Explained: সত্যিই কি লাতিন আমেরিকার ‘কমরেড’ মমতা?

সুমন মহাপাত্র | Edited By: সঞ্জয় পাইকার

Mar 13, 2025 | 9:33 AM

EXPLAINED: তিনি আজীবন সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছেন। সেই সিপিএম-কে হারিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু, তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকৃত বামপন্থী বলে মনে করেন একাধিক তৃণমূল নেতা। কেউ বলছেন, তৃণমূল সুপ্রিমোর মধ্যে লাতিন আমেরিকার বামপন্থা রয়েছে। বামপন্থার লক্ষ্য কী? মমতার বামপন্থা নিয়ে কী বলছেন তৃণমূল নেতারা? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...

Explained: সত্যিই কি লাতিন আমেরিকার কমরেড মমতা?
মমতার বামপন্থা নিয়ে কী বলছেন তৃণমূল নেতারা?
Image Credit source: TV9 Bangla

Follow Us

কলকাতা: হার না মানা জেদ। আক্রান্ত হয়েছেন। আরও মনের জোর নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই বামেদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকৃত বামপন্থী বলে মনে করেন একাধিক তৃণমূল নেতা। তাঁর জীবনযাত্রা, সাধারণ মানুষের জন্য তিনি যা যা পদক্ষেপ করেছেন, সেগুলি প্রকৃত বামপন্থীর লক্ষণ বলে তাঁদের বক্তব্য। আবার রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কথায়, তৃণমূল সুপ্রিমোর মধ্যে লাতিন আমেরিকায় বামপন্থা রয়েছে। এই নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা? বামেরা কী বলছে?

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই মমতার-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের পথচলা শুরু কংগ্রেসের হাত ধরে। ১৯৮৪ সালে প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারান তিনি। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। সিপিএমের বিরোধিতা করতে গিয়ে আক্রান্তও হতে হয়েছে মমতাকে। পিছু হটেননি। কখনও সিপিএমের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজিয়েছেন। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে অনশনে বসেছেন। শেষপর্যন্ত মমতার হাত ধরেই ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদল হয়। ৩৪ বছর পর রাজ্যে ক্ষমতা হারায় বামেরা।

এই খবরটিও পড়ুন

২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যে তৃণমূলের শক্তি ক্রমশ বেড়েছে। আর সিপিএম তথা বামেদের শক্তি কমেছে। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তখনই তৃণমূলের একাধিক নেতা বলছেন, মমতাই প্রকৃত বামপন্থী। কেন তাঁরা একথা বলছেন, সেই যুক্তিও তুলে ধরেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বামপন্থা নিয়ে ব্রাত্য বসু-

গত ১ মার্চ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবকুপার বার্ষিক সাধারণ সভায় গিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সেখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বিভিন্ন বাম ছাত্র সংগঠনের পড়ুয়ারা। তখনই মমতার বামপন্থার কথা তুলে ধরেন ব্রাত্য বসু। তবে তাঁর মুখে শোনা যায়, লাতিন আমেরিকার বামপন্থার কথা।

ব্রাত্য বসু বলেন, “‌যে বামপন্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা চিহ্নিত করি, সেটা একেবারেই সোভিয়েত রেজিমেন্টেড বামপন্থা নয়। ওটা আসলে লাতিন আমেরিকান বামপন্থা। যার মাথায় একজন জনসম্মোহনকারী নেতা থাকেন। মাঝে একটা ঢিলেঢালা পার্টি, নিচে জনগণ থাকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও আন্দোলন হয়েছে। সেই আন্দোলনের নেতাদের এখন আর দেখতে পাবেন না। তাঁরা এখন সব ভিন রাজ্যে বা বিদেশে। তাঁদের রাজ্য নিয়ে কিছু যায় আসে না। এরা শুধুই অ‍্যাটেনশন সিকার। এরা ভুয়ো মতাদর্শ নিয়ে চলে।”‌

মমতার বামপন্থা নিয়ে কী বললেন কুণাল?

মমতাকে কেন প্রকৃত বামপন্থী বলা হচ্ছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করলেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, “বামপন্থী বলতে সাধারণভাবে যা যা বোঝায়, ইতিহাস যা বলে, বামপন্থীদের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলি যা যা বলে, সেই সংজ্ঞাগুলি মানলে এই সিপিএম প্রকৃত বামপন্থী নয়। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনযাত্রা, দৃষ্টিভঙ্গি, প্রত্যন্ত, মেহনতি ও কৃষক পরিবারের হয়ে লড়াই। অনেক বিশেষজ্ঞই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, আদর্শ বামপন্থী সংজ্ঞার উপাদানগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে রয়েছে। বহু বিশ্লেষক বলেছেন।”

এরপরই নিজের সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একসময় সিপিএমের এক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র সরোবরে সবুজ বাঁচাও আন্দোলন করেছিলেন নাগরিক সমাজকে নিয়ে। বহু পেশার বিশিষ্ট মানুষজন সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। সেইসময় মধ্য কলকাতার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের বামফ্রন্ট সমর্থিত নির্দল পুরপিতা ছিলেন ডক্টর কেপি ঘোষ । তিনিই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অগ্নিকন্যা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই মেয়েটি অগ্নিকন্যা। এর কণ্ঠ বামপন্থীদের কণ্ঠ। পরে অনেক বিশেষজ্ঞের তুলনামূলক ব্যাখ্যার সময় এই বিষয়টা উঠে আসে। যাঁরা বৃহত্তর রাজনীতির চর্চা করেন, তাঁরা এই মিলগুলি খুঁজে পেয়েছেন। তাই বলেছেন।”

বামপন্থা নিয়ে সিপিএমকে আক্রমণ করে কুণাল বলেন, “বামপন্থা মানে সিপিএম নয়। সব রাজনীতির একটা কথা হচ্ছে, দিনের শেষে সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান। আর বেঁচে থাকার অধিকার। ঐক্যবদ্ধ, সম্প্রীতির সমাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজগুলো করছেন। বহু বামপন্থী শাখা বলে, সিপিএম বামপন্থা থেকে সরে গিয়েছে। আবার বহু বামপন্থী বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি বামপন্থী। ফলে এই জায়গাটা চলে আসছে। দিনের শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষের বন্ধু। তাঁর কর্মপদ্ধতি এবং চিন্তাভাবনার সঙ্গে যদি বামপন্থার পুঁথিগত সংজ্ঞার উপাদানের মিল পাওয়া যায়, তাহলে অনেকে তা বলতেই পারেন।”

মমতাকে প্রকৃত বামপন্থী বলছেন ঋতব্রত-

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকৃত বামপন্থী বলে মনে করেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় সিপিএম নেতা ছিলেন। সিপিএমের রাজনীতি করে আসা ঋতব্রত কেন মমতাকে প্রকৃত বামপন্থী মনে করেন, সেই ব্যাখ্যাও দেন। কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, “২০০০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত একটা প্রকল্প ছিল এসএসওয়াই। সেই প্রকল্পে একজন ঠেলাওয়ালা যদি মাসে ৩০ টাকা দেন, তবে সরকার দিত ২৫ টাকা। সবমিলিয়ে জমা পড়বে ৫৫ টাকা। আর যদি ঠেলাওয়ালা তা না দিতে পারেন, প্রকল্পের সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। বামেদের সময় মাত্র ৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এটা হতে পারে না। একজন ঠেলাওয়ালাকে মাসে ৩০ টাকা দেবে, তবে সরকার ২৫ টাকা দেবে। কোনও টাকা দিতে হবে না। পুরো টাকাটাই দেবে সরকার। টাকা জমাবে। প্রফিডেন্ট ফান্ড নেই তো কী হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন। ৬০ বছর বয়স হলে ২ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা পাবেন। এটাই বামপন্থা। বামপন্থা বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আলিমুদ্দিনের দস্তাবেজের মধ্যে বামপন্থা থাকে না।”

মমতার বামপন্থা নিয়ে কী বলছে সিপিএম?

তৃণমূলের নেতারা বলছেন, লাতিন আমেরিকার বামপন্থার সঙ্গে মেলে মমতার বামপন্থা। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা। যেখানে প্রকল্পের সুবিধা সবাই পান। কোনও ভেদাভেদ হয় না। এই নিয়ে সিপিএম নেত্রী দীপ্সিতা ধর বলেন, “বামপন্থার প্রাথমিক যে কথা, তা হল সম্পত্তি, ক্ষমতার বণ্টন। লক্ষ্মীর ভান্ডার কিংবা অন্য স্কিমগুলি জনকল্যাণকারী রাষ্ট্রের অংশ। জনকল্যাণকারী আর বামপন্থী রাষ্ট্রের মধ্যে একটা প্রাথমিক পার্থক্য রয়েছে। ১৯৭৭ সালে বামপন্থী সরকার গঠনের পর প্রথম কাজ করা হয়েছিল, ক্ষমতার বণ্টন, সম্পত্তির বণ্টন। জমিহীন কৃষকের কাছে জমি পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। আর এখন বর্গাদারদের জমি কেড়ে নিয়েছে তৃণমূলের নেতারা। পঞ্চায়েতরাজ শুরু করেছিলাম আমরা। যেখানে ক্ষমতাকে মহাকরণের অলিন্দ থেকে গ্রামের শেষ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। এখন পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে প্রহসন শুরু হয়েছে। যে সরকার ক্ষমতার বণ্টনে বিশ্বাস করে না, শুধুমাত্র জনকল্যাণকারী কয়েকটি স্কিমকে সামনে রাখে, তারা আর যাই হোক, বামপন্থী হতে পারে না। যাঁরা এইসব তথ্য সাজাচ্ছেন, তাঁরা না বামপন্থা বোঝেন, না ভেনেজুয়েলা বোঝেন, না কিউবা বোঝেন।”

কেন লাতিন আমেরিকার বামপন্থার কথা বলা হচ্ছে? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

লাতিন আমেরিকার বামপন্থা কী, সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন অধ্যাপক অর্ণব সাহা। তাঁর বক্তব্য, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা এলিট ক্লাসের। তাঁরা মানুষের ভাল চাইছেন। কিন্তু, ভাল চেয়েও সাধারণ মানুষের চেতনাকে বুঝতে পারছেন না। তাঁরা ভাবছেন, মানুষ তাঁদের অনুসরণ করবেন। তাঁদের কথা শুনে চলবেন। কিন্তু, সাধারণ মানুষ কী চাইছেন, তা বুঝতে পারছেন না। তার জন্য ব্যর্থ হচ্ছেন। আর লাতিন আমেরিকার বামপন্থা হল সাধারণ মানুষের চেতনাকে বুঝে সেইমতো পদক্ষেপ করা। ভেনেজুয়েলার হুগো চাভেজ, ব্রাজিলের লুলা দা সিলভারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই জারি রাখলেন। কিন্তু, দেশের সব স্তরের মানুষকে একটা প্যাকেজের মধ্যে আনলেন। যেটাকে গোলাপি বিপ্লব বলা হয়।”

২০০৬ সালে সিঙ্গুরে বামেদের কারখানা গড়ার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “২০০৬ সালের কথাই ধরা যাক। কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ স্লোগানকে সামনে রেখে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। তারপর সরকার সিদ্ধান্ত নিল, টাটার কারখানা সিঙ্গুরেই করতে হবে। তারা বুঝতে চেষ্টা করল না, কৃষকরা কী চাইছেন। সিঙ্গুরে কার উন্নয়ন হবে? কৃষকের জমি চলে গেলে তাঁর কী হবে? আসলে বামেদের ৩০ বছরে যে মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়েছিল, তাদের ছেলেমেয়ে ওখানে চাকরি পেত। কিন্তু, কৃষকের ছেলে দারোয়ানের চাকরি ছাড়া অন্য চাকরি পেত না। মমতা এই জায়গাতেই বুঝতে পারলেন, আমাদের যে উন্নয়ন, তা ১৫ কিংবা ২০ শতাংশের দিকে তাকিয়ে করলে হবে না। সমাজের ৮০ শতাংশ মানুষের দিকে তাকিয়ে উন্নয়ন করতে হবে। সেজন্য কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প, এই মুহূর্তে যে ৯৪টি প্রকল্প রয়েছে, তাতে রাজ্যের সাড়ে ১০ কোটি মানুষের মধ্যে ৯ কোটির বেশি মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। আমরা প্রায় সবাই কোনও না কোনও ভাবে প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছি। বিজেপির লোকও সুবিধা পায়, কোনও ভেদাভেদ নেই।”

Next Article