Orphan Child: পালক বাবাকে হারিয়েও স্বস্তি নেই, একরত্তির সঠিক ঠিকানা খুঁজবে শিশু সুরক্ষা কমিশন

Howrah: সোমবার, শিশুর মানসিক অবস্থার কথা বিচার করে বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চ শিশু সুরক্ষা কমিশনকে ওই শিশুকন্যার ব্য়াপারে  খোঁজ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

Orphan Child: পালক বাবাকে হারিয়েও স্বস্তি নেই, একরত্তির সঠিক ঠিকানা খুঁজবে শিশু সুরক্ষা কমিশন
জুলি রায় ও সেই একরত্তি, নিজস্ব চিত্র
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 29, 2021 | 10:04 PM

কলকাতা: স্বস্তি নেই সালকিয়ার ছোট্ট মেয়েটার জীবনে। আদৌ কোথায় তার সঠিক ঠিকানা, তা খুঁজে দেখবে শিশু সুরক্ষা কমিশন, এমনটাই নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে আইনি জটিলতা। ক্রমে ক্রমেই মনোবল ভাঙছে জুলি রায়ের। যতই হোন না তিনি পালক-মা। তবু নিজের ‘বুকের ধনের’ মতোই বড় করেছেন ওই একরত্তিকে।

এই টানাপোড়েনের মধ্যেই নিজের পালক-পিতা জহর রায়কে হারিয়েছে ওই সাড়ে চার বছরের শিশুকন্যা। এরইমধ্যে জন্মদাতা বাবার কাছে সপ্তাহে একদিন গিয়ে থাকা যেন তার কাছে চরম বিড়ম্বনা। একলা মেয়েটা সালকিয়ার বাড়িতে তার প্রয়াত পালক বাবাকেই খুঁজে চলেছে এঘর-ওঘর। জন্মদাতা বাবাকে সে চেনেই না! আদালতের নির্দেশে ফি শনিবার তার নিজের বাবার কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু, ওইটুকু মেয়ে কোলছাড়া হতে চায় না জুলি রায়ের।

শনিবার-শনিবার করে মায়ের কোল ছেড়ে নিজের জন্মদাতা বাবার কাছে যেতে হবে শুনেই কেঁদে ভাসায় ছোট্ট মেয়েটা। কান্নাকাটি করে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। উপরন্তু পালক-বাবার মৃত্যুও সে বোঝে না। চতুর্দিকে খুঁজে বেড়ায় জহরবাবুকেই। সাড়ে চার বছরের ওই খুদের এমন অবস্থা দেখে অবশেষে কিছুটা হলেও নমনীয় হতে হয়েছে আদালতকে।

সোমবার, শিশুর মানসিক অবস্থার কথা বিচার করে বিচারপতি সৌমেন সেনের ডিভিশন বেঞ্চ শিশু সুরক্ষা কমিশনকে ওই শিশুকন্যার ব্য়াপারে  খোঁজ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোথায় তার সঠিক ঠিকানা তা খোঁজ নেবে কমিশন। সেই বিস্তারিত রিপোর্ট ৬ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানিতে আদালতে জমা দেবে শিশু সুরক্ষা কমিশন। তবে আইনজীবী শুভাশিস দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে শিশুর মানসিক অবস্থাই গুরুত্ব পাবে সর্বাধিক।

আদালত সূত্রে আগেই জানা গিয়েছিল, বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, আপাতত ওই একরত্তি মেয়েটা থাকবে তার পালক মা-বাবার কাছেই। সপ্তাহান্তে আদালতে আইনজীবীদের সামনে তাকে তার বাবার কাছে পাঠানো হবে। গোটা একদিন বাবার সঙ্গে কাটানোর পর ঠিক রাত ৯ টায় ওই মেয়ে ফিরে যাবে শালকিয়ায় তার পালিকা মায়ের বাড়িতে। এইভাবে চলবে টানা দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহ পরে ফের আদালতে আনা হবে ওই শিশুকে। তার সঙ্গে কথা বলবেন আইনজীবীরা। যদি, তখন শিশুটি তার জন্মদাতা বাবার কাছে ফিরে যেতে চায়, তবে তাই হবে। আর যদি পালক পরিবারের কাছেই থাকতে চায়, তাহলে সেই সিদ্ধান্তই মঞ্জুর হবে।

সেদিন, এজলাসে সওয়াল জবাব চলাকালীন, মেয়েটির জন্মদাতা বাবা দাবি করেন, তিনি অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। তাঁর জীবনযাপনের সঙ্গে তাঁর সন্তানের বর্তমান পরিস্থিতি খাপ খায় না। তিনি মেয়েকে আরও বড় স্কুলে পড়াতে চান। সন্তানের ভবিষ্যত্‍ সুনিশ্চিত করতে চান। যদিও জন্মদাতা বাবার এই আবেদন কার্যত খারিজ করে দেন বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী। বিচারপতির কথায়, “আপনার সন্তান নিজে বিলাসবহুল জীবন বেছে নেবে না গরিব ঘরে থাকবে সেটা সে-ই ঠিক করবে। তাই সিদ্ধান্তটা তারই। তবে শিশুমনে কোনও প্রভাব পড়বে এমন কোনও সিদ্ধান্ত আদালত নেবে না। শিশু থাকবে তার চেনা পরিবেশেই। যাতে এই আইনি লড়াই তার মনে কোনও গভীর প্রভাব না ফেলে।”

ঘটনায়, হাইকোর্টের বাদী-বিবাদী পক্ষের উভয় আইনজীবীও জানিয়েছেন, মা-বাবাদের এমন আইন লড়াইয়ে কার্যত মনোকষ্টে ভোগে শিশুরা। আইনি এই টানাপোড়েন সর্বাধিক প্রভাব ফেলে  শিশুদের মনে। ফলে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় শিশুদের।  হাওড়া শালকিয়ার এই একরত্তির অবশ্য কী হবে তা নির্ভর করবে আদালতের আরও পর্যবেক্ষণের পর।

জন্মেই বাবাকে দেখেনি সে। যখন চারমাস বয়স, বাবা ছেড়ে চলে যান। বোধ হওয়ার আগেই সাতমাস বয়সেই আত্মহত্যা করেন মা। তারপর দিদার কাছে কিছুদিনের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল একরত্তি মেয়েটা। কিন্তু, কোথায় কী! বিধি বাম তার! মা-মরা মেয়েটার সেই আশ্রয়টাও চলে গেল। আত্মঘাতী হলেন দিদাও। ওইটুকু মেয়ে যাবে কোথায়! নিজের মনে করে কোলে তুলে নিয়েছিলেন জুলি রায়। বড়ও করেছেন ওই একরত্তি একেবারে নিজের মেয়ের মতোই। জুলি যেন যশোদা! কিন্তু, বাদ সেধেছে, মেয়ের জন্মদাতা বাবা। হাইকোর্টে মামলা করে নিজের মেয়েকে ফেরত চেয়েছেন তিনি। কী হবে সেই একরত্তির? TV9 বাংলায় উঠে আসে সেই একরত্তির কাহিনী।

রূপকথায় সেই যে কবে সুয়োরানি-দুয়োরানির গল্পে যেমন শোনা যেত, এ মেয়ের গল্প যেন তেমনই। ছোট্ট মেয়েটা জানে না আইনের মারপ্যাঁচ। বড়দের জটিল জগত। হাতে ডলপুতুল নিয়ে দাদার কোলে খেলে বেড়ায় সে। মায়ের সঙ্গে হাত ধরে ঘুরতে যায়। বাবার কোলে বসে মুছিয়ে দেয় চোখের জল। একরত্তি জানে না, কীভাবে বুকে পাথর চেপে রেখেছেন জহর-জুলি।

হাওড়ার বাসিন্দা জহর রায়  ও জুলি রায়। নিজেদের সন্তান বলতে একটি ছেলে। এলাকারই এক প্রতিবেশীর বাড়িতে আসত ওই একরত্তি। সে ছিল ওই মেয়ের মামাবাড়ি। একরত্তি মা-হারা মেয়েটা দিদার আশ্রয়ে বেড়ে উঠছিল। কিন্তু, সে দিদাও আত্মঘাতী। কোথায় যাবে ওটুকু মেয়েটা! নিজের মেয়ে নেই, তাই মেয়ের অভাব যেন পূরণ করলেন ওই ছোট্টটিকে দিয়ে। একেবারে নিজের মেয়ের মতো কোলে তুলে নিলেন একরত্তিকে। তখন তার বয়স সাত মাস। হ্যাঁ, মেয়েটার জন্মদাতা বাবাকে খবর দেওয়া হয়েছিল। তবে দিদা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও মেয়েকে দেখতে আসেননি তিনি। অস্বীকার করেছেন বরং। জানতেও চাননি মেয়ে বেঁচে রয়েছে কি না। অথচ, তাঁরই সন্তান ওই পুঁচকে মেয়েটা!

বোধ হওয়ার পর থেকে যখন প্রথম মুখে বুলি ফুটল তখন, জহরকেই সে বলতে শিখল বাবা, জুলিকে মা। রায় পরিবারেরই সদস্য হল সে। পুঁচকের পরিচয় হল রায়বাড়ির নামেই। এখন সে সদ্য পেন্সিলে আঁক কাটতে শিখেছে। স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। জুলিই তাকে বাড়িতে বসে শেখান ‘অ আ, ক, খ’। পালক-মায়ের সঙ্গেই মেয়েটা সুর তুলে বলে, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে।’

এরই মাঝে বিপদ। যেন কোনও ফিল্মের টার্নওভার। মেয়েকে নিজের কাছে ফেরত চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ জন্মদাতা বাবা। আগেও এমন আইনি লড়াই হয়েছে। তখন হাওড়া আদালত রায় দিয়েছিল, মেয়ে ১৫ বছর বয়স অবধি তার দিদার কাছে থাকবে। তারপর, সে নিজে নির্বাচন করবে সে কার সঙ্গে আদপে থাকতে চায়। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু, জন্মদাতা বাবার মন ভরেনি। আপিল করেছেন হাইকোর্টে। মামলার জল এতদূর গড়ায় শঙ্কিত রায় পরিবারও।

জুলির কথায়, “যখন ওর কেউ ছিল না, ওর বাবা আসেনি। দিদা মারা গিয়েছে, আমার খবর দিয়েছি। আসেনি। যোগাযোগই করেনি। ওইটুকু মেয়ে কোথায় যেত! তারপর আজ ওর বাবা হাইকোর্টে গিয়েছে। জানি না আদালত কী রায় দেবে। তবে ও তো আমাদেরই মেয়ে! ওকে আমরা সেভাবেই বড় করেছি। ও বুলি ফোটার পর থেকে আমাকেই মা বলে জানে।”

অন্যদিকে, জুলির স্বামী জহর বলেন, “ভয় পাই, খুব ভয় পাই! এই বোধহয় মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! ওর বাবা তো কোনও যোগাযোগই করেনি। আজ হাইকোর্টে গিয়ে মামলা করছে। যখন ওর জ্ঞান ছিল না, তখন কোথায় ছিল! আমরাই তো ওকে বড় করেছি। ও তো আমাদেরই মেয়ে।” বলতে বলতেই চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে জহরের। ছোট্ট মেয়েটা অবাক হয়ে দেখে তার বাবা কাঁদছে। হাতের তালু দিয়ে বাবার চোখ মুছিয়ে দেয় সে। স্নেহ বড় বিষম বস্তু! ও যে জানে না এই কঠোর সত্যিটা। জানে না বড়দের দুনিয়াটা কতটা রুক্ষ।

রবি দত্ত নামে ওই শিশুরই এক প্রতিবেশী অবশ্য বলেছেন, “জুলি বৌদি ছোট থেকে মেয়েটাকে বড় করল। নিজের মেয়ের মতো। ওর বাবা তো আসেওনি। আমরা তো বলেইছি জহরদা’দের, কোনও সমস্যা হলে আমরা পাশে রয়েছি।” তাও কি মায়ের মন মানে! বুকের ধনকে কেউ যদি ছিনিয়ে নিতে চায়! তবে আইন কী বলছে?

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় যদিও জানিয়েছেন, আইনের পরিভাষা অন্য। যদি, ওই শিশুর জন্মদাতা বাবা কোনও যোগাযোগ না আচমকাই মেয়ের অধিকার দাবি করেন, তবে তিনি সঙ্গে সঙ্গে অধিকার পেয়ে যাবেন এমনটা নয়। সেক্ষেত্রে আদালত সবার আগে দেখবে, আদৌ ওই মেয়ের বাবা তাঁর সন্তানের দায়িত্ব নিতে সক্ষম কি না। যদি তা হয়েও থাকেন, তবে ওই  একরত্তি কি তাঁর কাছে খুশি থাকবে, নাকি যেভাবে তার পালক পরিবারের কাছে সে বড় হয়ে উঠছে তাতে বেশি সুরক্ষিত থাকবে। শিশুর সু-ভবিষ্যত যথাযথ চিন্তা করেই দায়িত্ব দেওয়া হবে। তবুও মন মানেনি। এখন আদালতের দিকেই তাকিয়ে গোটা রায় পরিবার। আর যা-হোক, মেয়েকে হারাতে চান না তাঁরা। না হলই বা রক্তের সম্পর্ক। সেই কি শেষ কথা!

আরও পড়ুন: Post Poll Violence: গাঙনাপুরে বিজেপি কর্মী ‘খুনে’ ৭ মাস পর সিবিআইয়ের জালে মূল ‘চক্রী’