বুদ্ধদেব গুহর কলম সংগ্রহের নেশা ছিল, আমারও ছিল: সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
একবার উত্তরবঙ্গে (North Bengal) অরণ্যে তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। শীতের রাত। আমরা সবাই কম্বল মুরি দিয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। তিনি ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন-- 'চুপ! একটাও শব্দ করবে না। হাতি আসবে একটু পরে।
বুদ্ধদেব গুহর (Buddhadeb Guha) সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। প্রথম তাঁকে দেখি আনন্দ পুরস্কার নেওয়ার সময়। মঞ্চে এক বক্তা বলেছিলেন এই লেখক দেখতে যেমন সুন্দর, লেখেনও তেমন সুন্দর। তখন তাঁর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পরবর্তীকালে যখন কাছাকাছি এলাম, দেখলাম এক উদার মনের মানুষ। অসাধারণ তাঁর সাহিত্য (Literature) বিচরণ ক্ষমতা।
সবচেয়ে বড় কথা হল তিনি জীবন রসিক। জঙ্গল ভালবাসতেন। ভগবানের কৃপায় তিনি ধনির সন্তান। প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়েছেন এবং সারা জীবনই কাটালেন। তাঁর সঙ্গে অনেক দিন কলকাতার বাইরে চা-বাগানে কিংবা ডাকবাংলোয় সময় কেটেছে। তিনি গান গাইতেন, আমিও একটু সঙ্গীত-চর্চা করতাম।
মঝে মাঝে তিনি রসিকতা করে বলতেন– ‘সঞ্জীব হারমোনিয়ামের সবকটা রিড টিপে গান গাইতে পারে।’ ওনার কলম সংগ্রহের হবি ছিল, আমারও ছিল। ফলে আমাদের দু’জনের কাছেই কলম সংগ্রহকারী বা কলম বিক্রেতারা আসতেন। ভাল কলম পেলে আমাকে ফোন করে জানাতেন ‘একটা পেয়েছি’। আমি তাঁকে বলতাম, ‘আমিও পেয়েছি’।
এইভাবে চলতে চলতে আরও আকাকাছি আসতে আসতে এটুকু মনে হয়েছে– ওনার কলমে লেখার অসাধারণ শক্তি ছিল। অনেক দেখা ছিল, ভ্রমণ ছিল। মনে পড়ছে, একবার উত্তরবঙ্গে অরণ্যে তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। শীতের রাত। আমরা সবাই কম্বল মুরি দিয়ে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছি। তিনি ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন– ‘চুপ! একটাও শব্দ করবে না। হাতি আসবে একটু পরে। গুলির মতো বড় বড় জোনাকি জঙ্গলের মধ্যে লকলক করে লাফিয়ে উঠছে। আমরা নিঃশব্দে কম্বল মুরি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বুদ্ধদেব গুহ তখন আমাদের নেতা। একটু পরেই হাতি এল। এই স্মৃতিগুলো তো ভোলা যায় না।
কয়েকদিন আগেই আমাকে ফোন করেছিলেন কোনও একটা ব্যাপারে। কেউ একজন আমার লেখা নিয়ে কিছু একটা করটে চেয়েছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম– ‘দাদা, আমি আপনাকে আমার সব বকলমা দিয়ে দিলাম’। তিনি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে খুব দরাজ গলায় ডাকতেন– সঞ্জীব! এটাই ডাকটার মধ্যে আপন করে নেওয়ার প্রয়াস ছিল। এসব কখনও ভুলব না।