ভোটের পরই বারবার তৃণমূলের অফার, সাক্ষাৎকারে অকপট নওশাদ
Nawshad Siddique : কেন তৃণমূলে গেলেন না? সরকারে থাকলে তো উন্নয়নমূলক কাজে আরও সুবিধা হত আপনার?
বয়স ২৮। নবগঠিত বিধানসভার সর্বকনিষ্ঠ সভ্য। সংযুক্ত মোর্চার একমাত্র বিধায়ক। ফুরফুরার বাসিন্দা। জাঙ্গিপাড়ার ভোটার। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালেয়র প্রাক্তনী। ভাঙড়ের জনপ্রতিনিধি। ১৯ লক্ষ টাকার কৃষি জমির মালিক। ৪টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে নগদ রয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। ধর্ম থেকে রাজনীতি, পীরজাদা থেকে ‘পলিটিসিয়ান’, ময়দানি লড়াই থেকে বিধানসভায় বিরোধী — ৬ মাসের রাজনৈতিক কেরিয়ারের ব্যর্থতা থেকে সম্ভাবনা, খোলামেলা আলোচনায় নওশাদ সিদ্দিকি।
বিধানসভায় নওশাদের বন্ধু কে?
বিধানসভার ভিতরে আমার কোনও শত্রু নেই। ভেবেছিলাম, আমাকে এখানে একাই থাকতে হবে। আসার পর দেখলাম এখানে সবাই খুব ‘হেল্পফুল’। শুধু জনপ্রিতিনিধিরাই নন, বিধানসভার কর্মীরাও সহযোগিতা করেন। আমার হয়ে কাজ করে দেবে, এমন মানসকিতার মানুষ প্রচুর।
বিধানসভায় সংযুক্ত মোর্চার ‘প্রতিবেশী’ কে? বিজেপি না তৃণমূল?
আমাকে তৃণমূল বিধায়কের পাশেই আসন দেওয়া হয়েছে। আমার পাশেই বসেন উত্তরবঙ্গের এক বিধায়ক। আর খুব কাছাকাছি রয়েছেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী স্যর।
বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য শুনেছেন…?
হ্যাঁ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের সময়ই বিজেপি ওয়াকওয়াট করেছে। দু, দু’বার আমার সামনেই এমনটা ঘটতে দেখেছি। কেন্দ্র সরকারের বিরোধিতা করে রাজ্যের সরকার চিমটি কাটছে, আবার উল্টোটাও হচ্ছে। আর তখনই ‘ডিস্টারবেন্স’ হয় সব থেকে বেশি। সিনিয়র লিডার হিসেবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, তাপস রায়, নির্মল ঘোষরা সবসময়ই সদন চালানোর চেষ্টা করেন। ইতিবাচক ভূমিকা নিতে দেখেছি।
বিধানসভায় আপনার ‘শিক্ষক’ কে? কাকে দেখে অনুপ্রাণিত হন?
তাপস রায় এবং নির্মল ঘোষ। একজন চিফ হুইপ অন্যজন ডেপুটি চিপ হুইপ, আগে আমি তাঁদের নামে চিনতাম। এখানে এসে সখ্য হয়েছে।
বিধায়ক হওয়ার পর সবার প্রথম কার অভিবাদন পেয়েছেন?
(এক গাল হেসে, সাংবাদিককে বললেন ভাল প্রশ্ন করেছেন) আমাদের জাঙ্গিপাড়ার বিধায়ক স্নেহাশিষ চক্রবর্তী। উনি যথেষ্ট ভদ্রলোক। আমাকে প্রথম থেকেই ‘গাইড’ করেছেন।
বিধানসভায় নওশাদের পরিচয় ঠিক কী? আইএসএফ এমএলএ না কি সদনে বামেদের কথা বলার একমাত্র মুখ?
আমি সংযুক্ত মোর্চার বিধায়ক। এটা ঠিক, আমরা আমাদের ‘টার্গেট ফুলফিল’ করতে পারিনি, ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি সংযুক্ত মোর্চারই বিধায়ক।
কেন ব্যর্থ হলেন, কী মনে হয় আপনার?
প্রথমত, তৃণমূল-বিজেপি যা মিডিয়া প্রচার পেয়েছে, আমরা পাইনি। এমন ভাবে দেখানো হয়েছে, যেন লড়াইটা স্রেফ বিজেপি-তৃণমূলেরই হয়েছে। তার উপর সোশ্যাল সাইটের প্রচার।
দ্বিতীয়ত, সংখ্যাগুরুর কাছে পৌঁছতে পারিনি।
তৃতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু সংখ্যালঘু ভোটই পাননি, তার বাইরেও বিপুল ভোট নিজের ঝুলিতে টানতে পেরেছেন।
সিপিআইএম হারের একটা কারণ হিসেবে আইএসএফ-এর সঙ্গে জোটের কথা বলে। কী বলবেন?
স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, জোটটা একদিনে তৈরি হয়নি। একাধিকবার বৈঠক করেছি। তখন এই কথাগুলো বললে ভাল হত। দীর্ঘদিন ধরে জোটের প্রক্রিয়া চলাকালীন কেন বললেন না। আর আইএসএফ জোটে এসে লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে, সেটা রেজাল্ট দেখলেই বোঝা যাবে। ফরওয়ার্ড ব্লক অনেক কথা বলছে। রায়দিঘি, ওনদা, উলুবেড়িয়া, মীনাখা, রাজারহাট-নিউটাউন, ডায়মন্ড হারবারের মতো আসনে বুথ ধরে ধরে দেখিয়ে দিতে পারি, আইএসএফ থাকায় বামেদের ভোট বেড়েছে। উল্টে অনেক জায়গায় এমনও দেখা গিয়েছে, কংগ্রেস সিপিআইএমকে ভোট দেয়নি। ব্যর্থতার দায় শুধু আইএসএফ-এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা দুঃখজনক।
জোটসঙ্গী হিসেবে কারা সব থেকে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ? সিপিআইএম না কংগ্রেস?
কংগ্রেসের সঙ্গে মতানৈক্য থাকার কারণে দূরত্ব আছে। এখনও পর্যন্ত সিপিআইএম-এ সব থেকে কাছাকাছি রয়েছে।
জঙ্গিপুর, সমশেরগঞ্জে ভোট, ভবনীপুরে উপনির্বাচন, প্রার্থী দেবে আইএসএফ?
এই বিষয়ে আমাদের আগেই আলোচনা হয়েছে, যে যেখান থেকে কনটেস্ট করেছিল, সে সেখানেই প্রার্থী দেবে। ভবানীপুরের প্রার্থী কে হবে বা কারা দেবে, আলোচনার পরই ঠিক হবে।
জোট ভাঙলে কী করবে আইএসএফ?
প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি রেখেই লড়াই করছে সিপিএম। একই কথা বলেছে কংগ্রেসও। জন্মলগ্ন থেকে আমাদেরও একই কথা। আমরা শ্রমজীবী মানুষের কথা বলব, এটাই আমাদের নীতি। সংযুক্ত মোর্চা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও আইএসএফ তার আদর্শ থেকে সরে দাঁড়াবে না।
৬ মাসের ছোট্ট রাজনৈতিক কেরিয়ারে ফুলবদল তো অনেক দেখলেন, আপনার কাছে কখনও কোনও অফার আসেনি?
হ্যাঁ, অনেকবারই অফার এসেছে।
বিজেপি না তৃণমূল?
তৃণমূল।
কেন গেলেন না? সরকারে থাকলে তো উন্নয়নমূলক কাজে আরও সুবিধা হত আপনার?
হ্যাঁ, এটা ঠিকই। সরকারে থাকলে উন্নয়নমূলক কাজ করার ‘স্কোপ’ অনেকটাই বেশি থাকে। কিন্তু ভাঙড়ের মানুষ আমাকে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ভাঙড়ের মানুষের বিশ্বাস, আস্থা আমার উপর ছিল। তাদের ভরসা আমি কোনওদিন ভাঙতে পারব না। দুঃখ হয়, আমাদের দেশে দলত্যাগ বিরোধী আইন থাকলেও তার ‘ইমপ্লিমেনটেশন’ হয় না। এই রাজ্যে বিজেপি দলবদল নিয়ে চিৎকার করছে, অথচ কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশে তারাই সরকার ভেঙে দিয়েছে। রাজস্থানেও চেষ্টা করেছে, শেষ পর্যন্ত পারেনি।
পীরজাদা থেকে ‘পলিটিসিয়ান’, মনে হয় না এই সিদ্ধান্তে ভুল হয়েছে?
আমি শহিদ ক্ষুদিরামের জীবনী পড়ে বড় হয়েছি। কোনও ভুল করিনি। আজ আমি এসেছি, কাল আমার পরিবার থেকে অন্য কেউ আসতে পারে।
লোকসভায়ও কি প্রার্থী দেবে আইএসএফ?
রাজনীতির ময়দানে যখন এসেছি স্কুল ম্যানেজিং কমিটি থেকে লোকসভা, সব জায়গায় লড়ব।
ভাই দাঁড়িয়েছে, ভাইজান দাঁড়াবেন?
না, ভাইজান কোনও দিন ভোটে লড়বে না। তিনি রাজনীতি করাবেন, ‘কনটেস্ট’ করবেন না।
ভোটের ভরাডুবির পর ভাইজানের রাজনৈতিক নির্বাসন…
(এক গাল হেসে) নানা, কোনও নির্বাসন নয়। বিরোধীরা কিছু করতে গেলেই তো এখন নানা রকম কেস দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তার উপর কোভিড প্রোটোকল, তৃতীয় ঢেউও আসছে।
কবে ফিরবেন ভাইজান?
আনলক হতে দিন, ভাইজান ফিরবেন। ফিরবেন স্বমহিমায়।