Constitution Day: সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন একজনই, সে দিন হাসির রোল ওঠে পার্লামেন্টে
Constitution Day: আবার ফিরে আসি সেই দিনে। ১১টা ১০ মিনিটে পেশ হওয়ার পর পরই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় সংবিধানের খসড়া। তার ঠিক দুই মিনিটের মধ্যে স্বাক্ষর করেন গণপরিষদের সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। এরপর একটি ৫০ মিনিটের বক্তৃতা দেন তিনি। রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, “ভারতে আজ একদল সৎ ব্যক্তির প্রয়োজন। আজ যাঁরা দেশের কাজ করবেন, তাঁরা স্বাধীনতা যোদ্ধা থেকেও বড় যোদ্ধা।”
ডানদিকে সরকার পক্ষ। বাম দিকে বিরোধী পক্ষ। মধ্যমণি রাষ্ট্রপতি দ্রোপদী মুর্মু। সবাই চুপটি করে শুনছিলেন রাষ্ট্রপতির কথা। তিনি বলছিলেন, সংবিধান তৈরির গল্প। দীর্ঘ স্বাধীনতা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে দেশ তৈরি হওয়ার সূচনা। স্বাধীনতা লাভের পরও কেন সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল তিন তিনটে বছর, তার কথাই শোনাচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধান শুধু তো বইয়ের পাতা নয়, এই দেশের আত্মা। তাকে কীভাবে রক্ষা করা উচিত, ন্যায়-সত্যের পথে দাঁড়িয়ে এত বড় দেশকে একসূত্রে কীভাবে বাঁধা উচিত, এই সব নিয়ে রাষ্ট্রপতি শোনাচ্ছিলেন সংবিধানের মাহাত্ম্য। মহামহিম রাষ্ট্রপতি দ্রোপদী মুর্মুর এই সব কথা শুনতে শুনতে ঐতিহাসিক টাউন হলে এই একই শব্দ কখন যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সবার অলক্ষ্যে। ১৯৪৯ সালের ঠিক এই দিনটিতেই ভারতের গণপরিষদের স্থায়ী সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদও এই শব্দগুলিই উচ্চারণ করেছিলেন। কী অদ্ভুত না! কেমন ছিল সেই ঐতিহাসিক দিনটি? যে দিন (সর্বসম্মতিক্রমে এই দিনটিতে সংবিধান প্রস্তাবনা পাশ হয়, তবে কার্যকর হয় ১৯৫০ সালে ২৬ জানুয়ারি) থেকে ভারত নামক একটি নতুন দেশ তৈরি হয়। সেই দেশ সংবিধান পায়। রাষ্ট্রপতি পায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ ভোটাধিকার পায়। আর কত কী পাওয়ার দিন ছিল এ দেশের নাগরিকের। সংবিধান দিবসে চলুন একবার ফিরে দেখি সেই ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর দিনটি।
যত বার সংবিধানের কথা আমরা বলি, তত বারই এক জনের নাম বারবার চলে আসে, তিনি হলেন ডক্টর ভীমরাও অম্বেদকর। যাঁর হাত ধরে একটি দেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে বিশ্বের বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার। ৩ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংবিধানের খসড়া তৈরি করেন ওই কমিটির চেয়ারম্যান অম্বেদকর। সংসদে প্রস্তাবনা গৃহীত হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ২৫ নভেম্বর সমস্ত তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে চূড়ান্ত খসড়া পেশ করেন অম্বেদকর। প্রায় ৪০ মিনিট বক্তৃতা রাখেন তিনি। এ দিন বলেন, “১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে ভারতবাসী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমানাধিকার পেলেও, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসাম্য ভোগ করবে। আমাদের উচিত শীঘ্র এই অসাম্য দূর করা। তা না হলে বঞ্চিতের দল রাজনৈতিক গণতন্ত্রের কাঠামো ভেঙে ফেলবে।” অম্বেদকরের মুখে বারবার অসাম্যের কথা উঠে আসে। তাঁর দূরদৃষ্টতা যে খুব একটা ভ্রান্ত নয়, ৭৫ বছর পরও আমরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। এই অসাম্য আদৌ দূর হয়েছে না বেড়েছে, এ বিতর্কের বিষয়। তবে সে দিন গণপরিষদে দাঁড়িয়ে অম্বেদকরের স্পষ্ট বার্তা ছিল, “প্রকৃত জাতি হিসাবে নিজের বুনিয়াদ সুদৃঢ় করতে হলে আগে আর্থিক ও সামাজিক অসাম্য থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হবে।”
কেউ কেউ অভিযোগ করেছিলেন এই সংবিধানে সরকারের অতিরিক্ত শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই অভিযোগ খারিজ করে বিরোধীদের অম্বেদকর আশ্বস্ত করেছিলেন, গণপরিষদ কখনও এই দাবি করে না, কোনও দিন সংবিধানের অনুচ্ছেদ বা ধারা সংশোধন করা যাবে না। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অম্বেদকর বলেছিলেন, “বিরোধীরা দেখাক বিশ্বে এমন কোনও সংবিধান আছে, যেখানে সংশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে।” তাই তো আজও আমাদের সংবিধান এত সময়োপযোগী, এত সচল।
এবার আসি, ২৬ নভেম্বর দিনটিতে। গণপরিষদে সকাল ১১টা ৭ মিনিটে পেশ করা হয় ভারতের সাধারণতন্ত্রের সংবিধান। হইহই করে সম্মতি জানান সবাই। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ সংবিধানের খসড়া পেশ করার পর ভোটাভুটিতে সবাই ‘হ্যাঁ’ সম্মতি জানান। মজার ব্যাপার হল গণপরিষদের একজন মানুষ এই সংবিধান প্রস্তাবনায় ‘না’ ভোট দেন। তিনি হলেন স্বাধীনতা বিপ্লবী, কবি, কংগ্রেসের সদস্য আবার কমিউনিস্ট পার্টি তৈরির সহ প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা হজরত মোহানী। তাঁর ‘না’ অসম্মতি শোনায় হাসির রোল ওঠে গণপরিষদে।
মৌলানা হজরত মোহানী হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁর হাত ধরে ভারতে প্রথম ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান আসে। পরবর্তীকালে এই স্লোগান জনপ্রিয় করে তোলেন ভগৎ সিং। হজরত মোহানীর আসল নাম সৈয়দ ফজল উল হাসান। সংবিধানের খসড়া তৈরির অন্যতম কারিগর তিনি। তা সত্ত্বেও সেদিন তিনি ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। আসলে হজরত মোহানী বিশ্বাস করতেন অবিভক্ত ভারতের। সম্পূর্ণ স্বাধীনতার। ভারত ভাগ হলে এ দেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সরকারি সুবিধা কখনও নেননি। মসজিদে থেকে সংসদে যাতায়াত করতেন মোহানী।
আবার ফিরে আসি সেই দিনে। ১১টা ১০ মিনিটে পেশ হওয়ার পর পরই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় সংবিধানের খসড়া। তার ঠিক দুই মিনিটের মধ্যে স্বাক্ষর করেন গণপরিষদের সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ। এরপর একটি ৫০ মিনিটের বক্তৃতা দেন তিনি। রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, “ভারতে আজ একদল সৎ ব্যক্তির প্রয়োজন। আজ যাঁরা দেশের কাজ করবেন, তাঁরা স্বাধীনতা যোদ্ধা থেকেও বড় যোদ্ধা।” উত্তরসূরিদের উদ্দেশে রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, “এই সংবিধান কার্যকর করার ক্ষমতা যাঁদের হাতে থাকবে, তাঁরা সৌভাগ্যবান। স্বাধীনতা রক্ষা ও সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। দৃঢ় বিশ্বাস ও অহিংসার মনোভাব নিয়ে স্বাধীন সাধারণতন্ত্রের পরিচালনার ভার আমাদের গ্রহণ করতে হবে। উপরে ভগবান আর নীচে পবিত্র অন্তর আমাদের শাসকদের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।”
গণপরিষদের সভাপতির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর, তিনি ইচ্ছাপ্রকাশ করেন, সভার সব সদস্যের কাছে গিয়ে করমর্দন করার। পত্রপাট তাঁর এই প্রস্তাব খারিজ করে সবাই রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছেই যান করমর্দন করতে। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, খসড়া রচনা কমিটির চেয়ারম্যান অম্বেদকর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ দিন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ঘোষণা করেন, সংবিধানের প্রথম তফশিলির ‘খ’ ধারায় হায়দরাবাদ-সহ নয়টি দেশীয় রাজ্য অন্তর্ভুক্ত করা হল। প্যাটেলের ঘোষণার পরই উল্লাসে ফেটে পড়ে গণপরিষদ।
এ দিন গণপরিষদে প্রশ্ন ওঠে সংবিধান হিন্দি ভাষায় হবে কিনা! উত্তর প্রদেশের প্রতিনিধি অনন্ত রায় শাস্ত্রী জানতে চাইলে, সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ জানান, আগামী ১৫ বছর ইংরেজি সরকারি ভাষা থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, ২৬ জানুয়ারি সংবিধান হিন্দিতে অনুবাদ করা হবে। এরপর ওড়িশার গণপরিষদের সদস্য বিশ্বনাথ দাস প্রশ্ন করেন, বন্দে মাতরম বা দেশের জাতীয় সঙ্গীত কী হবে। এ প্রশ্নে সভাপতি জানান, আগামী জানুয়ারি মাসে এই বিষয়টি বিবেচিত করা হবে। তবে, শ্রীমতী পূর্ণিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘জন গন মণ’ গানেই সমাপ্তি হয় এ দিনের অধিবেশন।