কয়লা কেলেঙ্কারি ছিলই, তা বলে ক্যালিফোর্নিয়াম? তৃণমূল নেতার ঘরে ‘পরশ পাথর’ মানবিক না পরমাণবিক?
Californium: ঘটনায় রাজনৈতিক মহলেও তুমুল শোরগোল। নেতারাও তোপ দাগছেন। বিশেষজ্ঞরা নানা আশঙ্কা করছেন। তেজস্ক্রিয় উদ্ধারের ঘটনা তদন্তকারীদেরও কপালে ভাঁজ ফেলেছে। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়াম পাচারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে আন্তর্জাতিক চক্রের পাশাপাশি বিহার ও বাংলার চক্রের যোগ থাকার সম্ভাবনা উঠে এসেছে।
সুমন মহাপাত্র ও সিজার মণ্ডলের রিপোর্ট
খুনোখুনির কারবারে বোমা-বন্দুক-গুলি ছিলই। বাংলার রাজনীতিতে কি সাইলেন্ট কিলিং-এর অস্ত্রও আমদানি হচ্ছে? সপ্তাহখানেক আগে বিতর্কটা উস্কে দিয়েছিলেন বিজেপি নেতা অর্জুন সিং। তাঁর মুখেই বঙ্গ রাজনীতি প্রথম শুনেছিল রাশিয়ার কেমিক্যালের নাম। সঙ্গে গরু, কয়লা, পাথর, বালি পাচারের অভিযোগ তো ছিলই। এবার তেজস্ক্রিয় ধাতু পাচারেও নাম জড়াল তৃণমূলের! সেনা ও পুলিশের যৌথ অভিযানে নকশালবাড়ির তৃণমূল নেতা ফ্রান্সিক এক্কার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে পারমানবিক চুল্লির রাসায়নিক। সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে সেনাবাহিনীর বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিও। ক্যালিফোর্নিয়াম বলে সন্দেহ করা বিরল এই তেজস্ক্রিয়ের এক গ্রামের দাম প্রায় ১৭ থেকে ১৯ কোটি টাকা। তা জেনেই চোখ কপালে উঠছে আম-আদমির।
ক্যালিফোর্নিয়াম কী?
সিনথেটিক তেজস্ক্রিয় হিসেবে পরিচিত এই ধাতু/রাসায়নিক। ১৯৫০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে প্রথম তৈরি করা হয় এই ধাতু। বিশুদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়াম খোলা অবস্থায় থাকতে পারে না। থাকলেই সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক উপায়ে বিক্রিয়া করে কোনও ভিন্ন মৌলে রূপান্তরিত হয়। বিক্রিয়ার সময়ে ক্ষতিকারক রশ্মি তৈরি হতে পারে, যা ডেকে আনতে পারে মৃত্যু। ভাবা অ্যাটোমিক সেন্টারই একমাত্র এই তেজস্ক্রিয় মজুত করতে পারে। নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর বানানোর কাজে লাগে। কিন্তু, অত্যন্ত গোপনীয় স্থানে থেকে রাসায়নিক কী করে একেবারে আম-আদমির বাড়িতে চলে এল তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
পর্যায় সারণীর ৯৮তম মৌল এই ক্যালিফোর্নিয়াম। পৃথিবীতে মোট ৩৮টি তেজস্ক্রিয় মৌল আছে। তাদেরই একটি ক্যালিফোর্নিয়াম। ক্যালিফোর্নিয়াম প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না। ল্যাবেই একমাত্র তৈরি সম্ভব। পৃথিবীতে খুবই কম পরিমাণ বিশুদ্ধ এই মৌল আছে। ভারতে এই মৌল নিয়ে কাজ করে ভাবা ইন্সটিটিউট ও সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কিন্তু তা কী করে একেবারে আম-আদমির দোরগোড়ায় এসে গেল তা ভাবচ্ছে সেনা কর্তা থেকে পুলিশ কর্তাদের। ঘটনায় সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন সকলেই।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
অবসরপ্রাপ্ত বায়ু সেনা কর্তা আর কে দাস বলছেন, “এ খুবই গোপন জিনিস। সাধারণ মানুষের কাছে আসতেই পারে না। কিন্তু, কী করে একজনের বাড়িতে চলে এল? নিশ্চিতভাবে সিকিউরিটির গাফিলতি থাকছে, পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। দেশের জন্য একটা বড় চিন্তার বিষয়।” প্রাক্তন পুলিশ কর্তা অরিন্দম আচার্যের গলাতেও একই সুর। তিনি উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি করে বলছেন, “এনআইএ ও মিলিটারিকে হস্তক্ষেপ করতেই হবে। না হলে আমরা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ব।”
উদ্বেগের সুর যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের গলাতেও। তিনি বলছেন, “এটা তা এমনি খোলা বাজারে পাওয়া যায় না। ল্যাবেই তৈরি হয়। ল্যাবেই রাখা যায়। বাইরে খোলা অবস্থায় এলেই বিপদ। নিউক্লিয়ার রিয়্যাকশনের ভয় থেকে যায়। বড় বিস্ফোরণের আশঙ্কা থেকে যায়। সোজা কথায় এটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।”
লখনউ থেকে বিহার হয়ে বাংলা?
ঘটনায় রাজনৈতিক মহলেও তুমুল শোরগোল। নেতারাও তোপ দাগছেন। বিশেষজ্ঞরা নানা আশঙ্কা করছেন। তেজস্ক্রিয় উদ্ধারের ঘটনা তদন্তকারীদেরও কপালে ভাঁজ ফেলেছে। কারণ, ক্যালিফোর্নিয়াম পাচারের ক্ষেত্রে প্রাথমিক তদন্তে আন্তর্জাতিক চক্রের পাশাপাশি বিহার ও বাংলার চক্রের যোগ থাকার সম্ভাবনা উঠে এসেছে। প্রসঙ্গত, মাস ছয়েক আগে বিহারে ধরা পড়ে একটি চক্র। বিহারের গোপালগঞ্জ থেকে উদ্ধার হয় প্রায় ৫০ গ্রাম এই ধরনের রাসায়নিক। যা ক্যালিফোর্নিয়াম বলে মনে করা হচ্ছিল। সেই চক্রের যাঁরা ধৃত তাঁদের জেরা করেই এই তৃণমূল নেতার খোঁজ পাওয়া যায় বলে খবর। ২০২১ সালে লখনউ থেকে উদ্ধার হয় ক্যালিফোর্নিয়ামের মতো কিছু রাসায়নিক। গ্রেফতার করা হয় ৮ জনকে। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই এদিনের ঘটনায় সেনা কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে NIA। প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজও শুরু হয়েছে। পরবর্তীতে পাকাপাকিভাবে এই মামলার তদন্তভার NIA নিতে পারে।
কোথা থেকে এল DRDO-সেনার নথি?
এদিকে যে তৃণমূল নেতা বাড়ি থেকেই এই ধাতু উদ্ধার হয়েছে সেই ধৃত ফ্রান্সিস এক্কা এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা বলেই পরিচিত। তাঁর স্ত্রী শিলিগুড়ির মহকুমা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ। সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নাম জড়িয়ে যাওয়াতেই বাড়ছে চাপানউতোর। ফ্রান্সিস এক্কাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তৃণমূল নেতার স্বামী ফ্রান্সিস এক্কার বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে। সেই মতো গোপন সূত্রে খবর পেয়ে অভিযান চালায় সেনা ও পুলিশ। তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিলতে পারে সেই আশঙ্কা করেই নেতার বাড়িতে অভিযানে বিশেষ সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। স্বাভাবিকভাবেই দেশবিরোধী কাজের অভিযোগে তৃণমূল নেতার স্বামী গ্রেফতার হওয়ায় হতবাক এলাকার বাসিন্দারাও।
তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়াম নয়, একইসঙ্গে উদ্ধার হয়েছে DRDO-র বেশ কিছু নথিও। উদ্ধার হয়েছে সেনার নথিও। তাতেও বাড়ছে রহস্য। যে এলাকায় তাঁদের বাড়ি সেখানে মূলত আদিবাসীদের বসতি। শান্ত এলাকা। গত মঙ্গলবার নকশালবাড়ি ব্লকের বেলগাছি চা-বাগানের সেই শান্ত এলাকাই হয়ে ওঠে অশান্ত। আচমকা, তৃণমূলের নকশালবাড়ির পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ অমৃতা এক্কার বাড়িতে হানা দেয় সেনার গোয়েন্দা বিভাগ। সঙ্গে ছিল রাজ্য পুলিশ ও NDRF টিম। কিন্তু একজন তৃণমূল নেতার বাড়িতে কী করে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পৌঁছে গেল? এই প্রশ্নই বারবার ঘুরছে রাজনৈতিক মহল থেকে নাগরিক মহলে। ধৃতকে নিজেদের হেফাজতে পেয়ে সেই উত্তরই জানার চেষ্টায় গোয়েন্দারা।
আদৌও ক্যালিফোর্নিয়াম তো?
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের অগস্টে দমদম বিমানবন্দরের বাইরে দুই ব্যক্তির কাছ থেকে রহস্যজনক কিছু পাথর পাওয়া যায়। বাজেয়াপ্ত করে সিআইডি। তদন্ত মাথাচাড়া দিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়াম জল্পনা। উদ্ধার হওয়া পাথরের ওজন ছিল প্রায় আড়াইশো গ্রাম। ক্যালিফোর্নিয়াম হলে যার দাম হতে পারতো প্রায় ৪ হাজার কোটির কাছাকাছি। খবর চাউর হতেই তা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় সব মহলেই। ধৃতরা যদিও সেগুলিকে ক্যালিফোর্নিয়াম বলে দাবি করলেও পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা যায় সেগুলি আদপে সাধারণ পাথর। বিশুদ্ধ ক্যালিফোর্নিয়াম প্রকৃতিতে নেই, থাকতে পারেও না। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া ধাতু ক্যালিফোর্নিয়াম নাকি অন্য কিছু তা নিয়ে বাড়ছে জল্পনা। তাহলে কী সাধারণ ধাতুকে ক্যালিফোর্নিয়াম বলে চালিয়ে উপার্জনের নতুন পন্থা অবলম্বন করছিলেন ওই তৃণমূল নেতা? সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। উত্তর যদিও মিলবে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই।