Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ়: পর্ব ১৮—জোজি’লা পাস পেরিয়ে লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কার্গিল, ষষ্ঠ পর্ব
Ladakh Bike Trip From Kolkata: কার্গিল যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্রসস্ত্র, পরাজিত পাকিস্তানের বাজেয়াপ্ত করা গ্রেনেড, বন্দুক, মিসাইল…পাক সীমান্ত থেকে উড়ে আসা মিসাইল-গ্রেনেডের টুকরো ইত্যাদি গ্যালারির মধ্যে রাখা আছে সযত্নে। ছক এঁকে দেখানো আছে যুদ্ধনীতি আর যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা। লেখা পড়ে জানতে পারলাম যোদ্ধাদের বীরত্বের নানান গল্প, যুদ্ধজয়ের অনেক অজানা ঘটনা।

২৭ মে
সোনমার্গের পথের চারিপাশ চোখ জুড়িয়ে দেয়। ঘন সবুজ ঘাসের উপত্যকায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে রাস্তা। চারণভূমি জুড়ে শ’য়ে-শ’য়ে পাহাড়ি ভেড়া-ছাগলের পাল রোজকার মতো সূর্যের আলো মেখে চরে বেড়াচ্ছে। দু’দিকের আকাশ লাগোয়া ঘন সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় রোদের ঝিকিমিকি। ঘন জঙ্গলের মাঝে সিঁথি কেটে নেমে এসেছে দুধসাদা বরফের স্রোত। দূরের পর্বত যেন সাদা পশমের চাদর টেনে লুকোচুরি খেলছে। কিছু পরেই বাঁ দিকের সিন্দ নদী পাশ ফেরি করে ডানদিকে চলে এল। নদীর ধারেই ছোট্ট গ্রাম বালতাল। ওপর থেকে দেখলে সেনা ক্যাম্প আর হেলিপ্যাড চোখে পড়ে। বালতালের আরও ডানদিকে চলে গিয়েছে অমরনাথ যাত্রার ন’কিলোমিটারের দুর্গম হাঁটাপথ। সবুজের গালিচা পিছনে ফেলে রেখে আমরা এগিয়ে চলেছি জোজি’লার দিকে। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখি, ফার-পাইনের সারি একে-একে আমাদের বিদায় জানাচ্ছে। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অজান্তে সামনের দৃশ্যপট জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে মাটি-পাথরের ন্যাড়া পাহাড়। কোথাও-কোথাও দু’-এক প্রস্থ জেদি একগুঁয়ে ঘাসের চাঁই মাটি কামড়ে রয়ে গিয়েছে এখনও। উল্টো দিকের পাহাড়গুলোয় এখন বরফের রাজত্ব। এ দিকে, আমাদের রাস্তা হঠাৎ করে বেশ খারাপ হয়ে এল। বাইকের গোঁঙানি বলে দিচ্ছে, ভালই চড়াই শুরু হয়েছে। একটানা না চালিয়ে তাই পাঁচ-দশ কিলোমিটার অন্তর দাঁড়িয়ে রেস্ট নিতে নিতেই যাচ্ছিলাম আমরা। পরে যখন আমি ২০২২ সালে এই রাস্তা দিয়ে যাই, তখন প্রায় অর্ধেক কাজই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। শুধু জোজি’লা পাস-এর উপরের অংশ সারানো হয়নি। খানিকটা পর থেকেই রাস্তার পাশে বরফের দেখা মিলল। ধুলো-ধোঁয়ায় চাপা পড়ে যাওয়া ছাইরঙা বরফ। দু’-এক জায়গায় হিমবাহের দেওয়াল চুঁইয়ে অল্প-স্বল্প জল পড়ছে রাস্তার উপর। তার উপর বিরক্তিকর জ্যাম। ট্যুরিস্ট গাড়ি, আর্মি ট্রাক ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় মালপত্র বোঝাই গাড়ি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। দু’পা এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। কোনওমতে পাশ কাটিয়ে কাদা-জলে মেশানো এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আজকের পথের প্রথম পাস, জোজি’লা-য়। সোনমার্গ থেকে কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা আসতে সময় লেগে গেল প্রায় দু’ঘণ্টা।

পর্বত বা পর্বতশ্রেণীর ২টো উচ্চতম অংশের মধ্যে তৈরি হওয়া তুলনামূলক কম দুর্গম পথ যা যাতায়াতের সুবিধার জন্য তৈরি হয়েছে, তাকেই ভূগোলের ভাষায় পর্বতের পাস বলে। ঠিক এরকমই একটি পাস জোজি’লা। লাদাখি বা তিব্বতি ভাষায় এই ‘লা’ কথার অর্থ পাস। শ্রীনগর ও লেহ্ শহরের যোগাযোগের এনএইচওয়ানের উপর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই পাস সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় এগারো হাজার পাঁচশো পঁচাত্তর ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রতি বছর মোটামুটি মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত চলাচলের অনুকূল থাকে জোজি’লা। শীতের মরসুমে অত্যধিক তুষারপাতের ফলে পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। তবে গত ’১৮-য় সোনমার্গ থেকে একটি টানেল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। টানেল সম্পূর্ণ হলে শীতকালীন সমস্যার সম্পূর্ণ প্রতিকার হবে বলে আশা করা যায়।

জোজি’লায় যখন পৌঁছলাম, বেলা তখন প্রায় এগারোটা হবে। জায়গাটার নাম জিরো পয়েন্ট। আকাশে মেঘের অল্প-বেশি আনাগোনা। লোকের জমায়েত ধীরে-ধীরে বাড়ছে। মূলত চার চাকার যাত্রী। রাস্তার ধার ঘেঁষে শুরু হয়েছে মোটা বরফের আস্তরণ। গ্লেসিয়ারের উপরে স্নো-বাইকিংয়ের মজা উপভোগ করতে ভিড় জমিয়েছেন বেশ কয়েকজন। সবাই যে যার মতো ছবি তুলে, আর এক কাপ গরম-গরম কাশ্মীরি কাবা (মানে চা) পান করে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। জোজিলার এই দিকটা অপেক্ষাকৃত সমতল। বরফের অংশটা পেরিয়ে আবার ভ্যালি শুরু হল। তবে বড় গাছের দেখা আর পেলাম না। এখানে একটা কথা বলে রাখি, জোজি’লা ক্রস করার পরে আমরা কারাকোরাম রেঞ্জে বা পর্বতমালায় প্রবেশ করলাম। এখানে সবুজ গাছপালার পরিমাণ খুবই কম। শুধু রংবেরঙের ন্যাড়া পাহাড় আর পাহাড়ের চূড়ায় বরফ। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পূর্ণ আলাদা। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্রাসে ঢোকার পথেই রাস্তার বাঁ দিকের নীল রংয়ের বোর্ডে চোখে পড়ল। উজ্জ্বল ইংরেজিতে লেখা: পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম বসতি।

দ্রাসে ঢোকার আগে একটা বিশেষ জায়গা থেকে দেখা যায় টাইগার হিলের চূড়া। নিরানব্বইয়ের কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানের কব্জামুক্ত করে টাইগার হিলের চূড়ায় তেরঙা উড়িয়েছিল ভারতীয় সেনা। যুদ্ধের সময় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় এই পুরো অঞ্চল জুড়ে। এখান থেকে সাত কিলোমিটার দূরে টোলোলিং পাহাড়ের কোলে হাইওয়ের বাঁদিকে বড় ফটকের উপর ধাতব অক্ষরে লেখা ‘কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল’। মেনগেট অবশ্য বন্ধ। তার পরিবর্তে পাশের দুই গেট দিয়ে পর্যটকদের আনাগোনা চলছে। মেনগেটের সোজাসুজি পাথর বাঁধানো চওড়া রাস্তা বিজয়পথ-এর প্রতীক। সেনার আত্মবলিদানকে স্মরণ করে বিজয়পথের ওপারে রয়েছে ‘ও পি বিজয়’ (অপারেশন বিজয়), অমর জওয়ান জ্যোতি স্মারক। একশো এক ফুটের প্রকাণ্ড স্তম্ভের ওপর পতপত করে উড়ছে সাড়ে সাঁইত্রিশ ফুট লম্বা এবং পঁচিশ ফুট চওড়া ভারতের জাতীয় পতাকা। নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যাগপত্তর নামিয়ে রেখে আমারও ওইদিকে এগোলাম। রাস্তার দুপাশে তির্যক করে লাগানো তেরঙার মাঝ দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে শরীরের মধ্যে শিহরণ খেলে গেল। এ এক অনন্য অনুভূতি। দু’পাশের ফাঁকা মাঠের ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায় সুসজ্জিত রয়েছে কার্গিল যুদ্ধে ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান মিগ টোয়েন্টি ওয়ান, ওয়ান ফিফটি ফাইভ বোফোর্স গান, সেভেন্টি ফাইভ/টোয়েন্টি ফোর প্যাক হাউইৎজার… ইত্যাদি। অমর জওয়ান স্মারকের ডানদিকে রয়েছে মরণোত্তর পরমবীর চক্র ক্যাপ্টেন মনোজ পাণ্ডে গ্যালারি। সেখানকার দায়িত্বে থাকা এক আর্মি অফিসিয়াল আমাদের গোটা গ্যালারি ঘুরিয়ে দেখালেন। কার্গিল যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্রসস্ত্র, পরাজিত পাকিস্তানের বাজেয়াপ্ত করা গ্রেনেড, বন্দুক, মিসাইল…পাক সীমান্ত থেকে উড়ে আসা মিসাইল-গ্রেনেডের টুকরো ইত্যাদি গ্যালারির মধ্যে রাখা আছে সযত্নে। ছক এঁকে দেখানো আছে যুদ্ধনীতি আর যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা। লেখা পড়ে জানতে পারলাম যোদ্ধাদের বীরত্বের নানান গল্প, যুদ্ধজয়ের অনেক অজানা ঘটনা। এখান থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে একটু হেঁটে গেলেই বীরভূমি, শহীদদের সমাধিস্থল। কয়েকশো ফলক জুড়ে জ্বলজ্বল করছে কার্গিল যুদ্ধে অমর সৈনিকদের শেষ পরিচয়। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনটা বড় ভার করে এল। আরও কিছুক্ষণ এ দিক, ও দিক ঘুরে ওয়ার মেমোরিয়াল থেকে যখন বের হলাম, সূর্য তখন মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিমের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। আকাশ এক্কেবারে পরিষ্কার। জলপান আর স্টোভ ধরিয়ে আমরা ম্যাগি রান্না করে নিলাম। বিরতি সেরে এরপর আবার এগিয়ে চললাম। দেশভক্তি আর সেনাবাহিনীর প্রতি গর্বের এক মিশ্র অনুভূতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে মনটাকে। ঠিক ছিল আজ কর্গিলের আশেপাশেই কোথাও রাতের আস্তানা খোঁজা হবে। তাই ধীরে সুস্থেই বাকি পঞ্চাশ কিলোমিটার চলতে থাকলাম। এরই মধ্যে দ্রাস নদী ডানদিক ছেড়ে বাঁ দিক নিয়েছে। কুলুকুলু শব্দে সে-ও বয়ে চলেছে আপনমনে।

বালি-পাথরের ধূসর পাহাড়ের মাঝে কোথাও-কোথাও গাড় সবুজক্ষেত ক্ষণিকেই চোখের আরাম দেয়। প্রতি বাঁকে, প্রতি মুহূর্তে বদলে যাওয়া পাহাড়ের রূপে মোহিত করে রেখেছে প্রত্যেককে। নাম না-জানা গ্রাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী, ফ্যাকাসে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের রঙের খেলা দেখতে-দেখতে পৌঁছে গেলাম সুরু নদীর তীরে লাদাখের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর—কার্গিল। শহরে ঢোকার কিছু আগেই সুরু আর দ্রাস একসঙ্গে মিলে সিংগো নদীর রূপ নিয়ে চলে গিয়েছে আরও উত্তর-পশ্চিমে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। কিছুটা আসার পর পেট্রোলপাম্পে তেল ভরার সময় জিজ্ঞাসাবাদ করে রাতে থাকার পছন্দমতো জায়গার সন্ধান মিলল। মূল শহর ডানদিকে রেখে নদী টপকে লেহ-এর পথে পা বাড়ালাম। যে পথ আমরা ছেড়ে এলাম, সে পথ জাংস্কার ভ্যালির দিকে চলে গিয়েছে। শোনা যায়, ওই রাস্তা প্রাচীন সিল্করুট গুলির মধ্যে অন্যতম। আরও একটা রাস্তা বাঁ দিকে বাটালিক হয়ে লেহ-এর দিকে গেছে। ২০২২ সালের লাদাখ যাত্রায় আমরা ১৩৩৮০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হাম্বুটিং-লা ক্রস করে একটি সুন্দর গ্রাম বাটালিকে দারচিক, মানে যেখানে আর্যদের বসবাস, সেখানে নাইট স্টে করেছিলাম তাঁবু খাটিয়ে।

সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। চারপাশে খাঁড়া পাহাড়ের ঢালে রাত কাটানো। ২০১৮তে আমরা কার্গিল ক্রস করে একটি হোম স্টে সংলগ্ন এক ফাঁকা মাঠে অনুমতি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে লাদাখ অভিযানের প্রথম অ্যাডভেঞ্চারাস রাত কাটানোর তোড়জোড় শুরু করলাম। সঙ্গে মিলল দু’শো টাকায় হোম স্টের বাথরুম ব্যবহারের ছাড়পত্র। হাওয়ার দাপটে প্রথমটায় বেশ সমস্যা হলেও শেষটায় প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সকলের চেষ্টায় টেন্ট পিচিং সম্পন্ন হল। এ দিকে, খিদেতে যে সবার পেট জ্বলছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই টেন্ট খাটানো আর রাতের রান্নার ব্যবস্থার মাঝে কলা-পাঁউরুটি দিয়ে টিফিন সেরে নিলাম। মাংসের দেখা অবশ্য মেলেনি। অগত্যা ডিমের ঝোল ভাত রান্না হল রাতের খাবারে। খাওয়া সেরে টেন্টের ভেতর স্লিপিং ব্যাগের আশ্রয় যখন নিলাম ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজে। বাইরে হাওয়ার সোঁ-সোঁ শব্দ আর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় ঘুম আসতে-আসতে মাঝরাত পেরিয়ে গেল।
