এক দেশ, এক নির্বাচন। চর্চা-বিতর্ক তুঙ্গে। তার মাঝেই আজ, ১৭ ডিসেম্বর লোকসভায় পেশ হল ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ বিল। কিন্তু এই বিল কি পাশ হবে? পাশ হলেও, বাস্তবায়ন কি সম্ভব? এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে এইরকম নানা প্রশ্ন উঠছে। সরকার পক্ষের যুক্তি, এই বিল আইনে পরিণত হলে নির্বাচন পদ্ধতি সহজ হবে। কমবে বিপুল খরচ। সেই টাকা দেশের উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এতো ভাল বিষয়, তাহলে বিরোধীদের এত আপত্তি কীসের? ইন্ডিয়া জোটের সাংসদরা কেউ বলছেন, এতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে দেশে, কেউ আবার বলছেন, এক দেশ, এক নির্বাচন দেশের সংবিধান সংবিধানকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে। কেন এক দেশ, এক নির্বাচন বিরোধীদের চক্ষুশূল?
এক বছর আগে থেকেই এক দেশ, এক নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তবে এর স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনেক আগেই। ২০১৪ সালেই বিজেপির নির্বাচনী ইস্তোহারে এক দেশ, এক নির্বাচনের উল্লেখ ছিল। ২০১৬ সালেও এই প্রস্তাব এনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ২০১৯ সালে একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন।
গত বছর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি গঠন হয়েছিল। সেই কমিটি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়, ২৬ হাজার পাতার সুপারিশ জমা দেয়। চলতি শীতকালীন অধিবেশনের আগেই মন্ত্রিসভায় সবুজ সঙ্কেত পায় এক দেশ, এক নির্বাচন। এবার পালা ছিল সংসদে বিল পেশ করার। আজ লোকসভায় এই বিল পেশ করা হয়। বিল পেশের আগেই তো সে তুলকালাম কাণ্ড। বিল পেশ করতে দেওয়া হবে না, দাবি ইন্ডিয়া জোটের সাংসদদের। অন্যদিকে, নাছোড় সরকার পক্ষও। অবশেষে বিল পেশ নিয়ে ভোটাভুটি হয়, বিল পেশের পক্ষে ভোট পড়ে ২৬৯, বিপক্ষে ১৮৯।
বিল পেশের পরই লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, এই বিল নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী যুগ্ম সংসদীয় কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। সকল স্তরে এই বিল নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। অন্যদিকে, বিল পেশের বিরোধিতা করে ডিভিশন চায় বিরোধীরা।
এক দেশ এক নির্বাচন বিলের বিরোধিতা কেন, তা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “এই বিল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী। আমেরিকার মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতি (Presidential style of election) বলবৎ করতে চাইছে সরকার”। তৃণমূল সাংসদের যুক্তি, “দলত্যাগ বিরোধী আইন শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত এক দেশ এক নির্বাচন কাঠামো যুক্তিযুক্ত নয়। যেকোনও সময় বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের ভাঙিয়ে সরকার ফেলে দিতে পারে। এর নেপথ্যে বিজেপির লুকনো কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে।”
কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি বলেন, “এক দেশ, এক নির্বাচনে সংবিধানের কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে”। সমাজবাদী পার্টির সাংসদ ধর্মেন্দ্র যাদব বলেন, “এই বিল একনায়কতন্ত্র স্থাপন করছে”।
যদিও বিজেপির যুক্তি, তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারেই এক দেশ, এক নির্বাচনের উল্লেখ ছিল। জনসমর্থন নিয়েই সরকার একে একে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে। ঠিক যেভাবে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার বা রাম মন্দির তৈরি করা হয়েছে।
যে বিল নিয়ে এত বিতর্ক, তার সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলি জানা দরকার। ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই আইনে দেশে একই সময়ে লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত সহ সমস্ত নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে।
বিভিন্ন রাজ্যে আলাদাভাবে বিধানসভা নির্বাচন হয়। আবার দেশজুড়ে লোকসভা নির্বাচনের আয়োজন আলাদা। এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের জন্য় খরচ হয়েছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নির্বাচনী প্রচারের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে। এক দেশ, এক নির্বাচন হলে, একবারই এই ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনী প্রচার, ব্যবস্থা সবকিছুর খরচ একধাক্কায় অনেকটা কমে যাবে।
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্য়বস্থা চালু হলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও কার্যক্ষমতাও বাড়বে, কারণ লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনের জন্য সরকারি কর্মীদের ভোটের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে প্রশাসনিক কাজে প্রভাব পড়ে। একবারই নির্বাচন হলে প্রশাসনিক কাজে একবারই প্রভাব পড়বে।
এছাড়া কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতি ও কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়ন এবং তা চালু করতেও সুবিধা হবে। যেকোনও নির্বাচনের আগেই আদর্শ আচরণ বিধি জারি করা হয়। এরফলে নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা যায় না। আটকে যায় রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের কাজ। এক সময়ে গোটা দেশে নির্বাচন হয়, তবে বিভিন্ন সময়ে নতুন প্রকল্প শুরুর ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না। একসঙ্গে নির্বাচন হলে ভোটের হারও তুলনামূলকভাবে বাড়বে বলেই অনুমান।
এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের আপত্তির প্রথম যুক্তিই হল, সংবিধানের সংশোধন। একসঙ্গে লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচন করার জন্য সংবিধানের একাধিক ধারায় সংশোধন করতে হবে। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনেও পরিবর্তন করতে হবে।
বিরোধীদের দাবি, এক দেশ, এক নির্বাচন চাপিয়ে দিয়ে রাজ্যগুলির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একসঙ্গে নির্বাচন হলে, জাতীয় স্তরের ইস্যু নিয়েই আলোচনা-প্রচার হবে। রাজ্যের যে সমস্যাগুলি, তা তুলে ধরার সুযোগই পাওয়া যাবে না।
এছাড়া জাতীয় দলগুলি লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের জন্য যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করে, তা আঞ্চলিক দলগুলির পক্ষে করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান দলগুলিই প্রচারে বেশি মাইলেজ পাবে।
তবে বিরোধীদের সবথেকে আপত্তি তথা চিন্তার কারণ হল ভোটাররাই। তাদের মতে, একসঙ্গে নির্বাচন হলে ভোটাররা বিভিন্ন দলে ভোট দেবে না। এক দলেরই পাল্লা ভারী হবে। লোকসভায় এক দল, বিধানসভায় আরেক দল- এই জনমত অনেকটাই প্রভাবিত হবে। ভোটাররা সেক্ষেত্রে এক দলকেই সব নির্বাচনে ভোট দিতে পারে।
এক্ষেত্রে ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরেছিল বিরোধীরা। তাতে দেখা গিয়েছিল, একই সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হলে, ভোটাররা একই দলকে দুই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। সেখানেই যদি ৬ মাসের ব্যবধানে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হয়, তবে ৬১ শতাংশ ভোটাররা এক দলকে বেছে নিতে পারে।
সংসদে এই বিল পাশ করানোর জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনের প্রয়োজন। অর্থাৎ ৫৪৩ আসনের লোকসভা এবং ২৪৫ আসনের রাজ্যসভায় মোট ৬৭ শতাংশ সমর্থন পেতে হবে সরকারকে। বিধানসভার ক্ষেত্রে, অন্তত ১৪টি রাজ্যের বিধানসভায় এই বিল পাশ করাতে হবে। সংসদে এই দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন নিয়ে আজই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রেখেছেন বিরোধী সাংসদরা।
লোকসভায় দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন পেতে হত। মোট ৪৬১ ভোটের মধ্যে কমপক্ষে ৩০৭টি ভোট পেতেই হত। কিন্তু সপক্ষে ভোট পড়ে মাত্র ২৬৯। বিপক্ষে ভোট পড়ে ১৯৮। এরপরই বিরোধী সাংসদরা বলছেন, এই বিল প্রয়োজনীয় সমর্থন পায়নি। তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আজকের ভোটাভুটিতে ইন্ডিয়া জোটের ঐক্যের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেছে। টিডিপি এবং জেডিইউ কখনও যদি বিরোধীদের পক্ষে চলে আসে, তবে এই বিল দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পাশ হবে না।”
যদি এই অধিবেশনেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ পাশ হয়, তাহলেও ২০২৯ সালে এক দেশ, এক নির্বাচন সম্ভব নয়। রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাবেই বলা হয়েছে, ২০৩৪ সালের আগে কোনওভাবেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
খসড়া বিলের প্রস্তাব অনুযায়ী, লোকসভা নির্বাচনের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি ‘এক দেশ, এক নির্বাচনের’ তারিখ নির্দিষ্ট করে বিজ্ঞপ্তি জারি করবেন। অর্থাৎ ২০২৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠন হলেই তা সম্ভব। এর পরবর্তী পাঁচ বছরে সমান্তরাল নির্বাচনের পরিকাঠামোগত প্রস্তুতি চলবে। সেক্ষেত্রে, ২০২৯ সালের পর যে যে রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন হবে, ২০৩৪-এর লোকসভা ভোটের সময় সেই সরকার ভেঙে দিয়ে লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সমান্তরাল নির্বাচন হবে।
যদি কোন বিধানসভা বা লোকসভা মেয়াদ শেষের আগেই ভেঙে যায়, তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনে গঠিত সরকারের মেয়াদ অবশিষ্ট সময়ের জন্যই থাকবে।
বিরোধীদের দাবি, আপাতত সংসদে এই বিল পেশ করা হলেও বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য বিল স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাতে হবে।