কলকাতা: ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে গত কয়েক ঘণ্টা ধরে আলোচনা তুঙ্গে। সিগন্যাল নিয়ে যত গোলমাল। এই ‘সিগন্যাল’ বিষয়টা রাজনীতিতেও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিগন্যাল পাওয়া যায়। কখনও নেতা নেত্রীরা কর্মী সমর্থকদের সিগন্যাল দেন। কখনও দলের কর্মী-সমর্থকরা নেতা নেত্রীদের সিগন্যাল দেন। সেই সিগন্যাল বুঝতে পারলে রাজনীতির গতি দুরন্ত। কিন্তু সেটা না হলে ঠোকাঠুকি লাগার সম্ভাবনা প্রবল। তবে রাজনৈতিক সিগন্যালের একটা অন্য দিকও আছে। যেমন সিগন্যাল দেওয়ার সময়। যখন সব ভাল তখন খুব একটা সিগন্যালের প্রয়োজন হয় না। সিগন্যাল পাওয়া যায় কঠিন সময়। বঙ্গ রাজনীতিতেও এখন বেশকিছু সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। ভোটের ফল প্রকাশের পর বিজেপির অন্দরে সিগন্যালের পরিমাণ বেশি। ধাপে ধাপে অসন্তোষের সিগন্যাল বেশি। কিন্তু চমকটা অন্য জায়গায়, ভাল ফল করার পরও তৃণমূলের অন্দরে কোন্দলের একটা সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। রাজ্যে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা বিজেপির হালটাই এমন কেন?
সিগন্যালের নাম ‘সাবোতাজ’
সব জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে রাজ্যে ২৯টি আসনে জিতে বিজয় পতাকা উড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যে সবুজ আবির উড়ছে। তবে এই জয়ের পথটা মোটেই সহজ ছিল না। প্রতিপক্ষ বিজেপি বেশ কড়া টক্কর দিতেই নেমেছিল ভোটের ময়দানে। অন্যদিকে তৃণমূলের অন্দরে বেশকিছু সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল। কোন্দলের সিগন্যাল। ভোটের প্রচারে একাধিক নেতা-মন্ত্রী, প্রার্থীর কথায় উঠে এসেছিল দলের অন্দরের সাবতাজের কথা। আরামবাগের প্রার্থী মিতালি বাগকে দলের কর্মীদের সামনে হাত জোড় করে তাঁকে বলতে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেই ময়দানে নামুন।
বিভাজনের কথা উঠে এসেছিল বাঁকুড়ার প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তীর কথাতেও। দলের অন্দরে কেউ কেউ দু-নৌকায় পা দিয়ে চলছেন, এমন মন্তব্য করেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। দলের বিধায়ককে প্রচারের মঞ্চ থেকে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। তলে তলে কোন্দলের কথা উঠে এসেছে তমলুকের তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্যের কথাতেও। দেবাংশু ভট্টাচার্য, মিতালি বাগ, অরূপ চক্রবর্তীদের এই মন্তব্য ভোটের সময় বেশ চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভোটের পর, বিশেষত দুরন্ত সাফল্যের পর কেন এই ধরণের কথা হবে? রাজনৈতিক মহলে এটাই এখন সব থেকে চর্চার বিষয়। ২৯টি আসন জেতার পরও তৃণমূলের পিছু ছাড়ছে না অন্তর্ঘাত কাঁটা?
ঠোকাঠুকির শেষ কোথায়?
ভোটের ফল প্রকাশের পর বঙ্গ রাজনীতিতে কাঠি শব্দটার আমদানি হয়েছিল দিলীপ ঘোষের মুখ থেকে। সেই কাঠি তৃণমূলের মুখে আসতেই হইচই। কিন্তু বিজেপিও যে পিছিয়ে নেই। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে কোন্দলের কাঁটা তাদেরও বেশ খোঁচা দিচ্ছে। উঠেছে সাবোতাজের গন্ধও। উপনির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার পর হইচই আরও বেশি। অবস্থা সামাল দিতে বেশ হিমশম খেতে হচ্ছে কেন্দ্র থেকে রাজ্য নেতৃত্বকে। তা সে যতই অল ইজ ওয়েল বোঝানোর চেষ্টা হোক না কেন।
৪ জুন ফল প্রকাশের পর থেকেই রাজ্য বিজেপির অন্দরে উথাল পাতাল। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ একের পর এক বোমা ফাটালেন। নিশানায় রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব। কারও নাম দিলীপ ঘোষ করেননি। কিন্তু রাজনৈতিক মহলের বুঝতে কিছুই বাকি ছিল না, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের। চর্চা যখন তুঙ্গে তখন নীরবতা ভেঙে আসনে নামেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। সোজা-সাপটা উত্তর এসেছিল তাঁর মুখ থেকে। বিতর্ক পিছনে ফেলে দলের কাজে ঝাঁপিয়েছিলেন নতুন উদ্যোমে।
তবে বাদ যাননি, সুকান্ত মজুমদার, সৌমিত্র খাঁ, জগন্নাথ সরকারের মত জয়ী সাংসদরাও। শীর্ষ নেতাদের কথার লড়াইয়ে যবনিকা পরার আগেই উপনির্বাচনের ঘণ্টা বেজে উঠল। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে, প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হতেই দিকে দিকে বিক্ষোভ। রায়গঞ্জ, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রীর বিজেপি কর্মী সমর্থকদের প্রার্থী পছন্দ নয়। এতেই শেষ নয়। ভোট পরবর্তী হিংসায় ঘড়ছাড়া ও আক্রান্ত কর্মীদের দেখতে এসে বিক্ষোভের মুখে বিজেপি কেন্দ্রীয় দল। ডায়মন্ড হারবারের আমতলায় কেন্দ্রীয় দলের সদস্যদের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখালেন বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। তাঁদের ক্ষোভ ডায়মন্ড হারবার সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অভিজিৎ সরদারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, ভোট হিংসার শিকার হলেও জেলা সভাপতি চক্রান্ত করে তাঁদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করতে দেননি।
শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে ঠোকাঠুকি। দলের কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ। ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকে জোড়া ফুলের মতো পদ্ম ফুলের অন্দরেও কোন্দল কাঁটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখা বিজেপির কাছে তৃণমূলের থেকেও কী এখন বড় চ্যালেঞ্জ দলের অন্দরের কোন্দল কাঁটা সামলানো? প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।