Pakistan: পাক গণতন্ত্র; সময়ের আগেই শেষ!
Military Coup in Pakistan: ৭৫ বছরে একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। রসিকতা করে বলা হয়। পাকিস্তানে সেনাশাসনই চলে। মাঝে মধ্যে গণতন্ত্রের বিরতি হয়।
প্র দী প চ ক্র ব র্ত্তী
ভারতের দর্শককুলের মধ্যে পাকিস্তানি ধারাবাহিকের একটা কদর রয়েছে। কারণ একাধিক। শিল্পীরা দেখতে সুন্দর। ভাষা মিষ্টি। গল্প ভাল। এবং সময়ে শেষ হয়। মেগা সিরিয়ালের মতো অনন্তকাল চলে না। পাকিস্তানের গণতন্ত্র পাকিস্তানি সিরিয়ালের থেকেও এক কদম এগিয়ে। সেদেশে গণতন্ত্র সময়ের আগেই ফুরিয়ে যায়। ৭৫ বছরে একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। রসিকতা করে বলা হয়। পাকিস্তানে সেনাশাসনই চলে। মাঝে মধ্যে গণতন্ত্রের বিরতি হয়।
সদ্য ভূমিষ্ঠ দেশ আড়মোড়া ভাঙার আগেই অভ্যুত্থানের চেষ্টা? পাকিস্তানে সেটাই হয়েছে। এবং তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয়, পাকিস্তানে প্রথম অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র ছিল বামপন্থী। ১৯৫১ সালে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র হয় তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের বিরুদ্ধে। ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের মুখ ছিলেন সেনাকর্তা আকবর খান। মাথা ছিলেন বামপন্থী কবি ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজ।
প্রথম সফল অভ্যুত্থান সাংবিধানিক অভ্যুত্থান। পাকিস্তানের ইতিহাসে তা সেই নামেই পরিচিত। ১৯৫৩ সালে খ্বাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারকে বরখাস্ত করেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মহম্মদ। তারপর আইনসভাও ভেঙে দেওয়া হয়, যাতে, সংবিধান সংশোধন করে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব না করা যায়। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই গা জোয়ারিই পাকিস্তানকে সেনাশাসনের দিকে ঠেলে দেয়।
১৯৫৮ সালে ফিরোজ খান নুনের সরকারকে বরখাস্ত করেন পাক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা। মির্জা, আয়ূব খানকে মার্শাল ল প্রশাসক নিযুক্ত করেন মির্জা। ১৩ দিন পরে মির্জাকে সরিয়ে আযূব খান নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেন। আয়ূব খান পাকিস্তানের ইতিহাসে সফলতম প্রশাসক। তাঁর আমলে উন্নতির শিখরে পৌছয় পাকিস্তান। উন্নয়নের গতি ছিল ভারতের থেকেও বেশি।
এরপর ১৯৭৭ সালের সেই কুখ্যাত অভ্যুত্থান। অপারেশন ফ্লেয়ার প্লে। এই নামে সেনা অভ্যুত্থান নয়। জুলফিকার আলি ভুট্টোর সরকারকে বরখাস্ত করেন সেনাপ্রধান জিয়াউল হক। পরে একটি খুনের মামলায় ভুট্টোকে অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। জিয়া উল হকের আমলেই পাকিস্তানের সর্বনাশের শুরু। উন্নয়ন পথ ছেড়ে ধর্মীয় মৌলবাদের পথে পা বাড়ায় সিন্ধুপাড়ের প্রতিবেশি। আইন-সংবিধান সংশোধন করে ইসলামি কানুন কার্যকর করা হয়। ১৯৮০ সালে জিয়াউল হককে খুনের চক্রান্ত করেন সেনাকর্তা তাজমুল হোসেন মল্লিক। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। সেনাকর্তা জাহিরুল ইসলাম আব্বাসির সেই প্রয়াস সফল হয়নি।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে শেষবার সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। কার্গিলে ব্যর্থ সামরিক অভিযানের পর কোণঠাসা ছিলেন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ। মুশারফকে সরানোর পথ খুঁজছিলেন শরিফও। শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পথে মুশারফের বিমান পাকিস্তানে নামতে বাধা পায় বলে অভিযোগ। খুনের চেষ্টার অভিযোগে শরিফকে বন্দি করা হয়। বিচারের নামে প্রহসন চলে। আন্তর্জাতিক চাপে শরিফকে ফাঁসিতে ঝোলানো যায়নি। সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাঁকে।
২০০৩ সালে পারভেজ মুশারফের ওপরেও প্রাণঘাতী হামলা হয়। ঘটনাস্থল পাক সেনাসদর রাওয়ালপিন্ডিই। যদিও আততাতী ধরা পড়েন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
পাকিস্তানে গত দুই দশকে সরাসরি কোনও সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি। তবে অভ্যুত্থানের নতুন পরিভাষা এসেছে। সফ্ট ক্যু। বা নরম অভ্যুত্থান। অর্থাত্ দুর্নীতির কোনও মামলায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করে আদালতের অপব্যবহারে অপসারণ। ইউসুফ রজা গিলানি এই ব্যবস্থার প্রথম শিকার।
ইমরান খানের অপসারনকেও অভ্যুত্থান বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ একেবারে শেষবেলায় ইমরান সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিলেন। সূত্রের খবর, সেনাপ্রধানের অপসারণের ফাইল তৈরি করতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে নির্দেশ দেন ইমরান। সেই ফাইল আইন মন্ত্রকে পাশ হয়ে ইমরান ও রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু, খবর পেয়ে যান সেনাপ্রধান বাজওয়া। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে আইন মন্ত্রকে ফাইল পৌঁছয়নি। রাত আটটায় ইমরান, সেনাপ্রধানের অপসারণের নির্দেশ দেন। রাত নটায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছে যান, সেনাপ্রধান বাজওয়া ও ISI প্রধান নাদিম অনজুম। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনকে ঘিরে ফেলে সেনার ৩৬ সাঁজোয়া গাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে প্রিজন ভ্যানও পৌঁছে যায়। সেনাপ্রধান ইমরানকে বলেন, বিদেশি অর্থ লেনদেনের ফাইল খোলা হবে। ইমরান সহ গোটা মন্ত্রিসভা গ্রেফতার হবে। অবিলম্বে অনাস্থা ভোট করানোর নির্দেশ দেওয়া হয় ইমরানকে। স্পিকার রাজি না হওয়ায় তাঁকেও সরতে হয়। অনাস্থা ভোট না হলে কী হত? মধ্যরাতের পর সুপ্রিম কোর্টে শুনানির বন্দোবস্ত করতে তৈরি ছিল সেনা। কার্যত ঘরবন্দি অবস্থায় অনাস্থা মেনে নিতে হয় ইমরানকে। অর্থাত্ দেখানো হল, অনাস্থায় হেরে সরলেন ইমরান। কিন্তু, তাঁর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানই হল। সাংবিধানিক অভ্যুত্থান। ইমরানও গেম খেলতে চেয়েছিলেন। ফৈয়াজ হামিদকে সেনাপ্রধান করতে চেয়েছিলেন। ফৈয়াজ হামিদ, সেই ব্যক্তি যিনি আফগানিস্তানে তালিবানের ক্ষমতাদখলে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ইমরান ঘনিষ্ঠ এই সেনাকর্তা, সেনাপ্রধান হলে, বিরোধীদের বোতলবন্দি করে ফেলতেন। ইমরান প্ল্যানিং করেছিলেন। কিন্তু, সেনাপ্রধান প্ল্যান বি তৈরি রেখেছে, তা জানতেন না। হেরে গেলেন।
পাকিস্তানে আরও এক গণতান্ত্রিক প্রয়াস সময়ের আগেই শেষ হল। শাহবাজ শরিফের কপালে কী নাচছে? দাদা নওয়াজ শরিফের পরিণতি শাহবাজ সামনে থেকে দেখেছেন। তিনি সেনাকে সঙ্গে নিয়েই শাসন চালাতে চাইবেন। সেনারও যতদিন পছন্দ ততদিন শাহবাজকে ব্যবহার করবে। যেমন ইমরানকে ব্যবহার করেছে সেনা। সেনার মন বদলে গেলেই প্রধানমন্ত্রীর দিন শেষ। পাকিস্তানে এটাই চলে আসছে। চিরকাল। ব্যর্থ গণতন্ত্রের ব্যর্থ উপাখ্যান।
আরও পড়ুন : পাক প্রধানমন্ত্রীর গদি যেন পদ্মপাতার জল! এত টলমল করে কেন? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?