওয়া প্রয়োজন ইন্ডাস্ট্রির ভিতর থেকে। এমনটাই মনে করছেন বিভিন্ন শিল্পী।