বিশ্লেষণ: ‘শ্যাডোব্যানিং’, ইউজ়ারের প্রতি পদক্ষেপে কীভাবে নজর রাখে ইনস্টাগ্রাম?

Explained: ইউজ়ারের অজান্তেই তাঁর পোস্টের রিচ কমিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে বলে শ্যাডোব্যানিং বা ঘোস্ট ব্যানিং। সকলের পোস্টেই যে শ্যাডোব্যানিং হয়, তা কিন্তু নয়। এর পিছনে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ এবং অ্যালগোরিথমের অসংখ্য খুঁটিনাটি কাজ করে।

বিশ্লেষণ: 'শ্যাডোব্যানিং', ইউজ়ারের প্রতি পদক্ষেপে কীভাবে নজর রাখে ইনস্টাগ্রাম?
ইনস্টাগ্রাম শ্যাডোব্যানিং আসলে ঠিক কী?
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Jul 15, 2021 | 2:58 PM

“অল আই নিড ইজ় দ্য রিথম ডিভাইন…”

এই 24X7 সোশ্যাল মিডিয়া কানেক্টিভিটির যুগে এনরিক ইগলেসিয়াস তাঁর অন্যতম হিট গানের রিমেক করলে হয়তো একটু বদলে দিতেন ‘হুক’টা (গানের ‘হুক’ বলতে সেই লাইনটিকে বোঝায় যেটা সবথেকে বেশিবার গুনগুন করা হয়): “অল আই নিড ইজ় দ্য ‘অ্যালগোরিথম’ ডিভাইন…”

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন—’রিথম’ নয়, ‘অ্যালগোরিথম’। কেন?

কারণ যে গ্লোবাল ভিলেজে আউটগোয়িং কল-এর তুলনায় ডিএম (ডিরেক্ট মেসেজ) বেশি পছন্দ ডিজিটাল নেটিভ বা নেটিজ়েনদের, সেখানে ‘অ্যালগোরিথম’ই তো আমার-আপনার-আমাদের প্রতি পল-অনুপলের নিয়ন্ত্রক।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনা আবহে বিনোদন থেকে প্রয়োজনীয়তা—সবটুকু জুড়েই রয়েছে সোশ্যাল বা ডিজিটাল মিডিয়া। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এই মাধ্যমে একজন ইউজ়ার কখন কী দেখবেন, সবটাই ঠিক করে দেয় অন্য কেউ। ঠিক যেমন মেঘের আড়াল থেকে লুকিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন মেঘনাদ, তেমনই এখানেও আড়াল থেকে আপনার সমস্ত গতিবিধি নজরে রাখছে তৃতীয় কোন শক্তি। সারাক্ষণই চলছে ‘অ্য়ালগোরিথম’-এর নজরদারি এবং অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ।

মাঝে ফেসবুকে ‘রিচ কমে যাচ্ছে’ এই বলে ‘গেল, গেল’ রব তুলেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের অনেকে। শুধু তাই-ই নয়, সাধারণ ফেসবুক প্রোফাইলেরও নাকি রিচ কমে যাচ্ছে—এমনটাও শোনা গিয়েছে। অর্থাৎ ‘পেজ’ নয়, যাঁদের ‘প্রোফাইল’ রয়েছে, তাঁদের পোস্ট, ভিডিয়ো, ছবি ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সকলে—অথবা পোস্ট ‘পাবলিক’ করা থাকলেও—দেখতে পাচ্ছেন না। এই একই ঘটনা নাকি ঘটেছে ফেসবুক অধিকৃত আর এক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রামে। ইউজ়ারের অজান্তেই ‘ব্যান’ করা হচ্ছে বিভিন্ন পোস্ট। এই গোটা ঘটনার নাম ‘শ্যাডোব্যানিং’।

instagram shadowbanning

ইনস্টাগ্রামের শ্যাডোব্যানিং আসলে কী?

ইউজ়ারের অজান্তেই তাঁর পোস্টের রিচ কমিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে বলে শ্যাডোব্যানিং বা ঘোস্ট ব্যানিং। আরও সহজ করে বললে, একজনের পোস্টের কমেন্ট শ্যাডোব্যান করা হয়েছে এর অর্থ সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউজ়ার ছাড়া আর কেউ ওই কমেন্ট দেখতে পাবেন না। শুধু কমেন্ট নয়, ছবি, ভিডিয়ো—বলা ভাল সবকিছুর উপরেই শ্যাডোব্যানিং সম্ভব।

কোন-কোন ক্ষেত্রে শ্যাডোব্যানিং হয়?

সকলের পোস্টেই যে শ্যাডোব্যানিং হয়, তা কিন্তু নয়। এর পিছনে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ এবং অ্যালগোরিথমের অসংখ্য খুঁটিনাটি কাজ করে। মূলত যাঁরা সোশ্যাল মাধ্যমের নির্দিষ্ট গাইডলাইনে থাকা নিয়ম ভাঙেন কিংবা কোনও বিদ্বেষ বা উস্কানিমূলক বার্তা দেন অথবা ভুয়ো তথ্য প্রচার করেন কিংবা হিংসাত্মক ছবি-ভিডিয়ো পোস্ট করেন, তাঁদের পোস্টেই শ্যাডোব্যানিং হয়।

ইউজ়ারের পোস্টে কম লাইক-শেয়ার-কমেন্ট মানেই কিন্তু তা শ্যাডোব্যানিং নয়…

অনেকসময়েই দেখা যায়, বিভিন্ন ইউজ়ারের পোস্টের কম রিচ হয়েছে। অর্থাৎ কম লাইক-কমেন্ট-শেয়ার এসেছে। এর মানেই কিন্তু ওই ইউজ়ারের পোস্ট শ্যাডোব্যান করা হয়নি। বরং এক্ষেত্রে ইউজ়ারের ফ্রেন্ড-ফলোয়ারের সংখ্যা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ কম বন্ধু বা ফলোয়ার থাকলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই পোস্টের রিচ তুলনায় কম হবে। ইনস্টাগ্রামের তরফে এ-ও বলা হয়েছে যে, একজন ইউজ়ার বেশিরভাগ সময়েই তার ফিডের অর্ধেক বা তারও কম দেখতে পান। এই কারণেও পোস্টের রিচ কমতে পারে।

ইনস্টাগ্রামের শ্যাডোব্যানিংয়ের ক্ষেত্রে কোন-কোন অ্যালগোরিথম কীভাবে কাজ করে?

ইনস্টাগ্রামের প্রধান অ্যাডাম মোসেরি সম্প্রতি একটি ব্লগ পোস্টে সবিস্তারে বিবরণ দিয়েছেন যে, কীভাবে এই শ্যাডোব্যানিং কাজ করে। অর্থাৎ কোন-কোন প্যারামিটার বা পরিমাপের উপর ভিত্তি করে শ্যাডোব্যানিং হয়, তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মোসেরি। যদিও এই অ্যালগোরিথম এবং যে প্রক্রিয়ায় শ্যাডোব্যানিং হয়, তা যথেষ্টই জটিল।

instagram shadowbanning

কী-কী ভাবে শ্যাডোব্যানিং হয়?

যে পোস্টের শ্যাডোব্যানিং করা হবে, আগে তার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ ওই পোস্ট কতটা জনপ্রিয়, কত লোক ওই পোস্ট দেখতে আগ্রহী হতে পারেন, কবে পোস্ট করা হয়েছে সেই সময়কাল, ভিডিয়ো হলে তার ডিউরেশন কত অর্থাৎ ভিডিয়োটি কত বড়, সেখানে আগ্রহী হওয়ার মতো কী-কী রয়েছে, কোন এলাকার ভিডিয়ো—এইসব তথ্য খতিয়ে দেখা হয়।

যে ব্যক্তি ওই পোস্ট করছেন, তাঁর ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেমন—ওই ব্যক্তি কত জনপ্রিয়, তাঁর পোস্টে সাধারণত কীরকম লাইক-কমেন্ট-শেয়ার পড়ে, ইউজ়াররা ওই ব্যক্তির পোস্টের ব্যাপারে কতটা আগ্রহী, সাম্প্রতিক পোস্টের আগের কয়েক সপ্তাহ ওই ব্যক্তির পোস্টে ইউজ়াররা কীভাবে আগ্রহী হয়েছেন, যুক্ত হয়েছেন—এইসব খতিয়ে দেখা হয়।

যে ইউজ়ারের নিউজ়ফিড নিয়ে কাজ চলছে, তাঁর গতিবিধিও নজরে রাখা হয়। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট ইউজ়ার কী ধরনের পোস্ট দেখতে পছন্দ করেন, কোন ধরনের পোস্টে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার করেন অর্থাৎ ইন্টার‍্যাক্ট করেন, এটা দেখলে বোঝা যায় যে ওই ইউজ়ারের পছন্দ ঠিক কীরকম। এর ফলে ওই ইউজ়ারের পছন্দ অনুযায়ী পোস্ট তাঁর ফিডে শো করায় ইনস্টাগ্রাম। বাকি জিনিস ফিডে আসেই না।

নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির পোস্টে একজন ইউজ়ার কীভাবে যুক্ত হচ্ছেন অর্থাৎ এনগেজড হচ্ছেন (কারণ এনগেজমেন্ট বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগোরিথম-এর ক্ষেত্রে), তার উপরেও নির্ভর করে শ্যাডোব্যানিং। যাঁর পোস্টে কোনওদিনই একজন নির্দিষ্ট ইউজ়ার যুক্ত হন না, তাঁর পোস্ট ওই ইউজ়ারের ফিডে আসা বন্ধ হবে।

অর্থাৎ মোসেরির কথা অনুযায়ী, একজন ইউজ়ার অন্যান্য ইউজ়ারের বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইনফ্লুয়েন্সার কিংবা জনপ্রিয় ইউজ়ারের পোস্টে কীভাবে যুক্ত হন, রিঅ্যাক্ট করেন, তার উপর নির্ভর করে শ্যাডোব্যানিং। অন্য দিকে, ওই জনপ্রিয় ব্যক্তির পোস্টের খুঁটিনাটিও খতিয়ে দেখা হয়।

instagram shadowbanning

ইনস্টাগ্রামে কিন্তু একটি অ্যালগোরিথম থাকে না…

মোসেরি জানিয়েছেন, একাধিক অ্যালগোরিথম ‘শ্যাডোব্যানিং’ করা হয়। প্রতিটি অ্যালগোরিথমের জন্যই আলাদা-আলাদা কারণ এবং যুক্তি থাকে। সাধারণত ইউজ়াররা তাঁদের ফিডের ৭০ শতাংশ দেখতে পান না। আর যে অংশ দেখতে পান তার উপরেই চলে অ্যালগোরিথমের হিসেবনিকেশ।

ইনস্টাগ্রাম ফিড এবং স্টোরি—এক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয়ে মূলত নজর দেওয়া হয়, সেগুলিকে বলে অ্যালগোরিথম সিগন্যাল। এগুলি হল-

১। কী বিষয়ে পোস্ট করা হয়েছে

২। কে পোস্ট করেছেন

৩। তার সঙ্গে ইউজ়ারের আগে যোগাযোগ কেমন, অর্থাৎ তার পোস্টে কীভাবে ইউজ়ার যুক্ত অথবা এনগেজড হয়েছেন

৪। একজন ইউজ়ার কোন পোস্টে কীভাবে লাইক, কমেন্ট করছেন, কতক্ষণ কী ধরনের পোস্টে থাকছেন, কী শেয়ার করছেন, কোন পোস্টে ট্যাপ করছেন, এইসবকিছুর উপর নির্ভর করেই ইউজ়ারের পছন্দ-অপছন্দ অনুমান করে ইনস্টাগ্রাম।

instagram shadowbanning

র‍্যাঙ্কিং এক্সপ্লোর

অনেকসময়েই ইউজ়ারের ফিডে ‘এক্সপ্লোর’ অপশন আসে। অর্থাৎ নতুন ইনস্টাগ্রামারদের অ্যাকাউন্ট দেখানো হয়, যাঁদের ফলো করা সম্ভব। এক্ষেত্রে একজন ইউজ়ার ফলো করলে একরকম অ্যালগোরিথম হয়। ফলো না করলে আর একরকম হয়।

ইনস্টাগ্রাম রিলস

এক্ষেত্রে ইউজ়ার যাঁদের ফলো করেন না, তাঁদের রিলস-ই বেশি দেখানো হয়। এবার ইউজ়ার কী ধরনের রিলস দেখছেন, কার রিলস দেখছেন, সেইসব দেখে ইউজ়ারের সম্পর্কে অনুমান করতে পারেন ইনস্টাগ্রাম-কর্তৃপক্ষ।

গ্র্যাফিক্স এবং অলংকরণ- অভিজিৎ বিশ্বাস