Indo-Bangladesh Border Fencing: নেই কাঁটাতার, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কতটা জায়গা ‘গড়ের মাঠ’?
Indo-Bangladesh Border Fencing: কী ভাবে, কোন পথেই বা ঘটছে অনুপ্রবেশ? কেনই বা ধরা পড়ছে না সেনার চোখে? এখানেও কি রয়েছে কোনও চোরাগোপ্তা সুড়ঙ্গ?
স্বাধীনতার সময় থেকে শুরু। যখনই অশান্ত হয়েছে বাংলাদেশ, দলে দলে মানুষ ছুটে এসেছে এপারে। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও যে চিত্রটা একই রয়ে গিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময় একঝাঁক হিন্দু চলে এসেছিল এই দেশে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ১৯৭১ তপ্ত সময়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকে বহু অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে ভারতে। ২০১৮-১৯ সাল নাগাদ যখন জ্বলছে মায়ানমার, আরাকান প্রদেশ থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে এসেছেন রোহিঙ্গারা। মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে অনুপ্রবেশ ঘটেছে ভারতে। হালে অগস্ট মাসে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরেই ফের অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। তারপরেই বাড়ে অনুপ্রবেশের ঘটনাও। যা সম্প্রতি সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারির পরে আবার নতুন করে ভাবাচ্ছে সরকারকে।
কিন্তু অনুপ্রবেশের ঘটনা কি কেবল উপরোক্ত ঘটনার সময়ে হয়েছে?
না, বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের সমস্যা, কেবল কোনও ঘটনাকেন্দ্রিক নয়। এই সমস্যা সারা বছরের। গোটা বছরেই সেনাকে ফাঁকি দিয়ে, জঙ্গল-জল পেরিয়ে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় চলে আসে বহু মানুষ।
এই খবরটিও পড়ুন
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বিএসএফ-এর কাঁধে। তাহলে কেন বার বার সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশিরা? কী ভাবে, কোন পথেই বা ঘটছে অনুপ্রবেশ? কেনই বা ধরা পড়ছে না সেনার চোখে? এখানেও কি রয়েছে কোনও চোরাগোপ্তা সুড়ঙ্গ?
এই বিষয়ে সম্প্রতি একটি ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করেছে বিএসএফ। যেখানে ধরা পড়েছে রাতের অন্ধকারে অনুপ্রবেশের ছবি। তবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের কারণ জানতে হলে, আগে বুঝতে হবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ছবিটা কেমন?
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যতটা সীমান্ত এলাকা রয়েছে, তার অনেকটাই পড়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে। এই সব সীমান্ত এলাকাকে সীমান্ত রক্ষা বাহিনী আবার বেশ কিছু ফ্রন্টিয়ারে ভাগ করে নিয়েছে, নজরদারির সুবিধার জন্য।
পশ্চিমবঙ্গে মূলত রয়েছে উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার, দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ার এবং খানিকটা অংশ পড়ে গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের আওতায়। উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের মধ্যে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহারের একাংশ, দক্ষিণ দিনাজপুর এলাকা পড়ে। দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের মধ্যে পড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদার কিছু অংশ। গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের আওতায় পড়ে কোচবিহারের কিছু অংশ।
কোথা দিয়ে কী ভাবে ঘটে অনুপ্রবেশ?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুপ্রবেশের একটা বড় কারণ হল বিশাল অংশের অরক্ষিত সীমান্ত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও, অনেকটা বড় অংশেই নেই কোনও বেড়াজাল। যেখান দিয়ে অনায়াসে রাতের অন্ধকারে ঘটে অনুপ্রবেশের ঘটনা।
সরকারি তথ্য বলছে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনে বাংলাদেশ সীমান্ত ২ হাজার ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনে স্থল সীমান্ত রয়েছে ৯১৩.৩২৪ কিলোমিটার এবং জলসীমান্ত আছে ৩৬৩.৯৩০ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৫৩৮ কিলোমিটার এলাকায় কোনও কাঁটাতার নেই।
অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনে স্থলসীমান্ত রয়েছে ৯৩৬.৭০৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩৭৫ কিলোমিটার অংশই কাঁটাতারহীন।
গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ার অধীনস্থ কোচবিহারে ১৭৭ কিমি সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১১০ কিলোমিটার স্থল সীমান্ত এবং প্রায় ৬৭ কিলোমিটার জল সীমান্ত। কোচবিহারে প্রায় ৫০ কিলোমিটার সীমান্ত কাঁটাতারহীন জায়গা। অর্থাৎ প্রায় ৯৬৩ কিলোমিটার অংশই কাঁটাতার বিহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এই ফাঁক গলেই প্রতিদিন ভারতে ঢুকে পড়ছে অনুপ্রবেশকারীরা।
সরকারি তথ্য বলছে বিএসএফের উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনস্থ এলাকায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে ১২৭ জন। দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনস্থ এলাকায় ধরা পড়েছে ১২২০ জন। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে গত দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে সংখ্যাটা আরও বেড়ে গিয়েছে বলেই দাবি বিএসএফের।
অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গের সীমান্তের দায়িত্বে থাকা যে দু’টি ফ্রন্টিয়ারের সব থেকে বেশি এলাকা পড়ে, সেই অংশগুলিতে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা বেড়ে গেল।
বিএসএফের একাংশের আবার দাবি, সরকারি হিসাবেই যদি এভাবে বেড়েছে বলে উঠে আসে, তাহলে বেসরকারি হিসেবে কত পরিমাণ অনুপ্রবেশকারী ফাঁক গলে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছে, সেটাই ভাবার। যা নিয়ে রীতিমত উদ্বেগও তৈরি হয়েছে।
কী ভাবে ঘটে অনুপ্রবেশ?
সীমান্ত লাগোয়া বাসিন্দাদের দাবি অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে চলে অনুপ্রবেশ। মালদহের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে রয়েছে মহানন্দা নদী। যে নদীর একদিকে বাংলাদেশ অন্য পাড়ে ভারত। দু’দিকেই নদীর পাড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গল আর আম বাগান। জানা যাচ্ছে, সেই বনেই গা ঢাকা দিয়ে থাকে অনুপ্রবেশকারীরা। রাতের অন্ধকারে যখন কুয়াশার চাদরে দৃশ্যমানতা কমে আসে, তখন জল পথে ভারতে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীরা। ভারতের ভূখন্ডে উঠেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চোরা পথে চলে যায় নিজেদের গন্তব্যে। কাছেই আছে বড় রাস্তা। তাই পালানো হয়ে ওঠে আরও সহজ। কোথাও রয়েছে পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব তো কোথাও আবার পুলিশকে ঘুষ দিয়ে পগাড়পার অনুপ্রবেশকারীরা। গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন প্রায়ই রাতে চলে এই অনুপ্রবেশ।
মালদহ সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি বাংলাদেশের ভোলাহাট, শিবগঞ্জ, চাঁপাই, যশোর, নবাবগঞ্জের মতো এলাকা থেকেই ভারতের হয়ে হবিবপুর হয়ে নিয়মিত চলে অনুপ্রবেশ। তেমনই দক্ষিণবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এলাকাতে ইচ্ছামতী নদীর অংশের ব্যপারটাও অনেকটা একইরকম।
এলাকাবাসীদের অভিযোগ ঘুষ দিয়ে ছক কষে ভারতে ঢুকে পড়ছে অনুপ্রবেশকারীরা। কেউ কেউ বলছেন পরে আবার স্থানীয় নেতা-মন্ত্রীকে ঘুষ দিয়ে করে নিচ্ছে জাল পরিচয় পত্র থেকে ঘরবাড়িও। অভিযোগ এঁদের মধ্যে আছেন অনেক জঙ্গী বা দুষ্কৃতীরাও।
কেন এই সুবিশাল অংশে কাঁটাতার বসানো হয়নি?
সূত্রের খবর কূটনৈতিক জাঁতাকলে পড়েই হয়ে ওঠেনি দীর্ঘ অংশের কাঁটাতার বসানো। কিছু জায়গায় কাঁটাতার বসানোর জায়গা নিয়েও রয়েছে টানা পোড়েন। আবার সুন্দরবন বা উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ এতটাই দুর্গম যে সেখানে কাঁটাতার বসানো সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে টানাপোড়েন। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি রাজ্যের শাসক দলের দিকে আঙুল তুলে বলেছে রাজ্য কাঁটাতার বসানোর জন্য জমি দিতে নানা টালবাহানা করছে। আর রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের বক্তব্য, সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর। যা কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন। সুতরাং এর দায় যায় অমিত শাহের উপরেই। অনুপ্রবেশ ইস্যুকে হাতিয়ার করে ভোটের রাজনীতি করতেও পিছপা হয়না কোনও দলই।
কী বলছে সেনা?
বিএসএফ-এর পক্ষ থেকেও অনুপ্রবেশের একটি ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করে এই অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। রাতে ড্রোন ক্যামেরায় নজরদারি চালানোর সময় ধরা পড়েছে যা। সীমান্ত এলাকায় আরও আটসাঁট করা হয়েছে নিরাপত্তাও। বিএসএফ-এর উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ইনস্পেক্টর সূর্যকান্ত শর্মা বলেন, “ফাঁসিদেওয়ার আশেপাশে অনেক কাঁটাতার হীন এলাকায় ইতিমধ্যেই কাঁটাতার বসানো হয়ে গিয়েছে। বাকি অংশেও বসানোর কাজ চলছে। বড় বড় ফাঁকা অংশেও ফেন্সিং-এর কাজ চলছে।”
অগস্ট থেকেই দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই খানিকটা হলেও দেখা গিয়েছে এপার বাংলাতেও। বিশেষ করে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনায় তেড়েফুড়ে উঠেছে এদেশের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিও। তার মধ্যে ক্রমাগত অনুপ্রবেশ ভারতেও যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে না এমনটা বলা যায় না।