প্রীতম দে
“আমি সাইকেলে বাংলাদেশ ঘুরেছি তো, তাই খুব কাছ থেকে দেখেছি একুশের সৌধ। মিউজিয়াম। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ি।”
সাইকেলে বাংলাদেশে। অশান্ত বাংলাদেশ নয়, কয়েকমাস আগে ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবসে বাংলাদেশ গিয়েছিলেন কলকাতার ছেলে সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে কোথায় কোথায় গিয়েছেন সাইকেল আর বাইকে, চিন্তাও করতে পারবেন না।
সোমনাথ ভ্রমণ পাগল। সোমনাথ অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। দু’চাকায় ভর দিয়ে অর্ধেক বিশ্ব ঘুরে নিয়েছেন। বাদ যায়নি করোনার সময়ও। কোভিড যখন সবে ছড়িয়ে পড়ছে তখনও তিনি সাইকেলে সওয়ার হয়ে ভিনদেশের পথে পথে।
থাইল্যান্ডের ফুকেট, সুরাত থানি, কো সামুই, কো ফাঙ্গান, কো তাও, থাইল্যান্ডের বিখ্যাত দ্বীপ ঘুরে ব্যাংকক। সবটাই সাইকেলে। এখন আবার ডবল ক্যারি করে ১০ বছরের ছেলেকে নিয়েও বেরিয়ে পড়েন। দেশের মধ্যে ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ছেলেকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরে ফেলেছেন। বাকি ছিল পাশের দেশ বাংলাদেশ । আর সে দেশে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভাল সময় কী হতে পারে ভাষা দিবস ছাড়া?
৫০০ কিলোমিটার পথ। কলকাতা টু ঢাকা। গেদে দর্শনা সীমান্তে সাইকেল নিয়ে প্রবেশ করলেন যখন সকাল ১১ টা। মুজিব নগর। বাংলাদেশে সোমনাথের প্রথম স্টপ। দর্শনায় ঢুকে খুব একটা আলাদা লাগেনি। কারণ একই ভাষা এবং একই রকম সংস্কৃতি। মুজিব নগরে থাকা। রাত কাটানো। খাওয়া দাওয়া। এলাহি আয়োজন। কত রকমের যে মাছ। বলে শেষ করা যাবে না। ইলিশ বিরিয়ানি।
চতুর্থ দিন সকালে সাইকেলে গেলেন যাদুঘর দেখতে। সেখানকার স্বাধীনতা এবং সেখানে দেশ গড়তে কীভাবে ভারত তাদের সাহায্য করে সে সম্পর্কে অনেক তথ্য স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। জায়গাটি খুব সুন্দর এবং আতিথেয়তা আপনাকে নিশ্চিতভাবে বিস্মিত করবে। বললেন, “এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক যে আমরা প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ কিমি সাইকেল চালিয়েছি। কিন্তু কখনই ক্লান্ত বোধ করিনি। সন্ধ্যায় লালন ফকির মাজার। তাঁর লেখা লোকগান উপভোগ করলাম, সোমবার ছিল।” নামেও সোমনাথ, কাজেও তিনি শিব ভক্ত। তাই বাবার বারে পূজা করার জন্য একটি শিব মন্দির খুঁজছিলেন, পাওয়া গেল। এটা চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল।
“পঞ্চম দিন আমরা কুষ্টিয়া থেকে শুরু করে রাজবাড়ি পর্যন্ত যাব, এর মধ্যে আমাদের শিলাইদহ ঘুরতে হবে, সন্ধ্যায় আমরা রাজবাড়ি পৌঁছেছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠি কারণ প্রচুর টিভি চ্যানেল খবরের পূর্বাভাস দিচ্ছে, ততক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা অনেক উৎসাহ পাচ্ছিলাম। রাইড শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় আবার স্থানীয় এলাকা পরিদর্শন। বাংলাদেশ পুলিশের সাহায্য পেয়েছি, তারা নিরাপদ করিডর দিচ্ছিল যাতে রাস্তায় কোনও ঝামেলায় পড়তে না হয়।
পরের দিন শেষ দিন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি। সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছলাম, পথে আমরা জাতীয় শহিদ স্মৃতিসৌধ দেখলাম। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ করতেই সেই বিখ্যাত ব্যস্ত রাস্তা।” স্মৃতির সরণিতে ডুব দিয়ে বললেন সোমনাথ।
এখানে না থেমেই বললেন, “বিকেলে আমরা স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করি এবং সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা, ধানমুন্ডি, মুজিবর রহমানের বাড়ি। জাতির পিতা। বাংলাদেশ গ্রুপের সঙ্গে আমাদের যাত্রা এখানেই শেষ।” ঢাকায় কিছু বন্ধু ছিল। তাদের ডেকে দলবেঁধে সেখানে গিয়েছিলেন। সোমনাথের কোথায়, “এখানে আমরা আরেকটি ভারত পেয়েছি। তারা ভারতের সঙ্গে খুব পরিচিত কারণ সেখানকার অর্ধেক পরিবার ভারতে থাকে, তারা বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে ভ্রমণ করে। যেমন চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা ইত্যাদি। আমরা ঢাকায় একটি চমৎকার পরিবার পেয়েছি। তারা আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠল, ২১শে ফেব্রুয়ারির জন্য আমরা সত্যিই অবাক হয়েছিলাম। বেশিরভাগ ছাত্র, আমি আমার এক বন্ধু জাকিরের সঙ্গে দেখা করি। আমরা কলকাতায় একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। আমরা ১৯ বছর পর দেখা করি। কিন্তু মনে হল যেন ১৯ বছর নয় ১৯ সেকেন্ড।”
২১শে ফেব্রুয়ারি ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে শহিদ মিনার। অনেক ভিড়। সবাই দেশীয় পোশাক পরেছে। পটভূমিতে বিখ্যাত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি” গানটি বাজছিল। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য সেই বিশেষ দিনে ছাত্রদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার জন্য প্রত্যেকে ফুল দিতে যাচ্ছে।
সোমনাথ বললেন, “ঘটনাচক্রে শিবরাত্রি আর একুশে ফেব্রুয়ারি এক দিনে পড়েছিল। আমি আগের দিন থেকে উপোস করে ছিলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কিছু ছাত্র যখন জানতে পারে, আমাকে শিব মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুজো দেবার সব ব্যবস্থা করে দেয়। মনে থাকবে।”
ভাষাদিবসে কলকাতা থেকে ঢাকা সাইকেলরাইড। ২০২০ ফেব্রুয়ারি ২১ এ, দর্শনা রাজশাহী মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকা, অসাধারণ একটা অ্যাডভেঞ্চার। “অনবদ্য আতিথেয়তা, গেদে বর্ডার ক্রস করে যখন ঢুকলাম। পথ-ঘাট, নদী, পাখি, মানুষ ভাষা সব এক। সাত দিনের সাইকেল রাইডে কখনও বুঝতে পারিনি অন্য দেশে আছি । আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ ওদের কাছে।
আমি বাইকে লাদাখ থেকে কন্যাকুমারী। কলকাতা থেকে গুজরাট অবধি গেছি। সাইকেলে থাইল্যান্ড-বাংলাদেশ গেছি, এবছর সাইকেল নিয়ে নভেম্বরে সিঙ্গাপুর যাব। আর নেক্সট জুনে আমার স্বপ্নের রাইড ইউরোপে যাব আমার সাইকেল নিয়ে। আমি অনেক ঘুরেছি। কিন্তু বাংলাদেশের ভালবাসা আমি চিরদিন মনে রাখব।” কথাগুলো যখন বলছিলেন, চোখটা চিকচিক করছিল সোমনাথের।
মজার কথা হল থাইল্যান্ডে হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে লিক হয়নি বাঙালির সাইকেল।
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)