মহামান্য আদালত যখন দলিতের সুবিধালাভে বিচলিত হন, বোঝা যায় আয়োজন সম্পূর্ণ

দলিতরা দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগণ কিন্তু তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সাহিত্য়, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান কোনও কিছুই মান্য সিলেবাসের তালিকায় আনা হয়নি।

মহামান্য আদালত যখন দলিতের সুবিধালাভে বিচলিত হন, বোঝা যায় আয়োজন সম্পূর্ণ
গ্রাফিক্স: অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Mar 24, 2021 | 5:07 PM

তৃপ্তি সান্ত্রা, সাহিত্যিক, দলিত সাহিত্য আকাদেমির সদস্য

শিক্ষা ও চাকরির সংরক্ষণ প্রশ্নটি হাস্যকর। চাকরি কোথায়– সর্বত্র বেসরকারিকরণের প্রজেক্ট, সংরক্ষণের প্রশ্নই নেই। শিক্ষায় সংরক্ষণ? সেখানেও বেসরকারিকরণের রমরমা। সুতরাং সংরক্ষণ নেই।

উচ্চবর্ণের শিক্ষার অধিকার হাজার হাজার বছরের হাজার হাজার প্রজন্মের। হাজার হাজার বছর ধরে দলিতের শিক্ষার অধিকার ছিল না। শম্বুক, একলব্যের স্পর্ধার শাস্তির কথা আমরা জানি। তুকারাম থেকে চুণী কোটাল, রোহিত ভেমুলা- উদাহরণ অসংখ্য। মাত্র ৭০ বছরের সংরক্ষণের সুবিধার জন্য, মহামান্য আদালত যখন প্রশ্ন করেন, কত প্রজন্ম ধরে চলবে সংরক্ষণ, তখন হাসি পায়।

দলিতরা দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগণ কিন্তু তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান কোনও কিছুই মান্য সিলেবাসের তালিকায় আনা হয়নি। স্বীকারই করা হয়নি তাঁদের অস্তিত্ব। তাঁদের নিজের ভাষায় পড়ারও সুযোগ হয়নি। পড়তে হয়েছে প্রভুর মান্য ভাষায়। যা ইংরেজি ভাষার মতোই যা দূর্বোধ্য। নব্য-ক্ষত্রিয়, বণিয়া বৈশ্য সম্প্রদায়ের কেউ কেউ এক-দু-প্রজন্মে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য, বৈভব লাভ করেছেন। তাদের দেখে বৃহৎসংখ্যক দলিতকে বিচার করা ভুল হবে।

জমি, জল, জঙ্গল, খনি, নদী, পাহাড় সংলগ্ন মানুষ প্রতিনিয়ত কাজ হারাচ্ছেন। যন্ত্রের দাপটে মুছে গেল কত বৃত্তি। দুই একজন মেধাবি দলিত যখন কিছু বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান-সেটাকেই হাইলাইট করে ক্ষমতা রাষ্ট্রশক্তি সব গেল, সব গেল বলে আওয়াজ তোলে। সরকারি চাকরির স্থিতাবস্থায়, স্বাচ্ছন্দ্যে-এক প্রজন্মেই ব্যক্তি চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। পায়ের জিনিস পায়ে বসিয়ে রাখতে হয়, বলে উচ্চবর্ণের যে মনোভাব, মুষ্টিমেয় দলিতের বাড়বাড়ন্ত– তাদের অসূয়া বাড়ায়।

বিশ্বায়নে, বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে। অর্থের স্বাচ্ছন্দ্য চটুল ভোগবহুলতার দিকে ছোটায়। গুটিকয় ব্যক্তির ভাল থাকাকে, কেউ যদি বৃহতের স্বচ্ছলতা, উন্নতি বলে মনে করে, তো একটা বড় ভ্রম ও মিথ্যে। এই মিথ্যেটাকে সুচতুর ভাবে লালন করা হয়। দলিতের শ্রমের ফসল একচেটিয়া ভোগের জন্য। শ্রমজীবি মানুষদের দাস এবং অস্পৃশ্য করে সমাজের মূলস্রোত থেকে দূরে রাখার জন্য যে ধর্মকে ঘৃণ্য ‘চতুবর্ণ’ প্রথা তৈরি করতে হয়, শ্রমহীন বিলাসবহুল জীবন কাটাবার জন্য দলিতের মুক্তি তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। দলিতের উন্নতি দেখলে তারা হায় হায় করে ওঠেন। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ এখন মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার ও কোম্পানির উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ। কোম্পানির এই সব ঝাঁ চকচক ছবিকে উন্নয়ন বললে ভুল হয়। দুই একটি দলিত পরিবারের স্বচ্ছলতাকে বৃহতের উন্নয়নের অন্তরায় বলে দেখানো হলে দায় কমে। যেমন দায় কমে যাবতীয় ব্যর্থতার দায়কে সংখ্যালঘুর ওপর চাপিয়ে দিলে। সীমান্তে দেশপ্রমের গল্প ফেঁদে।

সংরক্ষণের বিরুদ্ধে আঁচ বিশেষভাবে টের পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির ক্ষেত্রে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণদের সংরক্ষণের জন্য ঈর্ষার একটা মানে বোঝা যায়। কিন্তু দেশের মহামান্য আদালত যখন স্বল্পসংখ্যক অনগ্রসর শ্রেণির আপাত অগ্রসরে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন, দলিতের সুবিধালাভে বিচলিত হন, উর্দ্ধসীমা না থাকলে অসাম্য হবে বলে চিন্তিত হন, বোঝা যায় আয়োজন সম্পূর্ণ। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে যে ভাবে একের পর এক বিনা বাধায় কর্পোরেটের হাতে দেশকে বেচে দেবার ধূম– সংরক্ষণের ওপর তেমন এক আঘাত আসার প্রস্তুতি। আশঙ্কা এ সবই রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব খর্ব করার পদক্ষেপ। নির্বাচনে, সংরক্ষিত প্রতিনিধির আসন সংকুচিত হলে, মুঠ্ঠি মে রাজ। দলিত দমনের কর্মযজ্ঞ সম্পূর্ণ।

(মতামত ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন: ব্রিটেনের মতো ভারতেও করোনার ভ্যারিয়েন্টের খোঁজ, কেন্দ্রের খবরে কতটা বাড়ল দুশ্চিন্তা?