বিশ্লেষণ: কেন বাড়ল মহার্ঘ ভাতা? কতটা লাভ হল সরকারের? জেনে নিন DA-র DNA
TV9 Explained: করোনাকালে যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা ব্যপক আর্থিক কষ্টের মুখে পড়েছিল, সেই সময় ডিএ-তে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করায় সমালোচনায় সরব হয় বিরোধীরা।
নয়া দিল্লি: খুশির খবর কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের। দীর্ঘ প্রায় দুই বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে বকেয়া ডিএ (DA) বা বর্ধিত মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেছে কেন্দ্র। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা একলাফে ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ শতাংশে। ঘোষণা হতেই খুশির জোয়ার সরকারি কর্মীদের মধ্যে। কারণ এতদিনের অপেক্ষার পর পুজোর মরশুমের আগেই একযোগে অনেক টাকা ঢুকবে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এই ডিএ স্থগিত রেখেছিল কেন্দ্রীয় সরকার।
করোনাভাইরাস ও লকডাউনের জেরে বিপুল ধস নেমেছিল দেশের অর্থনীতিতে। সেই সময়ই আর্থিক মন্দার হাত থেকে বাঁচতে সরকারি কর্মীদের ডিএ বন্ধ রাখা হয়েছিল। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলিয়ে দেশের অর্থনীতি একটু মুখ তুলে তাকাতেই সরকারি কর্মীদের বরাদ্দ টাকা মিটিয়ে দিতে উদ্যোগী সরকার। বুধবারই মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছেন। ১ জুলাই থেকেই নতুন ডিএ কার্যকর হবে। তবে কোনও বকেয়া বা এরিয়ার পাবে না সরকারি কর্মীরা। তবে ডিএ বা মহার্ঘ ভাতা নিয়ে গভীরে আলোচনার আগে মহার্ঘ ভাতা কী এবং কীভাবেই তা বৃদ্ধি হয়, জেনে নেওয়া যাক।
ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স বা মহার্ঘ ভাতা:
মহার্ঘ ভাতা- (Dearness Allowance) এই নামটি শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে যে ভাতা দেওয়া হয়, তাকেই এক কথায় বর্ধিত মহার্ঘ ভাতা বলা হয়। দেশের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতেই সরকারি কর্মীদের বেসিক বেতনের উপর কিছু শতাংশ বর্ধিত ভাতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট বেতনের সঙ্গে অতিরিক্ত পরিমাণ কিছু ভাতাও মেলে। ডিএ বা মহার্ঘ ভাতার সূচনা কিন্তু এখন থেকে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই এই বর্ধিত ভাতা দেওয়া হত, তবে তা খাদ্যের ক্ষেত্রে। এরপর স্বাধীনতার আগের বছর থেকে কর্মীদের জন্য এই বর্ধিত ভাতার ঘোষণা করা হয়। প্রতি বছর মূলত দু’বার এই বর্ধিত ভাতা দেওয়া হয়, জানুয়ারি থেকে জুন মাসে এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাসের জন্য। তবে শুধু সরকারি চাকুরিরত যারা, তারাই নয়, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের জন্যও নিয়মিত বর্ধিত মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়। একে ডিআর (DR) বলে। এক্ষেত্রে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ডিএ আলাদা হয়। লিখিত কোনও নিয়ম না থাকলেও মূলত কেন্দ্রের ধার্য করা ডিএ অনুসরণ করেই রাজ্যের ডিএ ঘোষণা করা হয়।
পে কমিশন:
সরকারি কর্মীদের বেতনকাঠামো কী হবে এবং পদোন্নতির পর বর্ধিত বেতন কত হবে, এই সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয় পে কমিশন (Pay Commission)। ১৯৪৬ সালে প্রথম পে কমিশন গঠন করা হয় এবং ১৯৪৭ সালের মে মাসে কমিশন প্রথমবার তাদের সুপারিশ জমা দেয়। নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা না থাকলেও প্রতি ১০ বা ১২ বছর অন্তর এই পে কমিশন গঠিত হয়। এই পে কমিশনই সিদ্ধান্ত নেয় সরকারি কর্মীদের ডিএ কত শতাংশ বৃদ্ধি হওয়া উচিত। আমাদের দেশে এখনও অবধি মোট সাতটি পে কমিশন গঠিত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে শেষ কমিশন গঠিত হয়। পে কমিশনকে ১৮ মাস সময় দেওয়া হয় বর্ধিত ডিএ স্থির করার জন্য।
সপ্তম পে কমিশনে পরিবর্তন:
২০১৬ সালের আগে অবধি পে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি কর্মীদের ডিএ বাড়তে বাড়তে তা ১০০ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ বেতনের ১৩৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। বেতন ক্রম অনুযায়ী সেই ডিএ বৃদ্ধি হত। সেই কারণে সপ্তম পে কমিশন (7th Pay Commission) গঠনের পর তা ফের শূন্য করে দেওয়া হয়। তবে ২০১৮ সালে ডিএ ৮ শতাংশ ছিল। ২০১৯ সালের প্রথম ভাগে তা ১২ শতাংশ হয়। দ্বিতীয় ভাগে তা একলাৎফে ১৭শতাংশে বেড়ে যায়। ২০২০ সালে মার্চ মাসে কেন্দ্রের তরফে ডিএ ১৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২১ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তারপরই দেশ তথা গোটা বিশ্বে আছড়ে পড়ে করোনা মহামারী। উল্টে যায় সমস্ত হিসেব-নিকেশ।
মহার্ঘ ভাতায় স্থগিতাদেশ-
মার্চ মাস থেকেই করোনা সংক্রমণের প্রভাবে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সমস্ত পরিষেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়ানোয় তার প্রভাব যে দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে, তা বলাবাহুল্য। সরকারের রাজস্ব-আয় কমতে শুরু করায় এবং কোভিডের মোকাবিলায় অর্থের সংস্থানের জন্য এপ্রিল মাসে নির্দেশিকা জারি করে ডিএ ও ডিআর স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। চলতি বছরের জুন মাস অবধি এই স্থগিতদেশ জারি ছিল। তবে বিগত কয়েক মাস ধরেই পুনরায় ডিএ চালু করার জল্পনা শোনা গিয়েছিল। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পরই বৈঠকে আটকে থাকা ডিএ সংশোধন করে চালু করায় অনুমোদন দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ডিএ-তে স্থগিতাদেশ জারি করার ফলে বিগত দুই বছরে ১৭ শতাংশ হারেই কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের ডিএ দেওয়া হয়। এটিই যদি বর্ধিত ৪ শতাংশ যোগ করে অর্থাৎ ২১ শতাংশ হারে দেওয়া হত, তবে সরকারের খরচ হত ২৭,১০৫.০৮ কোটি টাকা। ১৭ শতাংশেই ডিএ স্থগিত রাখায় সরকারের সাশ্রয় হয় ৩৭,৫০৩ কোটি টাকা।
বাজার অর্থনীতিতে ডিএ স্থগিতাদেশের প্রভাব:
কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী ডিএ স্থগিতাদেশ জারি হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সঞ্চয় কমে, তাদের হাতে কেবল বেতনটুকুই আসে, অতিরিক্ত ডিএ নয়। ফলে বাজারে অর্থ বিনিয়োগও হ্রাস পায়, ব্যাপক পতন হয় শেয়ার বাজারে। একইসঙ্গে লকডাউনের সময়কালে নির্দিষ্ট বেতন আসায় সরকারি কর্মীদের ক্রয় ক্ষমতাতেও প্রভাব পড়ে।
কেন্দ্রের সমালোচনা:
করোনাকালে যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা ব্যপক আর্থিক কষ্টের মুখে পড়েছিল, সেই সময় ডিএ-তে স্থগিতাদেশ ঘোষণা করায় সমালোচনায় সরব হয় বিরোধীরা। মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘অমানবিক এবং অসংবেদনশীল’ বলে উল্লেখ করেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি বলেন, ‘‘দিল্লিতে সেন্ট্রাল ভিস্তার মতো সৌন্দর্যবৃদ্ধি প্রকল্পগুলিতে মোদী সরকার কোটি কোটি টাকা ঢালছে, অথচ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা দেওয়ার সময় তাঁদের টাকা নেই! সংসদের সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প স্থগিত না করে কেন্দ্রীয় কর্মচারী, পেনশনভোগী ও জওয়ানদের ডিএ ছাঁটাই করা হল!’’। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও সমালোচনা করে বলেন, “বুলেট ট্রেন বা সৌন্দর্যায়নের পিছনে কোটি কোটি টাকা সরকার খরচ করতে পারলে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ডিএ বৃ্দ্ধি স্থগিতের সিদ্ধান্ত অর্থহীন।”
একলাফে ডিএ ২৮ শতাংশে পৌঁছল কীভাবে?
হাজারো বিতর্কের মাঝেই চলতি মাসে ঘোষণা করা হয়, সরকারি কর্মীদের ডিএ ১৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৮ শতাংশ করা হচ্ছে। হঠাৎ করে মহার্ঘ ভাতার বিপুল বৃদ্ধির হিসাব অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। কেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত ডিএ নয়, বরং বিগত দুই বছর ধরে স্থগিত থাকা ডিএগুলি মিলিয়েই একযোগে তা ২৮ শতাংশে পরিণত হয়েছে। স্পষ্টভাবে হিসাব বোঝাতে গেলে, ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএ-র হার ছিল ১৭%। মার্চে কেন্দ্র ৪% ডিএ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। যা ২০২০-র ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
একসঙ্গে ১১ শতাংশ ডিএ বাড়ার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, গতবছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের ৩ শতাংশ, জুলাই থেকে ডিসেম্বরের ৪ শতাংশ ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস অবধি বকেয়া থাকা ৪ শতাংশ ডিএ একযোগে এসে ১১ শতাংশে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানে ১৭ শতাংশ ডিএ হারের সঙ্গেই এই ১১ শতাংশ যোগ হয়ে ২৮ শতাংশে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে।
বর্ধিত হারে কেন্দ্রকে ডিএ দিতে হলে বছরে খরচ হবে ৩৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা। আরও পড়ুন: বিশ্লেষণ: ‘শ্যাডোব্যানিং’, ইউজ়ারের প্রতি পদক্ষেপে কীভাবে নজর রাখে ইনস্টাগ্রাম?