TV9 Exclusive: রানাঘাটের প্রাথমিক শিক্ষক থেকে গোল্ডেন গ্লোবালের মঞ্চ, তুহিনের কাহিনি মনে রাখবে বাংলা?
Dostojee Movie: আদতে স্টিল ছবি তোলা 'মাস্টারমশাই' নাকি শুট করে ফেললেন আস্ত একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি! আর সেই ছবি 'দোস্তজী'র (Dostojee) দৌলতেই 'সেরা চিত্রগ্রাহক'-এর মনোনয়ন পেয়ে পাড়ি দিলেন সেই সুদূর মালয়েশিয়া, গোল্ডেন গ্লোবালের মঞ্চে! নিজের দেশে সে খবর কতজনই বা জানেন? TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এল চোখে স্বপ্ন, মনে জেদ মাখা এক যুবকের সেই না জানা আখ্যান...
বিহঙ্গী বিশ্বাস
কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দূরে নদিয়ার রানাঘাট। সেই রানাঘাটেরই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক তুহিন বিশ্বাস। কাজ ছাত্র পড়ানো। আর প্যাশন: ছড়িয়ে থাকা একের পর এক ছবি ক্যামেরাবন্দি করা। হঠাৎই জীবনে ‘জাম্প কাট’। আদতে স্টিল ছবি তোলা ‘মাস্টারমশাই’ নাকি শুট করে ফেললেন আস্ত একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি! আর সেই ছবি ‘দোস্তজী’র (Dostojee) দৌলতেই ‘সেরা চিত্রগ্রাহক’-এর মনোনয়ন পেয়ে পাড়ি দিলেন সেই সুদূর মালয়েশিয়া, গোল্ডেন গ্লোবালের মঞ্চে! নিজের দেশে সে খবর কতজনই বা জানেন? TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এল চোখে স্বপ্ন, মনে জেদ মাখা এক যুবকের সেই না জানা আখ্যান…
ছোটবেলাটা কোথায় কেটেছে?
আমি রানাঘাটের ছেলে। সবটাই ওখানে। ওখানেই বড় হওয়া, স্কুল। আর এখন নিজেই এক সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়াই।
আর ক্যামেরার প্রতি প্রেমটা?
সেটা বহুদিনের। স্টিল ফটোগ্রাফি করতাম। হাতে ক্যামেরা, নিজের খুশিমতো ছবি তুলে বেড়াই।
সেখান থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘দোস্তজী’র চিত্রগ্রাহক—শুরুটা কীভাবে?
২০১৬ সালে প্রসূনদার (প্রসূন চট্টোপাধ্যায়, ‘দোস্তজী’র পরিচালক) সঙ্গে আলাপ। তখন যদিও ছবিটা বানানো যাবে কি না, তাই-ই বোঝা যাচ্ছিল না। কোনও প্রযোজক পাওয়া যাচ্ছিল না। ২০১৭ সালে আমরা ঠিক করি ক্রাউড ফান্ডিং একটি ট্রেলার বানাব। সেটার জন্যই আমাকে মূলত ডাকা হয়। কথা ছিল, যখন ছবিটা শুট হবে তখন আমি স্টিল ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করব।
সে কী! স্টিল ছবি তুলতে গিয়ে সিনেমাটোগ্রাফার হয়ে গেলেন কী করে?
(হালকা হাসি) আসলে প্রথম থেকেই আমাদের ছবিটার ক্ষেত্রে বাজেট একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ৬০ দিন আউটডোর শুট ছিল। যে সব সিনেমাটোগ্রাফারকে শুট করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে কেউ-কেউ রাজি হননি। আর যাঁরা রাজি হচ্ছিলেন, এত টাকা চাইছিলেন যে আমাদের কাছে ছিল না।
তারপর?
এরকম একটা অবস্থায় সবার মন খুব খারাপ। একে তো পয়সা নেই, তার মধ্যে এত সব বাধা। হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলা প্রসূনদা আমাকে ফোন করে। আমায় বলে তুই ক্যামেরাটা কর। আমি তো করবই না। কোনও ফিল্ম স্কুল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমি স্কুলে পড়াই, আর হাতে একটা ক্যামেরা আছে, ব্যস। কিন্তু প্রসূনদা নাছোড়বান্দা। অবশেষে আমি রাজি হই। সেখান থেকেই শুরু হয় আমার পড়াশোনা…
প্রাতিষ্ঠানিক? নাকি শিক্ষকের শিক্ষক তিনি নিজেই?
(হাসি) বলতে পারেন নিজেই আর ইউটিউব, সঙ্গে বিভিন্ন সিনেমাটোগ্রাফ্রিক সাইট। যে ছবিগুলো আগে দেখেছি, সেগুলো মিউট করে দেখতে শুরু করলাম। ছবির সংলাপ চললেই সিনেমার শটের থেকেও গল্পের দিকে বেশি নজর চলে যাচ্ছিল আমার। মিউট করতেই সিনেমাটিক মুভমেন্ট, লাইটিং… এ সব কিছুই যেন বুঝতে পারতে থাকলাম আরও ভাল করে।
নিজেকে ‘পথের পাঁচালি’র সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র মনে হচ্ছিল?
(হাসি ও বিনয়) সুব্রত মিত্র ও আমার জার্নিটা হয়তো কিছুটা হলেও এক, কিন্তু ওঁর মতো মানুষের সঙ্গে আমার নাম কোনওভাবেই আসে না। তবে হ্যাঁ, আমার এই সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার ‘লার্নিং প্রসেস’-এ সবচেয়ে বেশি আমি যে ছবিটা দেখেছি, সেটা ‘পথের পাঁচালি’।
কেন? বাঙালির আবেগ?
শুধু তাই-ই নয়, ওই ছবিতেও বাজেট ছিল না, আমাদেরও না। ক্যামেরা করতে ডলি থাকে, জিমি চিপ থাকে, ড্রোন-টোন অনেক কিছু… আমাদের কাছে একটা ট্রাইপড আর ট্রলি ছাড়া আর কিছুই কেনার পয়সা ছিল না। আর পথের পাঁচালি না দেখলে বুঝতেই পারতাম না শুধু ওই ২টো জিনিস ব্যবহার করেই কীভাবে একটা ছবিকে বিশ্বমানের করে তোলা যায়।
একটা ছবি দেশের মানুষকে দেখাতে চারটে বছর লেগে গেল… পয়সার অভাব, কাজ বন্ধ, কখনও বিরক্ত লাগেনি?
না, বিরক্ত হইনি। টাকাপয়সার অভাব ছিল না আমার, যেহেতু একটা চাকরি ছিল ইতিমধ্যেই। ছবি তোলাটা তো প্যাশন। তবে একটা সময় মনে হয়েছে, ‘এটা এবার শেষ হওয়া দরকার, লোককে ছবিটা দেখানো দরকার’।
প্রথম ছবির শুরুটা ‘ক্রাউন্ড ফান্ডিং’ করে, ভবিষ্যতে যদি ক্রাউড ফান্ডিং করে ছবি বানাতে হয়, রাজি হবেন?
না, আমার এই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে হাতেকলমে থেকে একটা কথাই মনে হয়েছে, ক্রাউড ফান্ডিং করে ছবি তৈরি করা যায় না। কারণ আমাদের টিম যে সিনেমা বানাতে চায় তা কখনও চার থেকে পাঁচ কোটির কমে হতে পারে না। আর ক্রাউড ফান্ডিং করে এত টাকা কী করে তোলা যাবে বলতে পারেন? আমাদের এই ছবির প্রি প্রোডাকশনের কাজ ক্রাউড ফান্ডিং করে শুরু হলেও কিন্তু সেই আইডিয়াটা ফ্লপ হয়ে যায়। পরে প্রযোজকেরা যুক্ত হন। কাজ শুরু হয়।
বাইরে এত প্রশংসা, জাপানে অ্যাওয়ার্ড জিতে আট কোটি টাকার ছবি বানানোর প্রস্তাব, টলিউড থেকে ফোন এসেছে?
না, টলিউড থেকে এখনও পর্যন্ত আমায় কেউ ব্যক্তিগতভাবে ফোন করেননি। তবে তা নিয়ে আক্ষেপ নেই। কারণ ছবিটি যেহেতু এখনও মুক্তি পায়নি, তাই অনেকেই ছবিটি দেখেননি। তবে পরিচালক সুমন ঘোষ আমার কাজ দেখে প্রশংসা করেছেন।
আর স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা? তারা জানে তাদের স্যর সারা বিশ্বে অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন?
(হাসি) না, ওরা এখনও বোঝেই না সিনেমাটোগ্রাফি জিনিসটা কী? ওরা ভাবে বিয়েবাড়িতে যারা শুট করতে যায়, তারাও তো ছবি তোলে। ভাবে নায়ক-নায়িকা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই বাকিটা হয়ে যায়।
আগামী পরিকল্পনা কী? ইন্ডাস্ট্রিতে যোগাযোগ বাড়ানোর কাজ শুরু করেছেন?
না করব, তবে ‘দোস্তজী’ মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই করতে পারব না। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করব, তাঁরা কেউই আমার কাজ আগে দেখেননি। আমার মুখের কথা কেনই বা বিশ্বাস করতে যাবেন তাঁরা? ছবিটা মুক্তি পেলে তাঁদের গিয়ে বলতে পারব, এই কাজটা আমি করেছি।
এমন কোনও পরিচালক যার সঙ্গে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে?
(অনেকটা ভেবে) সঞ্জয় লীলা ভন্সালি। তাঁর ছবির যে বিরাট সেট হয়, যে জাঁকজমকের সঙ্গে তিনি গোটা ছবি বানান, সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জীবনে অন্তুত একবার সেই সেটে গিয়ে কাজ করতে চাই আমি।
আগামীর জন্য শুভেচ্ছা, ‘দোস্তজী’র জন্যও…
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।