ফারজান আখতার, নয়া দিল্লি: দিন কয়েক আগেই, ভারতে আসার পথে, ড্রোন হামলা হয়েছে, এমভি কেম প্লুটো ট্যাঙ্কারে। এই হামলার পর, পশ্চিম এশিয়া থেকে ভারতগামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে রক্ষার লক্ষ্যে, এই এলাকার সমুদ্রে নজরদারি বাড়িয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসকারী রণতরী পাঠিয়েছে নৌসেনা। আসলে, এখনও পর্যন্ত এই ‘ডেস্ট্রয়ার’ রণতরীগুলিই ভারতীয় নৌসেনার সবথেকে বড় এবং সবথেকে শক্তিশালী রণতরী। মঙ্গলবারই আইএনএস ইম্ফলকে জলে নামিয়েছে নৌসেনা। এরপর, ২০২৪-এ সমুদ্রযাত্রা শুরু করার কথা আরও এক ডেস্ট্রয়ার, আইএনএস সুরাটের। কিন্তু, তারপর? প্রায় এক দশক আর কোনও ভারতীয় ‘ডেস্ট্রয়ার’ তৈরির পরিকল্পনা এখনও পর্যন্ত নেই নৌসেনার। আর সেটাই নৌসেনার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
‘ডেস্ট্রয়ার’ রণতরীগুলি, আকাশ, স্থল, সমুদ্র এবং জলের নীচে থাকা হুমকিরও মোকাবেলা করতে পারে। সেইসঙ্গে এই রণতরীগুলিতে ঠাসা থাকে গাইডেড মিসাইল, রকেট, বন্দুক এবং টর্পেডোর মতো ভারী-ভারী অস্ত্রশস্ত্র। সঙ্গে কোনও বিমানবাহী রণতরী জুড়ে দিয়ে, ডেস্ট্রয়ারগুলিকে আরও ভয়ঙ্কর রূপ দেয় নৌসেনা। ভারতের সাম্প্রতিকতম ডেস্ট্রয়ার, আইএনএস ইম্ফল একটি প্রজেক্ট ১৫বি স্টেলথ গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। ভারতীয় নৌবাহিনীর বিশাখাপত্তনম-শ্রেণির তৃতীয় ডেস্ট্রয়ার এটি। এর আগে, এই শ্রেণির আরো দুটি ডেস্ট্রয়ার – আইএনএস বিশাখাপত্তনম এবং আইএনএস মরমুগাও-এর পথ চলা শুরু হয়েছিল। প্রোজেক্ট ১৫ দিল্লি ক্লাস এবং প্রোজেক্ট ১৫এ কলকাতা ক্লাসের ধারাবাহিকতাতেই গ্রহণ করা হয়েছিল প্রোজেক্ট ১৫বি বিশাখাপত্তনম ক্লাস।
গত শতাব্দীর আটের দশকের শেষের দিকে, রুশ জাহাজ নির্মাতাদের সহায়তায়, ডেস্ট্রয়ার তৈরির প্রকল্প শুরু করেছিল ভারত। ১৯৯৭ সালে জলে নেমেছিল ভারতের প্রথম ডেস্ট্রয়ার, আইএনএস দিল্লি। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্প থেকে মোট ১০টি ডেস্ট্রয়ার পেয়েছে নৌবাহিনী। বিশাখাপত্তনম ক্লাসের সবকটি জাহাজ সরবরাহের পর-পরই পরবর্তী প্রজন্মের ডেস্ট্রয়ার তৈরির প্রকল্প শুরু করতে চেয়েছিল নৌসেনা। কিন্তু, সূত্রের খবর, ২০৩০ সালের আগে এই প্রকল্প শুরু হওয়ার কোনও আশা নেই। কাজেই, পরবর্তী ডেস্ট্রয়ারগুলি পেতে পেতে অন্তত এক দশক দেরি হবে।
ইন্ডিয়ান মেরিটাইম ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, কমডোর অনিল জয় সিং জানিয়েছেন, ডেস্ট্রয়ারগুলি একটি সিরিজে তৈরি হয়। যেগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে, সেগুলি প্রতিস্থাপনের জন্য নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হয়। এই কথা মাথায় রেখেই ডেস্ট্রয়ার নির্মাণের সিরিজ পরিকল্পনা করা উচিত। তবে, নয়া প্রকল্পের কাজ শুরুর বিলম্বের পিছনে নকশা ও নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সময় এবং জাহাজ নির্মাণের ক্ষমতার পাশাপাশি আর্থিক সমস্যাও একটা বড় কারণ বলে জানা গিয়েছে। এই কারণেই বিশাখাপত্তনম ক্লাসের সবকটি ডেস্ট্রয়ারগুলি সরবরাহের সঙ্গে সঙ্গে পরের প্রজন্মের ডেস্ট্রয়ার তৈরির প্রকল্প শুরু করা যাচ্ছে না।
কেন ভারতের এই পরবর্তী প্রজন্মের ডেস্ট্রয়ারগুলি প্রয়োজন বলে মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা? জানা গিয়েছে, নয়া প্রকল্পে আটটি ডেস্ট্রয়ার তৈরির পরিকল্পনা করেছে নৌসেনা। এই রণতরীগুলি, ১০,০০০ টনের বেশি ওজন বহনে সক্ষম হবে এবং এগুলিতে আরও বেশি করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র যোগ করা হবে। আরও ভালো অস্ত্র, সেন্সর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন, ইউইউভি, রিয়েল টাইম ডেটা লিঙ্ক, এমনকি কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিতে, এগুলি ভবিষ্যতের যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে ভারতের ডেস্ট্রয়ারগুলি, মার্কিন ডেস্ট্রয়ারগুলিকে পাল্লা দিতে পারে। তবে, ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রথম ডেস্ট্রয়ারগুলির আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। কিছু ইতিমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে। এগুলি অনুশীলনের জন্য ভাল হলেও, যুদ্ধক্ষেত্রে আর যথেষ্ট শক্তিশালী নয়।
এই নিয়ে এখনই চিন্তার কোনও কারণ নেই বলেই মনে করছেন নৌসেনা কর্তারা। তো ভালো। কারণ, ভারতদের হাতে এখন যে দিল্লি ক্লাস এবং কলকাতা ক্লাসের মোট ১০টি ডেস্ট্রয়ার রয়েছে, সেগুলিকে আপগ্রেড করা যাচ্ছে। নয়া অস্ত্র, নয়া সেন্সর লাগানো হয়েছে। ব্রহ্মোস, বরুণাস্ত্রের মতো সব ধরণের আধুনিক অস্ত্র, হেলিকপ্টার ইত্যাদি যোগ করা হয়েছে। এগুলি দিয়ে এখনও ৩৫ থেকে ৪০ বছর কাজ চলতে পারে। কিন্তু, ভারত মহাসাগরে অদূর ভবিষ্যতেই চিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দুর্দান্ত শক্তির প্রতিযোগিতা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্য সাগরে প্রবেশ করতে চাইলে, চিনকে ভারত মহাসাগরে প্রভাব বাড়াতেই হবে। সেই ক্ষেত্রে, ভারত মহাসাগরের একটা বড় অংশে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে ভারতীয় নৌবাহিনীকে। আর এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে, নতুন প্রজন্মের ডেসট্রয়ারগুলি প্রয়োজন বলে জানাচ্ছএন তাঁরা।