নিরাপদ হলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কোভিশিল্ডে, ল্যানসেটে গবেষণাপত্র বাঙালির

ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিশেষজ্ঞ ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক বলেন, "সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৮০৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল, বাকি সকলেই সুস্থ রয়েছেন। মৃত্যুর কোনও ঘটনা নেই। ফলে কোভিড টিকা নিলে বিপদ হতে পারে বলে যে জল্পনা চলছিল, তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই।

নিরাপদ হলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কোভিশিল্ডে, ল্যানসেটে গবেষণাপত্র বাঙালির
ফাইল ছবি
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jul 24, 2021 | 6:44 PM

কমলেশ চৌধুরী: কোভিশিল্ড নিরাপদ। কিন্তু হাইপোথাইরয়ডিজম, হাইপারটেনশন, অ্যালার্জির মতো সমস্যা থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনাও বেশি। উত্তর ভারতে কোভিশিল্ড প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে এমনই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের বিজ্ঞানী-চিকিত্‍সকরা। যার নেতৃত্বে রয়েছেন বাঙালি অধ্যাপক-চিকিৎসক শঙ্খশুভ্র চক্রবর্তী। শুক্রবার তাঁদের সেই পর্যবেক্ষণই গবেষণাপত্রের আকারে প্রকাশিত হয়েছে ল্যানসেট-এর ইক্লিনিক্যাল মেডিসিন জার্নালে। তবে সমীক্ষকরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেই লিখেছেন, কোভিশিল্ড মানবশরীরে প্রয়োগের জন্য একেবারে নিরাপদ। কিছু ক্ষেত্রে সাবধানতা দরকার, প্রয়োজন রয়েছে টিকাকরণের পর বিশেষ নজরদারিরও, এমনটাই অভিমত বিজ্ঞানীদের।

কোভিশিল্ডের গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক বিশ্ব জুড়ে।  কোভিশিল্ড নিলেই অধিকাংশ মানুষের আসছে জ্বর। সঙ্গে থাকছে মাথা ব্যাথা, গা-হাত-পা ব্যাথা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বা রক্ত জমাট বাঁধার মতো সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। টিকাকরণের পর রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা অর্থাত্‍ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া দেখা দেওয়ায় ইউরোপের একাধিক দেশ কোভিশিল্ড নিয়ে “ধীরে চলো” নীতি অনুসরণ করেছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ডের মতো বেশ কয়েকটি দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই করোনা টিকার প্রয়োগের উপরও স্থগিতাদেশ জারি করা হয়। তবে ভারত সরকারের তরফে সাফ জানানো হয়েছে, এ দেশে টিকাকরণের পর রক্তক্ষরণ বা রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা একেবারেই কম।

গত ৩ এপ্রিল অবধি দেশে ৭ কোটি ৫৪ লক্ষ ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬ কোটি ৮৬ লক্ষ কোভিশিল্ড, ৬৭.৮ লক্ষ কোভ্যাক্সিন। এর মধ্যে ২৩ হাজার জনের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যা কোউইনে নথিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০০টি ঘটনা গুরুতর। ভারতে কোভিশিল্ড প্রাপকদের মধ্যে মাত্র ২৬ জনের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা ঘটেছে। এই তথ্যের ভিত্তিতেই কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়, দেশে টিকা নেোয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা নিতান্তই কম, অঙ্কের হিসেবে ১ কোটিতে মাত্র ৬ জনের এই সমস্যা দেখা যায়! যদিও ব্রিটেন, জার্মানিতে এই সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি বলেও দাবি করেছে ন্যাশনাল অ্যাডভার্স ইভেন্ট ফলোয়িং ইমিউনাইজেশন কমিটি।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

শুক্রবার ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় জানানো হয়েছে, প্রথম ডোজ় নেওয়ার পর ৪০ শতাংশের দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার পর সেই সংখ্যাটা অনেকটাই কমে গিয়েছে, মাত্র ১৬ শতাংশের দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, ব্রিটেনের ট্রায়ালে যা ছিল ৬০ থেকে ৮৮ শতাংশ। গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও টিকা নিয়ে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জেরে মৃত্যু হয়নি কারোর।

এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য মূলত কোভিশিল্ডে ব্যবহৃত ‘বাহক’ অর্থাত্‍ অ্যাডিনোভাইরাসকেই দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতে যেহেতু এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি, তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কম বলেই অনুমান, যা ইউরোপ, আমেরিকা বা চিনে দেখা গিয়েছে। ভারতীয় এই প্রবণতাকে আশীর্বাদ হিসেবেই গণ্য করছেন বিজ্ঞানীরা।

তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।  যাদের হাইপোথাইরয়ডিজম রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে,  যাদের থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোনের নিঃসরণ কম হয়, তাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এমনকী গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা গিয়েছে। থাইরক্সিন হরমোনের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সম্পর্ক এ ক্ষেত্রে কতটা দায়ী, তা নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন গবেষকরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঘটনা বেশি। এ দিকে, যত বয়স বাড়বে, ততই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঘটনা কমেছে বলেও দাবি করা হয়েছে গবেষণায়। ৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ৪০ উর্ধ্বদের তুলনায়  বেশি বলেই জানা গিয়েছে।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।

এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, অ্যালার্জির ইতিহাস থাকলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষকদের দাবি, যে ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি দেখা গিয়েছে, কয়েকটি বাদে বেশিরভাগই মৃদু প্রকৃতির। শুধু কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি নজরদারির পক্ষে সওয়াল করেছেন তাঁরা। গবেষক দলের প্রধান ডঃ শঙ্খশুভ্র চক্রবর্তী বলেন, “টিকার কার্যকারিতা, দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার বিষয়টি নিয়েও গবেষণা করছি আমরা। তা সম্পূৰ্ণ হলে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। আপাতত গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি, টিকা নেওয়ার পরপরই বড়সড় কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না।”

বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা নিয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিশেষজ্ঞ ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক বলেন, “সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৮০৪ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল, বাকি সকলেই সুস্থ রয়েছেন। মৃত্যুর কোনও ঘটনা নেই। ফলে কোভিড টিকা নিলে বিপদ হতে পারে বলে যে জল্পনা চলছিল, তার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই, এই গবেষণায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।”

ইমিউনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদারও বলেন, ” দেশের জনসংখ্যার তুলনায় নমুনা-সংখ্যা ছোট হলেও, টিকাকরণ পরবর্তী প্রথম ‘সেফটি ডেটা’ (নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য) পাওয়া গেল বলে এই সমীক্ষার ফলাফল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর করা এই সমীক্ষার ফলাফল দিয়ে যদিও গোটা দেশের সুরক্ষা বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ঠিক নয়, তবে এই ফলাফল আদতে সামগ্রিক ভাবে জনমানসে টিকার উপর আস্থা বাড়াবে। বাস্তবিক তথ্যের ভিত্তিতে এটা বলাই যায়, ভারতীয় জনগোষ্ঠীতে সেফটি ইস্যুতে লেটার নম্বর নিয়ে পাশ করেছে কোভিশিল্ড।” আরও পড়ুন: করোনা সারাবে না! তবে কোভিড চিকিৎসায় অনুমোদন পেল পতঞ্জলির ‘করোনিল’