MD Habib Success- পিকের অঘোষিত ক্যাপ্টেন, সুভাষের বড়ে মিঁঞা, একঝলকে হাবিবের সাফল্য
Kolkata Football: মহম্মদ হাবিব সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য রয়েছে, যা খুব সহজে জানা সম্ভব নয়। তেমনই কিছু বিষয় তুলে ধরা হল।
ময়দান আজ শোকস্তব্ধ। বাকরুদ্ধও। ধীরে ধীরে ময়দানের মূল চরিত্রগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মহম্মদ হাবিব তেমনই একজন। ভারতীয় ফুটবল, বাংলা এবং ময়দানে তাঁর অসংখ্য সাফল্য। সব লিখতে গেলে হয়তো একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। তবে যেগুলো না বললেই নয়, সঃক্ষিপ্ত আকারেই দেওয়া রইল। এই লেখাটি রয়ে যাক ময়দানের প্রতিটি ঘাসে। বিস্তারিত জেনে নিন TV9Bangla Sports-এর এই প্রতিবেদনে।
সালটা ১৯৬৫। সন্তোষ ট্রফিতে উত্থান মহম্মদ হাবিবের। ওই বছর হাবিব এত ভালো খেলেন, তাঁকে পছন্দ হয় ইস্টবেঙ্গলের। খবরটি চাওড় হতে বেশি সময় লাগেনি। এই খবর যায় মোহনবাগান শিবিরেও। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দুই শিবিরই ঝাঁপায় হাবিবকে নেওয়ার জন্য। অবশেষে ইস্টবেঙ্গলের তৎকালীন সচিব জ্যোতিষ চন্দ্র গুহর সৌজন্যে ইস্টবেঙ্গলেই আসেন হাবিব। ১৯৬৬ মরসুমে স্পোর্টিং ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লাল-হলুদ জার্সিতে কলকাতা ফুটবলে অভিষেক। ওই ম্যাচটা ইস্টবেঙ্গল ৭-০ ব্যবধানে জেতে। হ্যাটট্রিক করেন হাবিব। ওই একটা ম্যাচ দেখেই ইস্টবেঙ্গল এবং কলকাতা ময়দান আপন করে নিয়েছিল হাবিবকে। সে বছর, লিগের প্রথম বড় ম্যাচেও গোল ছিল হাবিবের। বড় ম্যাচে সুকুমার সমাজপতির সেন্টার থেকে গোল করেন তিনি। সে বছর মোহনবাগান লিগ জিতলে, মহমেডানের পাঁচ বার লিগ জয়ের রেকর্ড ভেঙে যেত। ময়দানে গুঞ্জন, ইস্টবেঙ্গল হয়তো ম্যাচটা উপহার দিতে পারে। কিন্তু হাবিব দুরন্ত পারফর্ম করেছিলেন। ফিরতি ডার্বিতেও মোহনবাগান জিততে পারেনি। সে বার মহমেডানের রেকর্ড অক্ষত থেকেছিল লাল-হলুদ জার্সির হাবিবের জন্যই।
কলকাতা ময়দানে দলবদলের বাজারে ১৯৬৫-৭৫, এই এক দশক আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন মহম্মদ হাবিব। তাঁকে নিয়ে দ্বৈরথ দেখা যেত ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের। ১৯৬৭ সালে মোহনবাগান হাইজ্যাক করে নেয় হাবিবকে। সে বছর যদিও সবুজ মেরুন জার্সিতে খেলা হয়নি। আইএফএ অফিসে সই করাতে আসার সময় সেখান থেকে ইস্টবেঙ্গল তাঁকে তুলে নেয়। ইস্টবেঙ্গল সচিব জ্যোতিষ চন্দ্র গুহর ক্ষেত্রে বলা হত, কোনও প্লেয়ারকেই আটকাতেন না তিনি। কিন্তু হাবিবকে আটকেছিলেন। তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি চাই তুমি এ বারও ইস্টবেঙ্গলেই খেল। ময়দানে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পাবে। হাবিব সে সময় থেকেই তারকা হয়ে ওঠেন।
তবে ১৯৬৮ সালে মোহনবাগানে সই করেন হাবিব। দুটো মরসুম খেলেন সবুজ মেরুনে। তিনি যে শুধু ইস্টবেঙ্গলে নন, যে কোনও ক্লাবেই সাফল্য পেতে পারেন, প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান। আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মহম্মদ হাবিব। সে সময় মহম্মদ নইমুদ্দিনকে বলা হত হাবিবের অভিভাবক। ১৯৭০ সালে মোহনবাগান থেকে ফের ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৭০-৭৪ এই সময়টা বলা হত ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগ। ১৯৭২ সালে ইস্টবেঙ্গলের ত্রিমুকুট জেতার অন্যতম কারিগর হাবিব। নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান, যিনি গেম মেকিং থেকে গোল করা এবং গোল করানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখেন। এই সময়েই ময়দানের ‘বড়ে মিঁঞা’ হয়ে ওঠেন মহম্মদ হাবিব।
১৯৭৫ সালে মহমেডান ক্লাবে সই করেন হাবিব। পরবর্তী তিনটি মরসুম ফের মোহনবাগান খেলে ৭৯ সালে আবারও মহমেডানে ফেরেন। ১৯৮০-তে ইস্টবেঙ্গলে। সে বছর ইস্টবেঙ্গলে কার্যত ভাঙাচোরা দল। এই দল নিয়েও অভাবনীয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাবিব। পুরো মরসুমে নিজে করেছিলেন ১০টা গোল। ফেডারেশন কাপও জেতে ইস্টবেঙ্গল। ফাইনালে মজিদ বাসকরের সেন্টার থেকে গোল হাবিবের।
১৯৮১ সালে মোহনবাগান এবং ১৯৮২-তে ফের ইস্টবেঙ্গল। লাল-হলুদ জার্সিতে শুরু হয়ে একই জার্সিতে ময়দানে যাত্রা শেষ হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮৩-তে মুম্বইয়ে মোফতলালে খেলে অবসর নেন মহম্মদ হাবিব।
মহম্মদ হাবিব সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য রয়েছে, যা খুব সহজে জানা সম্ভব নয়। তেমনই কিছু বিষয় তুলে ধরা হল।
১৯৬৮ সালের সন্তোষ ট্রফি। বাংলার হয়ে খেলেন হাবিব। পঞ্জাবের বিরুদ্ধে সেমি ফাইনাল। তার আগের ম্যাচে চোট পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হাবিব। ম্যাচের দুপুরে দেখা যায় হাবিব টিম হোটেলে! প্রশান্ত সিনহা বাংলার কোচ। স্বাভাবিক ভাবেই হাবিবকে দেখে অবাক হয়ে যান তিনি। যার হাসপাতালে থাকার কথা, সে কী করে টিম হোটেলে! কোচকে হাবিব জবাব দিয়েছিলেন,’পঞ্জাবের মতো টিমের বিরুদ্ধে খেলা, আর আমি হাসপাতালে শুয়ে থাকবো। পার্সোনাল বন্ডে সই করে এসেছি।’ সেই ম্যাচেও অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখা যায় হাবিবের।
১৯৬৯ সালে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলা। ফাইনালে সার্ভিসেসকে ৬-০ ব্যবধানে হারায় বাংলা। হাবিব একাই পাঁচ গোল করেন। ১৯৭২ সালে হাবিবের নেতৃত্বে ফের সন্তোষে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলা। ১৯৬৭-৭৪, জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ মহম্মদ হাবিব। ১৯৭২ সালে প্রি-অলিম্পিক টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের ক্যাপ্টেনও ছিলেন হাবিব। ১৯৮২ সালে অর্জুন পুরস্কার জেতেন।
নয়ের দশকে ফের ফুটবলে প্রবেশ মহম্মদ হাবিবের। এ বার নতুন ভূমিকায়। কোচ হিসেবে মাঠে হাবিব। টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে পিকে ব্যানার্জি টেকনিকাল ডিরেক্টর, হাবিব কোচ। ১৯৯৬ সালে মোহনবাগানের কোচ হন হাবিব। সাফল্য না পাওয়ায় তাঁকে সরিয়ে নঈমকে কোচ করে মোহনবাগান। এরপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বেশ কয়েক বার মহমেডানে কোচিং করিয়েছেন। তবে একটা আক্ষেপ তাঁর থেকে গিয়েছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেটা স্বীকারও করে নিয়েছেন। ইস্টবেঙ্গলের কোচ না হওয়ার আক্ষেপ।
১৯৭০ সালে শিল্ড ফাইনালে ইরানের পাস ক্লাবের বিরুদ্ধে ম্যাচ। তার আগের দিন প্র্যাক্টিসে নেই হাবিব। ইস্টবেঙ্গলে তাঁর সতীর্থরা চিন্তায়। ডোভারলেনে খুঁজতে গিয়ে থঙ্গরাজরা জানতে পারেন হাবিব অসুস্থ। কিন্তু দেখেন হাবিব বল নিয়ে নাচাচ্ছে। জিজ্ঞেস করাতেও বলেন, শরীর ভালো না থাকায় তাই প্র্যাক্টিসে যায়নি। তারপর তাঁকে প্র্যাক্টিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিমল দের গোলে জেতে ইস্টবেঙ্গল। অনবদ্য খেলেন হাবিব।
১৯৭৩ সালে ডিসিএম ফাইনাল ছিল ইস্টবেঙ্গলের বিরাট প্রাপ্তি। বিদেশি টিমের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গল ভালো পারফর্ম করে, তার উদাহরণ আগেই পাওয়া গিয়েছে। ডিসিএমে কোরিয়ার একটি টিম এসেছিল। ডক রো গেমের সেই দলে ৯ জন বিশ্বকাপার। সেমিফাইনালে পঞ্জাব পুলিশের বিরুদ্ধে রিজার্ভ টিম খেলিয়ে ৭-০ ব্যবধানে জেতে ডক রো গেম। ফাইনালে মাঠে নামার আগে ইস্টবেঙ্গল কোচ পিকে ব্যানার্জি ভোকাল টনিক দেন। এরপরই অঘোষিত ক্যাপ্টেন হাবিবকে কিছু বলতে বলেন। সকলেই কার্যত ধরে নিয়েছিল কোরিয়ার এই টিমের বিরুদ্ধে ঝুরি ঝুরি গোল খাবে। টিম হাডলে হাবিব বলেছিলেন-ওদেরও দুটো করে হাত-পা, একটা মাথা। আমাদেরও তাই। চলো মাঠে নেমে দেখিয়ে দিই, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কী জিনিস। ফাইনালে প্রথম দু-দিনই ড্র হয়। ইস্টবেঙ্গলের খেলায় অবরুদ্ধ হয়ে পরপর দু-দিন ড্র হওয়ায় মানসিক ভাবে হার মানে ডক রো গেম। ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়।
সালটা ১৯৭৩। ইস্টবেঙ্গলে ফেরেন সুভাষ ভৌমিক। তাঁর ফর্ম একেবারেই ভালো যাচ্ছিল না। ঘুরে দাঁড়ানোর সেরা উপায় বড় ম্যাচে গোল। প্র্যাক্টিসের পর হাবিবকে বলেন, বড়ে মিঁঞা গোল করাও। সুভাষ গোল করেছিল। হাবিবের পাসে গোলটা না হলেও, পুরো ম্যাচেই সুভাষকে বল সাপ্লাই দিয়ে গিয়েছিলেন।