Bow Barrack: যেন মুকুটহীন বো ব্যারাক! খাঁচাটা পড়ে আছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম চলে যাচ্ছে বিদেশে…..

Bow Barrack: করেনটাইন ক্যাম্পেই আলাপ হয় পর্তুগীজ রমণী গার্টহুড সালভাডোরের সঙ্গে। প্রেম হয়, সেখান থেকে বিয়ে। কলকাতায় পাকাপাকি বসবাস শুরু ১৯৩০ সালের আশেপাশে। ঠিকানা বৌবাজারের বো ব্যারাক। এখানেই জন্মালেন মেয়ে নাতালিয়া কোভাল্ট।

Bow Barrack: যেন মুকুটহীন বো ব্যারাক! খাঁচাটা পড়ে আছে, ভবিষ্যত প্রজন্ম চলে যাচ্ছে বিদেশে.....
বো ব্যারাকের খাঁচা আগলে বসে থাকেন নাতালিয়া। ছবি: নিজস্ব চিত্র
Follow Us:
| Updated on: Dec 27, 2021 | 9:30 PM

শু ভে ন্দু দে ব না থ:

১৯১৭ সাল, যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়া। পুরো দেশ জ্বলছে, সকলের আশা রাশিয়ান বিপ্লব দেশকে নতুন মাত্রা দেবে। কিন্তু বিপন্ন জনজীবন, চাকরি নেই। এই অবস্থায় এক ২২ বছরের নিঃস্ব, কপর্দকহীন তরুণ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দেশ ছাড়লেন । নানা দেশ ঘুরে অবশেষে বার্মায় পৌঁছলেন সেই তরুণ ডিমিট্রি কোভাল্ট। সেখান থেকে সাংহাই। কিছুদিন কাটিয়ে যোগ দিলেন রাশিয়ান সার্কাসে, এলেন ভারতে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাকে উদ্বাস্তু ভেবে ঢুকিয়ে দেয় করেনটাইন ক্যাম্পে, অনেকটাই ডিটেনশন ক্যাম্পের ধাঁচে, কিন্তু হিটলারের ক্যাম্পের মতো অতটাও ভয়ঙ্কর নয়। সেখান থেকে আবার বেরিয়ে ডিমিট্রি যোগ দিলেন রাশিয়ান সার্কাসে চলে এলেন কলকাতায়। তার আগে এই করেনটাইন ক্যাম্পেই আলাপ হয় পর্তুগীজ রমণী গার্টহুড সালভাডোরের সঙ্গে। প্রেম হয়, সেখান থেকে বিয়ে। কলকাতায় পাকাপাকি বসবাস শুরু ১৯৩০ সালের আশেপাশে। ঠিকানা বৌবাজারের বো ব্যারাক। এখানেই জন্মালেন মেয়ে নাতালিয়া কোভাল্ট। রাশিয়া আর পর্তুগীজ রক্তের এক অসাধারণ ৭৯ বছরের তরুণী, যিনি চির তরুণী। বেড়ে ওঠা কলকাতায়। কিন্তু এখনো বাংলা বলতে পারেন না নাতালিয়া, আফসোস আছে তার সে নিয়ে। যৌবনে কিভাবে যেন প্রেমে পড়ে যান এক কাশ্মীরি মুসলমান তরুণের। বিয়েও করেন তারা। ক্রিসমাস ইভের সন্ধ্যায় বো ব্যারাকের বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল নাতালিয়া আর তার নাতনি স্টেফিনি ঝাউয়ের সঙ্গে। নাতালিয়ার হয়ে বেশিরভাগ জবাব দিচ্ছিলেন স্টেফিনি, থাকেন লন্ডনে, সেখানকার এক হাসপাতালের নার্স নাতালিয়া ঠাকুমার হাতের তৈরি ওয়াইন আর কেক খেতে দিয়ে আড্ডা দিলেন।

আপনাদের পরিবার সম্পর্কে কিছু বলুন

নাতালিয়া: আমি আসলে কোনো প্রচার চাই না, খবরের কাগজে আমার নাম বেরক চাই না, ভয় করে। তাছাড়া আমার মেয়ের পছন্দও নয় এসব।

বাধ্য হয়ে স্টেফিনির দিকে তাকাই, আমাকে উদ্ধার করে স্টেফিনি।

স্টেফিনি: দেখো চারদিকে যা চলছে, আর তাছাড়া মা পছন্দ করে না এসব, তার উপর আমরা এই ক্রিসমাসে সামান্য ওয়াইন আর কেক বেচি, ছবি আর আমাদের কথা প্রকাশ হয়ে গেলে পাড়ার সকলে জেনে যাবে। জানোই তো কিভাবে বাঁচি এখানে। তবু যতটা আমি জানি বলছি। ঠাকুরদার বাবা রাশিয়া থেকে এসেছিলেন, রাশিয়ান সার্কাসে ট্রপিজের খেলা দেখাতেন। করেনটাইন ক্যাম্পে ছিলেন, আমরা এখানে নিজেদের মতো থাকি।

তোমার পরিবার সম্পর্কে বলো

স্টেফিনি: আগেই বলেছি আমার প্রপিতামহ ছিলেন রাশিয়ান, এখানে ভারতে এসে তিনি এক পর্তুগিজকে মহিলা গার্টহুড সালভাডোরকে বিয়ে করেন । তাদের সন্তান আমার ঠাকুমা নাতালিয়া। ঠাকুমা এক কাশ্মিরী মুসলিমকে বিয়ে করেন। তিনিই আমার ঠাকুরদা। তোমাকে বলি আমার ঠাকুরদাও কিন্তু করেনটাইন ক্যাম্পে ছিলেন।

কি নাম তোমার মায়ের আর ঠাকুরদার

স্টেফিনি: নামটা বলতে পারব না।

কেনো?

স্টেফিনি: আসলে আমার মা এসব পছন্দ করেন না। তিনি রাগ করেন। ভয় পান, বুঝতেই পারছো চারদিকের যা অবস্থা। পাড়ার লোক বলাবলি করবে। তুমি আমার গ্রেট গ্র্যান্ড মম আর গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো আমি বলতে পারব। তাকে আমি দেখছি। ৬ ফুটের উপর লম্বা, নীল চোখ, রিয়েল হাঙ্ক বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন।

আচ্ছা তুমি কি করো?

স্টেফিনি: আমি লন্ডনে একটা নার্সিং হোমের নার্স। বছরের এই সময়টা এখানে চলে আসি গ্র্যানির সঙ্গে কাটাতে। (এর মধ্যেই বো ব্যারাক ঘুরতে আসা কেউ কেউ খোঁজ পেয়ে আসছেন, ঘরে তৈরি রেড ওয়াইনের লোভে কিনতে। বোতলের পর বোতল নিয়ে যাচ্ছেন তারা, সঙ্গে নাতালিয়ার তৈরি কেক)।

তোমাদের পরিবার সম্পর্কে বলো মানে তোমার মায়ের দিকের

স্টেফিনি: দেখো আমার মা একজন চাইনিজকে বিয়ে করেছিলেন। বাবার নাম জিজ্ঞাসা করো না। মা রাগ করবে। আমি তাদের সন্তান। বিয়ে করিনি, করতেও চাই না, এই বেশ ভাল আছি, নিজের জীবনকে আমি উপভোগ করি। খামোকা বিয়ে, সন্তান এসবে আমার বিশ্বাস নেই।

এবার নাতালিয়াকে প্রশ্ন করি কেমন লাগে কলকাতা?

নাতালিয়া: ভাল, আগে আরো ভাল ছিল। এখন আর তেমন নেই। আমাদের সময়ে মানে ছেলেবেলার কলকাতার সঙ্গে এই কলকাতাকে মেলাতে পারি না জানো। কিসব দিন ছিল, আমাদের কত বাঙালি বন্ধু ছিল জানো, তারা ছিল উদার। তোমাদের এক পোয়েট অনেকবার আসত আমার বাড়িতে আড্ডা দিতে। কি নাম যেনো, শক্তি শক্তি… হ্যাঁ মে বি চ্যাটার্জি। আমার হাবির সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল। আমাদের বাড়িতে ওরা আড্ডা মারত, পোয়েট্রি পড়ত। দেদার খানাপিনা চলত।

স্টেফিনি: আসলে এখন মানুষ বদলে গেছে, নোংরা পলিটিক্স। যে কারণে আমি লন্ডন চলে গেছি। তোমরা যারা বো ব্যারাক দেখতে আসো এখন আর আগের মতো পাবে না জাস্ট খাঁচাটা পড়ে আছে। চাকরি নেই। আমাদের প্রজন্ম চলে যাচ্ছে সব বিদেশে। আমি চলে গেছি, আমার বন্ধু বান্ধবও কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ কানাডা, কেউ ইউএসএতে চলে গেছে।

কেনো এমন বলছো?

স্টেফিনি: আসলে বো ব্যারাকের সেই প্রাণটা চলে গেছে। নানান মানুষ আসত, সারা বছর উৎসব পার্টি হইহুল্লোড়। এখন সেসব কোথায়? টাকা নেই, আমাদের বয়স্করা এখানে কোনোমতে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছেন, ধরে রাখার চেষ্টা করছেন আমাদের ঐতিহ্য। এই যে দেখছো ক্রিসমাসের উৎসব চলছে, এসব কিছুই না, আগে রাস্তা জুড়ে ডান্স হতো, দেদার খানাপিনা চলত, কত নাচ, কত গান, আনন্দ। কলকাতার ভেতর যে প্রাণটা ছিল জানো হারিয়ে যাচ্ছে সেটা।

ফিরতে চাও না কলকাতায়?

স্টে: চাই তো, কিন্তু ফিরে করব কি? এখন তো আবার কাগজপত্র দেখতে চাইছে, আছে নাকি কিছু দেখাব কোথা থেকে? তবে কলকাতার আমার ছেলেবেলা ভুলতে পারব না কোনোদিন। জানো আমাদের এখানে একটা চাইনিজ স্কুল আছে, আগে কত স্টুডেন্ট হত, এখন মেরে কেটে ১০ ১২ জন। পড়বে কে? চালাবে কি করে? কষ্ট হয় জানো।

কথা বলতে বলতেই স্টেফিনির মা চলে আসে। ফলে নাতালিয়া আর স্টেফিনির মুখ বন্ধ হয়ে যায়। উঠে পড়ি ওয়াইন আর কেক কিনে। স্টেফিনি আর নাতালিয়া দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। ফেরার সময় ৭৯ বছরের তরুণী নাতালিয়া বলে ইউ নো, আই রিয়েলি ওয়ান্ট ব্যাক দো’জ ডেস, দ্যাট ওল্ড ক্যালকাটা, দ্য রিয়েল ক্যালকাটা, গড নো’জ কলকাতা ফিরবে কিনা তার পুরোনো মেজাজে। চলে আসতে আসতে মাথার ভেতর কে জানি গুনগুন করে ওঠে,

“If you miss the train I’m on You will know that I am gone You can hear the whistle blow A hundred miles”

আরও পড়ুন: Fitness Resolutions: ফিট থাকতে নতুন বছরে নতুন শপথ! রইল গাইডলাইন…