TV9 Explain: ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন: আজকের পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? জেনে নিন অন্তহীন যুদ্ধের ইতিহাস

TV9 Explain Israel Palestine conflict: শনিবার দক্ষিণ ইজরায়েলের বিভিন্ন শহরে হামাস যে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। এটা স্বাধীনতার লড়াই নয়। আবার, গত কয়েক দশক ধরে ইজরায়েলিরা যেভাবে প্যালেস্টাইনিদের জমি-বাড়ি দখল করেছে, তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, তাকেও সমর্থন করার কোনও জায়গা নেই। তাহলে, মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিস্থিতির দায় কার? এটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু ইতিহাসের পাতায় নজর দিতে হবে। ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে কেন এই দ্বন্দ্ব? কী নিয়ে দ্বন্দ্ব?

TV9 Explain: ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন: আজকের পরিস্থিতির জন্য কারা দায়ী? জেনে নিন অন্তহীন যুদ্ধের ইতিহাস
এই যুদ্ধের যেন কোনও শেষ নেইImage Credit source: AFP
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Oct 10, 2023 | 12:09 PM

জেরুসালেম: গত শনিবার অতর্কিত হামলায় ইজরায়েলকে বেকাদায় ফেলে দিয়েছিল হামাস। সাতশোরও বেশি ইজরায়েলি নাগরিককে হত্যা করেছে তারা। অভিযোগ তেল আবিবের। আরও শতাধিক মানুষকে অপহরণ করা হয়েছে। পাল্টা গাজা ভূখণ্ডে আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। আরও অন্তত ৪০০ প্যালেস্টাইনি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। তারপর থেকে, গোটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তো বটেই, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও যেন যুদ্ধ চলছে। সকলেই দুই পক্ষে ভাগ হয়ে গিয়েছে। হামাসের হামলাকে কেউ কেউ বলছেন সন্ত্রাসবাদী হামলা। আবার কেউ কেউ উল্লেখ করছেন, বছরের পর বছর ধরে প্যালেস্টাইনিদের উপর চলা ইজরায়েলি দমন-পীড়নের কথা। বস্তুত, শনিবার দক্ষিণ ইজরায়েলের বিভিন্ন শহরে হামাস যে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তাকে কোনওভাবেই ন্যায্য বলা যায় না। স্বাধীনতার লড়াই তো নয়ই। আবার, গত কয়েক দশক ধরে ইজরায়েলিরা যেভাবে প্যালেস্টাইনিদের জমি-বাড়ি দখল করেছে, তাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, তাকেও সমর্থন করার কোনও জায়গা নেই। তাহলে, মধ্যপ্রাচ্যের এই পরিস্থিতির দায় কার? এটা বুঝতে গেলে আমাদের একটু ইতিহাসের পাতায় নজর দিতে হবে। ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে কেন এই দ্বন্দ্ব? কী নিয়ে দ্বন্দ্ব?

‘জ়ায়নবাদ’

প্যালেস্টাইনকে বলা হয় ধর্মের আঁতুড়ঘর। ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম – তিন ধর্মের মানুষই এই জায়গাকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে প্যালেস্টাইনের দখল ছিল অটোমান শাসকদের হাতে। অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল এই পবিত্র ভূমি। তিন ধর্মের মানুষেরই মোটামুটি শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছিল। কিন্তু, ইউরোপে দীর্ঘ সময় ধরেই বিভিন্ন কারণে ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন জোর জুলুম চলত। আঠারো শতক থেকে ধীরে ধীরে ইহুদিদের এক আন্দোলন গড়ে ওঠে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের একজোট করা এবং ইহুদিদের জন্য একটি পৃথক দেশ স্থাপন। যা পরবর্তীকালে ‘জ়ায়নবাদ’ হিসেবে পরিচিত হয়।

ইহুদিদের পবিত্রভূমি 

১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথম জ়ায়নবাদী কংগ্রেসের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে ঠিক হয়, ইহুদিদের পবিত্রভূমি গড়ে তোলা হবে প্যালেস্টাইনে। প্যালেস্টাইনই তাদে পূর্বভূমী বলে দাবি করে তারা। একদিন প্যালেস্টাইনে তাদের দেশ গঠিত হবে এই আশায়, সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ইহুদিরা অটোমান-প্যালেস্টাইনে পাড়ি দিতে শুরু করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা। অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করতে, বিভিন্ন আরব গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেছিল ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা। অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের জন্য তাদের উসকেছিল। ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অটোমানদের হার হলে, তারা আরবদের স্বাধীনতা দেবে। একটি আরব দেশকে স্বীকৃতি দেবে। যুদ্ধে অটোমানদের পরাজয় হয়, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জিতে যায়।

‘সাইক্স-পিকো’ চুক্তি

কিন্তু, ইংরেজরা যে বরাবরই প্রতারক, তা ভারতবাসীদের থেকে কারা বেশি জানে! ১৯১৬ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ‘সাইক্স-পিকো’ চুক্তি নামে এক গোপন চুক্তি করেছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। চুক্তির মূল কথা ছিল, যুদ্ধের পর আরব দেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবে ব্রিটিশ এবং ফরাসীরা। যুদ্ধে, মার্কিনীদের সহায়তার প্রয়োজন ছিল ব্রিটিশদের। যুদ্ধে যাতে মার্কিন সরকার ব্রিটেনকে সহায়তা করে, তার জন্য চাপ তৈরি করতে মার্কিন ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ব্রিটিশরা। বেলফোর ডেক্লারেশনের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটিশরা। অর্থাৎ, একই জায়গায় প্রথমে আরব এবং পরে ইহুদিদের দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন।

প্যালেস্টাইনে ইহুদি শরণার্থী

যুদ্ধের পর অবশ্য কারোরই শিকে ছেঁড়েনি। প্যালেস্টাইনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেড হিসেবে ঘোষণা করেছিল ব্রিটেন। কিন্তু, ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতিতে আশাবাদী ইহুদিরা আরও বেশি সংখ্যায় প্যালেস্টাইনে আসা শুরু করে। প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা বাড়তে থাকায় অসন্তুষ্ট হয়েছিল আরবরা। কিন্তু, এর মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জার্মানিতে শুরু হয় নির্বিচারে ইহুদি গণহত্যা, জাতিগত শুদ্ধিকরণ। এর ফলে, প্রাণ বাঁচাতে আরও বেশি সংখ্যক ইহুদি প্যালেস্টাইনে পাড়ি দিতে থাকে। ১৯১৮ সালে প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ ছিল, ১৯৪৭-এর মধ্যে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশে পরিণত হয়।

দায় এড়ালো ব্রিটেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও জয় পেয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু, ততদিনে তাদের উপনিবেশ পরিচালনার মতো ধন-সম্পদ ফুরিয়েছে। ফলে, প্যালেস্টাইন নিয়ে কী করবে, তা ভেবে পায়নি ব্রিটেন। প্যালেস্টাইনের ভবিষ্যৎ তারা সঁপে দেয় সদ্য গঠিত হওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের হাতে। রাষ্ট্রপুঞ্জ পড়েছিল মহা ফাঁপড়ে। একদিকে, সদ্য গণহত্যার সাক্ষী হওয়া ইহুদি সম্প্রদায় দাবি করছে, তাদের মাথা গোঁজবার মতো একটি দেশ চাই, যেখানে তারা শান্তিতে থাকতে পারবে। অন্যদিকে, আরব সম্প্রদায়ের দাবি ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল ইংল্যান্ড। তাদের জায়গা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাইরে থেকে ইহুদিদের এনে প্যালেস্টাইনে বসানো হয়েছে। ইহুদি গণহত্যা তো প্যালেস্টাইনিরা করেনি, হিটলারের পাপের দায় তরা কেন নেবে?

‘দুই দেশ সমাধান’

অনেক আলাপ আলোচনার পর রাষ্ট্রপুঞ্জ ‘দুই দেশ সমাধান’ বের করেছিল। প্যালেস্টাইনকে ভাগ করে ইহুদিদের জন্য ইজরায়েল এবং আরবদের জন্য প্যালেস্টাইন গঠন করা হবে। জেরুসালেমের উপর দাবি ছিল দুই পক্ষেরই। তাই এই পবিত্র শহরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ। প্যালেস্টাইনের ৫৫ শতাংশ জমি গিয়েছিল ইহুদিদের ভাগে। ভারত-সহ বিভিন্ন দেশের আপত্তি সত্ত্বেও, ১৯৪৭-এর ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে এই দুই দেশ সমাধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এর একদিন বাদই, ৩০ নভেম্বর প্যালেস্টাইনে যুদ্ধ শুরু হয় আরব যোদ্ধা এবং ইহুদি যোদ্ধাদের মধ্যে। সেই যুদ্ধে জয় পেয়েছিল ইহুদিরাই।

প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ

১৯৪৮-এর ১৪ মে ইজরায়েল নিজেদের স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ওই দিনই ৬ আরব দেশ একযোগে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বিস্ময়করভাবে, সবকটি আরব দেশকে পরাস্ত করেছিল ইজরায়েল। ৫৫ শতাংশ থেকে প্যালেস্টাইনের ৭৮ শতাংশ জায়গার দখল আসে ইজরায়েলের হাতে। ৭ লক্ষ প্যালেস্টাইনি নাগরিক ভিটেছাড়া হন। আর এই যুদ্ধই ছিল আজকের ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বের ভিত্তি।

দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ

১৯৫৬ সালে সুয়েজ ক্যানেলকে তাদের জাতীয় সম্পদ বলে ঘোষণা করেছিল মিশর। ইজরায়েলের জন্য ওই ক্যানাল ব্যাবহার নিষিদ্ধ করেছিল। মিশর আক্রমণ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইজরায়েল। মিশরের বহু জায়গা দখল করলেও, পরে আন্তর্জাতিক চাপে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল তারা। তবে, এই যুদ্ধ পরিষ্কার করে দিয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলই পশ্চিমী দেশগুলির মিত্র শক্তি।

তৃতীয় ও চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধও

১৯৬৭ এবং ১৯৭৩-এ তৃতীয় ও চতুর্থ আরব-ইজরায়েল যুদ্ধেও ইজরায়েলকে পরাস্ত করতে পারেনি আরব দেশগুলির জোট। পরিবর্তে, গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, সিনাই, গোলান হাইটসের মতো প্যালেস্টাইনের আরও অনেক এলাকা দখল করে ইজরায়েল।

ইজরায়েল-মিশর কূটনৈতিক সম্পর্ক

১৯৭৮ থেকে ইজরায়েল এবং মিশরের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল। আসলে একের পর এক যুদ্ধে হারের পর, আরব দেশগুলিও বুঝে গিয়েছিল রণাঙ্গনে ইজরায়েলি বাহিনীকে হারানো সোজা নয়। তার থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ১৯৮২-তে ইজরায়েল গাজা-সহ বেশ কিছু প্যালেস্টিনিয় এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে। কিন্তু, তারপরও বহু এলাকা তাদের দখলেই থেকে যায়।

আজকের ছবি

আজও, প্যালেস্টাইনি নগরিকদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো আচরণ করে ইজরায়েল সরকার, এমনটাই অভিযোগ বহু মানবাধিকার সংগঠনের। ছলে-বলে প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের জায়গা-জমি ছিনিয়ে নেওয়া, কথায় কথায় তাদের কারাগারে বন্দি করা, আল আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার অনুমতি না দেওয়া, যখন-তখন তাদের হত্যা করা, তাদের খাবার-জল-বিদ্যুতের মতো প্রাথমিক চাহিদাগুলি থেকে বঞ্চিত করার মতো হাজারো অভিযোগ রয়েছে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে, প্যালেস্টাইনের দখলে থাকা এলাকাগুলিতেও, বহু সংখ্যায় ইজরায়েলি নাগরিকরা বসতি স্থাপন করেছেন। ফলে, দুই দেশ সমাধানও আর প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কারণ আগের প্যালেস্টাইনি জায়গাগুলির অনেকটাই এখন ইজরায়েলিদের দখলে।

পিএলও এবং হামাস

এদিকে, শুধু বাইরে থেকে যুদ্ধ নয়, প্যালেস্টাইনকে দখলমুক্ত করতে প্যালেস্টাইনিদের মধ্যেও বহু সংগঠন তৈরি হয়েছিল। এদেরই ছাতা সংগঠন হিসেবে ১৯৬৪ সালে আত্মপ্রকাশ করে ইয়াসির আরাফতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনকেই প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে, প্যালেস্টাইনিদের মধ্যেই একাংশের দাবি ছিল, পিএলও বড় নরমপন্থী। তাই, ১৯৮৭ সাল জন্ম নেয় যোদ্ধা সংগঠন হামাস। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট, গোটা প্যালেস্টাইনকে ইজরায়েলের দখলমুক্ত করা হবে এবং সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই হামাসই আজ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা করেছে। ইজরায়েল ঘোষণা করেছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। তবে, এই যুদ্ধ তো গত কয়েক দশক ধরে চলছেই। কাজেই সহজে শেষও হওয়ার নয়।