ইম্ফল: ভয়াবহ আকার নিয়েছে মণিপুরের সাম্প্রদায়িক হিংসা। এই নজিরবিহীন হিংসার আগুন থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। রবিবার (৪ জুন) সন্ধ্যায়, ইম্ফলের ইরোইসেম্বা এলাকায় এক সাত বছরের কিশোর, তার মা এবং তাদের প্রতিবেশী এক মহিলাকে অ্যাম্বুল্যান্স শুদ্ধ নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। অসম রাইফেলস বাহিনীর এক ক্যাম্পে একটি বুলেটের স্প্লিন্টার লেগেছিল শিশুটির মাথায়। তাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সঙ্গে পুলিশি নিরাপত্তাও ছিল। কিন্তু, মাঝ পথে গাড়ি থামিয়ে ওই নৃশংস হত্যা করা হয়। শিশুটিকে দেখেও দুষ্কৃতীদের এতটুকু হাত কাঁপেনি।
নিহত শিশুটির নাম টংসিং হ্যাংসিং। মণিপুরের কাংপোকপি জেলার কাংচুপ গ্রামে থাকত সে। ৩ মে থেকে গোটা মণিপুর জুড়ে সংখ্যালঘু মেইতেই এবং আদিবাসী কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। যার বলি হয়েছেন ৭০-এর বেশি মানুষ। কাংচুপ গ্রামে মূলত কুকি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। তবে, এটি কুকি অধ্যুষিত পাহাড় এবং মেইতেই অধ্যুষিত উপত্যকার মাঝামাঝি এলাকায় অবস্থিত। কাজেই গ্রামটির সংঘর্ষের কবলে পড়া একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। তাই, সংঘর্ষ শুরুর পরের দিনই অর্থাৎ, ৪ মে, ৭ বছরের টংসিং-কে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়েছিল তার পরিবার। গ্রামের ঠিক বাইরে অবস্থিত অসম রাইফেলস-এর এক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই থেকে শিবিরের ভিতরে একটা জল শোধনাগার হয়ে উঠেছিল তাদের ঠিকানা। সশস্ত্র বাহিনীর শিবিরে আছে, তাই বাইরের হিংসা তাদের ছুঁতে পারবে না, এমনই ভেবেছিল টংসিং-এর পরিবার।
কিন্তু, সবকিছু তাদের পরিকল্পনামাফিক ঘটেনি। শিবিরের আশপাশে বেশ কয়েকটি কুকি এবং মেইতেই সম্প্রদায়ের বাঙ্কার রয়েছে। ৪ জুন বিকেলে, দুই পক্ষ একে অপরকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা শুরু করেছিল। তারই একটি গুলির ভাঙা অংশ শিবিরের ভিতরে টংসিংয়ের মাথায় আঘাত করেছিল। গুলি প্রথমে একটি জানালার লোহার রডে লাগে, তারপর ভেঙে গিয়ে একটি অংশ টংসিংয়ের মাথায় লাগে। টংসিংয়ের মা মীনা হ্যাংসিংয়ের হাতেও ওই গুলির আরেকটি টুকরো লেগেছিল। টংসিংকে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। অসম রাইফেলস-এর কর্তারা বুঝেছিলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাদের কাছে দুটি বিকল্প ছিল – কাংপোকপি জেলার লেইমাখং শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অথবা ২০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী ইম্ফলের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
দুই ক্ষেত্রেই ঝুঁকি ছিল। লেইমাখং কুকি অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি মেইতেই গ্রাম রয়েছে। অন্যদিকে ইম্ফল পুরোপুরি মেইতেই অধ্যুষিত। তবে তার দূরত্ব অনেক কম। দুই বিকল্পই বিবেচনা করে অসম রাইফেলস-এর কর্তারা ঠিক করেন, ইম্ফলেই নিয়ে যাওয়া হবে টংসিংকে। ইম্ফল পশ্চিমের এসপি এস ইবোমচা-কে ফোন করে একটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলা হয়। দ্রুতই এসেছিল সেই অ্যাম্বুলেন্স। সঙ্গে খোদ ইম্ফল পশ্চিমের এসপি। টংসং-এর সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সে ওঠেন তার মা মীনা এবং প্রতিবেশী লিডিয়া লোরেম্বাম। মীনা এবং লিডিয়া দুজনেই ছিলেন মেইতেই সম্প্রদায়ের। আদতে ইম্ফলের বাসিন্দা, মীনা, বিয়ে করেছিলেন কুকি সম্প্রদায়ের জোশুয়া হ্যাংসিংকে। অন্যদিকে লিডিয়া এবং তাঁর স্বামী নওটন লোরেম্বাম মেইতেই হয়েও, কুকি-অধ্যুষিত গ্রামেই থাকতেন শান্তিতে।
বিকেল ৫টা নাগাদ, ইম্ফলের রিমস হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল অ্যাম্বুলেন্সটি। সঙ্গে তিনটি গাড়িতে এসপি-সহ ছিলেন ১০ পুলিশকর্মী। অসম রাইফেলসের একটি দলও পুলিশের গাড়িটির সঙ্গে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপর, তাদের আটকে দিয়েছিল মণিপুরের অত্যন্ত শক্তিশালী মেইতেই মহিলাদের সংগঠন, ‘মেরা পাইবিস’রা। এরপর, অসম রাইফেলসকে যেখানে আটকে দেওয়ার হয়েছিল, তার মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরেই ইম্ফলের ইরোইসেম্বা এলাকায় মেইতেইদের একটি বিশাল দল তাদের কনভয়কে আটকেছিল। অসম রাইফেলসের এক কর্তার মতে, তার আগেই ওই অঞ্চলে গুজব রটেছিল যে, ওই অ্যাম্বুলেন্সে গোপনে কুকি জঙ্গিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
উন্মত্ত জনতা আর কিছু ভাবেইনি। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর এক গুরুতর আহত শিশু রয়েছে, তার সঙ্গে থাকা দুই মহিলা মেইতেই সম্প্রদায়েরই – এসব কিছুই প্রভাব ফেলেনি। পুলিশের কনভয়ে হামলা চালায় তারা এবং টংসিং, মীনা এবং লিডিয়া-সহ অ্যাম্বুলেন্সটি পুড়িয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই দগ্ধে মারা যান আহত শিশুটি-সহ ওই দুই মহিলা। পুলিশের তিনটি গাড়িও ধ্বংস করে জনতা। দুই পুলিশ কমান্ডো আহত হন। অন্য একটি গাড়িতে কোনওরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালান এসপি। মণিপুর পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন ওই ঘটনার পর, সেখান থেকে দেহ বলে কিছু পাওয়াই যায়নি। ঘটনাস্থলে পড়েছিল শুধু দুটি হাড়! কবে, এই হিংসার অবসান ঘটবে, এখন সেই দিকেই তাকিয়ে বসে আছেন মণিপুরের শান্তিকামী মানুষ। নাহলে টংসিং-এর মতো অনেক সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে।