Children’s Day 2024: ‘হাতি চাই’, জাপানি শিশুদের আবদার, ‘ইন্দিরাকে’ পাঠিয়ে বড় কূটনীতির চাল নেহরুর
Children's Day 2024: শিশুদের অত্যন্ত পছন্দ করতেন জওহরলাল নেহরু। শিশদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। শিশুদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তাও ছিল দেখার মতো। এমনকী, জাপান, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস থেকেও শিশুরা চিঠি লিখত তাঁকে। একবার জাপানের শিশুরা হাতি চেয়ে চিঠি লিকেছিল তাঁকে, 'ইন্দিরা'কে পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল।
১৯৪৯ সালের জুলাই মাস। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এমন সময় তাঁর কার্যালয়ে এসেছিলেন হিমাংশু নিয়োগি নামে কলকাতার এক রফতানিকারক। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি থলি। সেই থলিতে ছিল জাপানি শিশুদের লেখা ৮১৫টি চিঠি। নেহরুর কার্যালয়ে আসার কয়েকদিন আগে, ব্যবসার কাজে জাপানে গিয়েছিলেন হিমাংশু। সেই সময় টোকিয়োর বেশ কিছু স্কুল পরিদর্শন করেছিলেন তিনি।
তাঁকে ফুলের তোড়া দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল শিশুরা। তাঁর সঙ্গে গ্রুপ ফোটো তুলেছিল। আর হিমাংশু যখন ভারতে ফেরার তোড়জোড় করছেন, তখন তাঁর হাতে জাপানি স্কুলশিশুরা ধরিয়ে দিয়েছিল ওই চিঠির থলি। সেই চিঠির গোছা পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু। কিন্তু অবাক হয়েছিলেন সেই চিঠিগুলির মাধ্যমে পাঠানো অনুরোধ পেয়ে। টোকিয়োর চিড়িয়াখানার জন্য একটি ভারতীয় হাতি পাঠানোর অনুরোধ করেছিল ওই জাপানি শিশুরা।
সুমিকো কানাতসু নামে, নেগিশি প্রাইমারি স্কুলের এক ছাত্রী ইংরেজিতে লিখেছিল, “টোকিয়োর চিড়িয়াখানায় আমরা কেবল শূকর এবং পাখি দেখতে পাই। তা নিয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। জাপানি শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে একটি বড় আকারের হাতি দেখতে চায়। আপনি ভাবতেও পারবেন না, এই প্রাণীকে দেখতে আমরা কতটা উদগ্রীব।”
আসলে, টোকিয়োর উয়েনো চিড়িয়াখানায় আগেও তিনটি হাতি ছিল। ১৯২৪ সালে দুটি হাতি আনা হয়েছিল ভারত থেকে, তৃতীয়টি আনা হয়েছিল থাইল্যান্ড থেকে। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা উয়েনো চিড়িয়াখানায়, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু, বাধ সাধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বোমা হামলায় চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপ ভেঙে গেলে শহরে ঢুকে হামলা চালাবে হাতিগুলি, এই আশঙ্কা তৈরি হয়। ১৯৪৩-এ টোকিয়োর মেয়র, হাতিগুলিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে, খাদ্যে বিষ মিশিয়ে তাদের মারার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, কোনোটাই কাজে আসেনি। শেষে হাতিগুলিকে না খাইয়ে মারা হয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধর মধ্যে হাতিদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না বড়দের। কিন্তু, ওই হাতিদের ভুলতে পারেনি জাপানি শিশুরা। যুদ্ধের কয়েক বছর পর, জাপানের পুনর্গঠনের সময়, জাপানি সংসদে চিড়িয়াখানায় হাতি আনার দাবি জানিয়ে একটি পিটিশন জমা দিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির দুই ছাত্র। তাদের সেই আবেদন অনুরণিত হয় জনগণের মধ্যেও। শেষ পর্যন্ত, জাপানি শিশুদের টোকিয়ো সরকার বলেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে। হাতি পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে। আর এরপরই হিমাংশু নিয়োগির হাতে ওই চিঠির ঝাঁপি তুলে দিয়েছিল জাপানি শিশুরা। আগের তিনটি হাতির কথা উল্লেখ করে, সেসি গ্রেড স্কুলের ছাত্র মাসানোরি ইয়ামাতো লিখেছিল, “হাতিগুলি এখনও আমাদের স্বপ্নে বেঁচে আছে।”
চিঠিগুলি পাওয়ার পর, বিদেশ মন্ত্রককে একটি উপযুক্ত হাতি সংগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন নেহরু। মাইসোরে পাওয়া গিয়েছিল সেই হাতি, নাম ছিল তার ‘ইন্দিরা’। জওহরলাল নেহরুর মেয়ের নাম। ১৯৪৯-এর ২৫ সেপ্টেম্বর, ইন্দিরা নামের হাতিটি এসে পৌঁছয় উয়েনো চিড়িয়াখানায়। হাজার হাজার লোক এসেছিল তাকে দেখতে। হাতিটিরল সঙ্গে জাপানি শিশুদের উদ্দেশে একটি বার্তাও পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু।
তিনি লিখেছিলেন, “আশা করি যখন ভারত এবং জাপানের শিশুরা বড় হবে, তখন তারা শুধু তাদের মহান দেশগুলিতেই নয়, সমগ্র এশিয়া এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি ও সহযোগিতা আনবে। ইন্দিরা নামের এই হাতিটি ভারতের শিশুদের পক্ষ থেকে জাপানি শিশুদের পাঠানো স্নেহ ও শুভেচ্ছার উপহার। হাতি এক মহৎ প্রাণী। তারা জ্ঞানী, ধৈর্যশীল, শক্তিশালী এবং তারপরও মৃদু স্বভাবের। আশা করি, আমাদের সকলের মধ্যেও এই গুণাবলীগুলির বিকাশ ঘটবে।” প্রায় আট বছর পর ১৯৫৭ সালে, মেয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে জাপান সফরে গিয়ে, হাতি ইন্দিরার সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু।
শুধু জাপানের শিশুদের কাছ থেকেই এই ধরনের অস্বাভাবিক অনুরোধ পাননি জওহরলাল নেহরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মানির বার্লিনের চিড়িয়াখানাতেও, টোকিওর মতোই অত্যাচারের সম্মুখিন হয়েছিল প্রাণীরা। যুদ্ধের কয়েক বছর পর, বার্লিন চিড়িয়াখানায় হাতি না দেখতে পেয়ে শিশুরাও জওহরলাল নেহরুকে চিঠি লিখে হাতি পাঠানোর অনুরোধ করেছিল। সেই চিঠিগুলি পেয়ে, ১৯৫১ সালের জুন মাসে, ‘শান্তি’ নামে তিন বছর বয়সী একটি মহিলা হাতিকে বার্লিনে পাঠিয়েছিলেন নেহরু।
এর দুই বছর পর, ১৯৫৩ সালে পিটার মারমোরেক নামে পাঁচ বছরের এক শিশু একই অনুরোধ জানিয়ে কানাডা থেকে চিঠি লিখেছিল জওহরলাল নেহরুকে। সে জানিয়েছিল, তাদের ছোট্ট শহর গ্র্যানবিতে খুব সুন্দর চিড়িয়াখানা থাকলেও, সেখানে কোন হাতি নেই। তাঁর চিঠিরও জবাব দিয়েছিলেন ভারতের তৎালীন প্রধানমন্ত্রী। সরাসরি হাতি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি না দিলেও, তিনি জানিয়েছিলেন, তার অনুরোধ তিনি ভুলবেন না। ১৯৫৫ সালে, চেন্নাই থেকে ‘অম্বিকা’ নামে একটি দুই বছর বয়সী হাতিকে গ্র্যানবি চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এইভাবে বিদেশে শিশুদের উপহার হিসেবে হাতি পাঠানোটা জওহরলাল নেহরুর কূটনৈতিক চাল ছিল বলে মনে করেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেকরা। বিশ্বে, বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতের ভাবমূর্তি জোরদার হয়েছিল। তবে, শুধু কি কূটনীতি? এর পিছনে শিশুদের প্রতি জওহরলাল নেহরুর অকৃত্রিম ভালোবাসারও একটা বড় ভূমিকা ছিল। শিশুদের শিক্ষা এবং অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। শিশুদের খুবই ভালোবাসতেন। শিশুরাও তাঁকে অত্যন্ত পছন্দ করত। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাচ্চাদের মধ্যে পরিচিত ছিলেন ‘চাচা নেহরু’ নামে। তিনি একবার বলেছিলেন, “শিশুরা হল বাগানের কুঁড়ির মতো এবং তাদের যত্ন করে, ভালবেসে বড় করা উচিত। কারণ তারা দেশের ভবিষ্যত এবং আগামী দিনের নাগরিক।”
তিনি জানতেন শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। পণ্ডিত নেহেরু মনে করতেন, শিশুদের স্বাধীন ও সুখী জীবনযাপনের সুযোগ পাওয়া উচিত। এর ফলে, তারা ভবিষ্যতে দেশে গর্বিত করতে পারে এবং দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে পারে। শিশুদের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই, আর সেটা তাদের কাছ থেকে বড়দের শেখা উচিত বলেও মনে করতেন তিনি।
নেহরু বলেছিলেন, “বিশ্ব জুড়ে শিশুদের এই বিশাল বাহিনী, তাদের গায়ে বিভিন্ন ধরণের পোশাক রয়েছে। আপনি যদি তাদের এক জায়গায় নিয়ে আসেন, তবে তারা খেলতে শুরু করে দেবে বা ঝগড়া করবে। কিন্তু, তাদের ঝগড়াও একরকম খেলা। তারা বিভেদের কথা ভাবে না। নিজেদের মধ্যে, শ্রেণী ধর্ম বা বর্ণের পার্থক্য বোঝে না। এই ব্যাপারে তারা তাদের বাবা-মাদের থেকে বুদ্ধিমান।”
শিশুদের জন্য তিনি নানারকম কল্যাণমূলক প্রকল্পও চালু করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদে তিনি, কারিগরি শিক্ষার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ডাক্তারি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত শিক্ষার জন্য অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স, ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের মতো দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। নেহরুর ভাবনা ছিল, এই উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে শিশুরা একদিন দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা করে নেবে। দেশ কোন পথে এগোবে তাও ঠিক করে দেবে তাদের শিক্ষার গুণমান।
তিনি বলেছিলেন, “আজকের ছেলেমেয়েরাই আগামী দিনের ভারত তৈরি করবে। আমরা যেভাবে তাদের বড় করব সেটাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।” পাশাপাশি, ১৯৫৫ সালে তিনি ‘চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি ইন্ডিয়া’ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে সংগঠন শুধুমাত্র শিশুদের জন্য সিনেমা তৈরি করে।
শিশুদের প্রতি ‘চাচা নেহরু’র এই ভালবাসাকে স্মরণ করে, তাঁকে সম্মান জানাতে, তাঁর জন্মদিবস (১৪ নভেম্বর)-কে ভারতে শিশুদিবস হিসেবে পালন করা হয়। অবশ্য আগে ভারতে ২০ নভেম্বর পালন রা হত শিশু দিবস। ১৯৫৫ সালে এই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক শিশু দিবস হিসেবে ঘোণা করেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। ১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পর, তাঁকে সম্মান জানাতে ১৪ নভেম্বর দিনটিকেই ভারতে শিশু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ১৯৬৫ সালে প্রথম এই দিন উদযাপন করা হয়।