In Depth Story on Fake Medicine: নোটের বান্ডিলে রোজ লেখা হচ্ছে মৃত্যু! ওষুধের নামে আদতে বিষ খাচ্ছেন না তো?
Fake Cancer Drugs: ভারতে ওষুধের বাজার প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকার। আশঙ্কা, বাজার-চলতি ওষুধের ১০-১৫ শতাংশই জাল।প্রতিদিন কোনও না কোনও রোগীর পেটে ঢুকছে সেগুলো। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটা? জাল ওষুধ কি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, তা আন্দাজও করা যায় না।
বাড়িতে বাড়িতে আজকাল রোগজ্বালা লেগেই রয়েছে। সময় যত এগোচ্ছে, রোগের বহরও বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই প্রতি মাসে কিছু না কিছু ওষুধ কিনতেই হয়। এমন মানুষও আছেন, যাঁদের বেঁচে থাকাটা অনেকটাই নির্ভর করে ওষুধের উপর। কিন্তু তারা কি সত্যি ওষুধ খাচ্ছেন? ভাবুন তো, এই জীবনদায়ী ওষুধগুলিই যদি নকল হয়, তাহলে তার প্রভাব কতটা মারাত্মক হতে পারে। অহেতুক ভয় দেখানো নয়, এর নেপথ্যে রয়েছে বড় চক্র, যার পর্দাফাঁস হয়েছে বছর শেষে। খাস কলকাতায় জাল ওষুধের কারবার। কীভাবে বাজারে ছড়াচ্ছে এই ভেজাল ওষুধ? টার্গেট করা হচ্ছে কাদের?
কথায় বলে, রোগ ঘোড়ায় চড়ে আসে, আর ফিরে যায় হেঁটে হেঁটে। একদম খাঁটি কথা। রোগ ধরলে যেন ছাড়তে চায় না। তখন ওষুধ গেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। এই ওষুধ নিয়ে চিকিত্সা বিজ্ঞানে একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে। বলা হয় – সব ওষুধই বিষ। কথাটা যেন আজকাল আর প্রবাদ নয়, বাস্তব মনে হচ্ছে! কারণ সত্যিই ওষুধের নামে বিকোচ্ছে বিষ। আর শুধু তো কলকাতা নয়, সারা দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে জাল ওষুধের চক্র।
কেঁচো খুড়তে কেউটে-
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। ১৭ ডিসেম্বর ভবানীপুরের লেক রোডে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজ়েশন (CDSCO) এবং পশ্চিমবঙ্গের ড্রাগস কন্ট্রোল ডিরেক্টরেট।। বাড়ির ভিতর থেকে উদ্ধার হল থরে থরে ওষুধ। একতলার গোডাউন জুড়ে পেটি পেটি ওষুধ। যে সে ওষুধ নয়। ক্যানসার, ডায়াবেটিসের মতো জীবনদায়ী ওষুধ। কিন্তু সবই জাল! খবর প্রকাশ্যে আসতেই শোরগোল। গ্রেফতার করা হল সংস্থার মালিক অরুন্ধতী রায় চৌধুরীকে। উদ্ধার হওয়া ওষুধের কোনও বৈধ কাগজ দেখাতে পারেননি তিনি। এরপরই হল আসল পর্দাফাঁস।
‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ওষুধ-
তদন্তে নেমে দেখা যায়, এই জাল ওষুধের কারবার শুধু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ছড়িয়ে নেই। বিস্তার হয়েছে আরও অনেক দূর। এবং সবকিছু হিসাবে কষেই জালিয়াতি চলছে। উদ্ধার হওয়া নকল ওষুধের মধ্যে বেশ কিছু ওষুধেই লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এছাড়াও আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, আমেরিকার বিভিন্ন ওষুধের লেবেল উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। উদ্ধার হয়েছে ওষুধ প্রস্তুত করার সামগ্রীও। জানা গিয়েছে, বাজেয়াপ্ত করা ওষুধের আনুমানিক মূল্য প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে এমন ওষুধও রয়েছে, যা ভারতে বিক্রির অনুমোদনই নেই!
জানা যায়, মূলত অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে ওষুধগুলি বিক্রি করা হত। বাংলা-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যেত নকল ও অনুমোদনহীন ওষুধ। নিশানা হতেন গরিব-অসহায় ক্যানসার রোগীরা, যাদের পক্ষে দামি ওষুধ কেনা অসম্ভব বা চিকিৎসার খরচ সাধ্যের বাইরে।
কীভাবে ঠকানো হয় সাধারণ মানুষকে?
চিকিৎসক, মেডিসিন ডিস্ট্রিবিউটর, কেমিস্ট-ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের বক্তব্যে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গিয়েছে, এমন অনেক বিদেশি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা রয়েছে, যাদের ভারতে ওষুধ বিক্রির অনুমোদন নেই। ওষুধ বিক্রি জন্য লাগে আমেরিকার ফুডস অ্যান্ড ড্রাগ রেগুলেশনের (FDA)-র অনুমোদন। তবে এই অনুমোদন পাওয়া সহজ নয়। এর জন্য বহু নিয়ম-কানুন মানতে হয়, যা বেশ সময়সাপেক্ষও। ওষুধ তৈরির এক একটি প্লান্টে ২৭ দিন ধরে পরিদর্শন হয়।
খরচ ও সময় বাঁচাতে জাল ওষুধের কারবারিরা বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভুটানের মতো দেশ দিয়ে ভারতে ওষুধগুলি আনে। কারণ, এই দেশগুলি পেটেন্ট আইনের আওতার বাইরে। তাই এই দেশগুলিতে কাঁচামাল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই তৈরি হয় ওষুধ, এমনটাই সূত্রের খবর। নকল ওষুধ তৈরির পরই পালা টার্গেট বাছাইয়ের।
হাসপাতাল-ক্লিনিকেই ওৎ পেতে থাকে ওরা-
দরিদ্র রোগী চিহ্নিত করার জন্য রাখা হয় এজেন্ট। বিভিন্ন ক্লিনিক, সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে এই এজেন্টরা থাকে। তীক্ষ্ণ নজরে দেখে সবকিছু। তারপর তাদের মাধ্যমেই গরিব ও অসহায় রোগী পরিবারকে বাছাই করা হয়।তাদের বলা হয় এই সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে। টাকা দিলে কুরিয়ারের মাধ্যমে সোজা বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে যায়। দরিদ্র রোগীদের চিকিত্সার স্বার্থে এই ওষুধগুলিরই নাম প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছেন অনেক ডাক্তার।
বর্তমানে ওষুধের দোকানে যাওয়ার বদলে অনলাইনে বাড়িতে ওষুধ আনানোর চল হয়েছে। সেই অভ্যাস ক্রমেই বাড়ছে। অভিযোগ, অনলাইন ফার্মেসিগুলি আসার পর জাল ওষুধ কারবারিদের পোয়াবারো হয়েছে। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে চুক্তি করছে ওষুধের সংস্থাগুলি। সেই অ্যাপের মাধ্যমেই দেদার চলছে জাল ওষুধ বিক্রি।তবে শুধু অনলাইন অ্যাপ নয়। হোলসেলার মার্কেটেও ছড়িয়ে আছে এই ভেজাল ওষুধ।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কত কমে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে, নজরে রাখে কিছু ট্রেড হোলসেলার। কম দামে সেই ওষুধ মজুত করে নেন এই হোলসেলাররা। ওষুধ মজুত করে দীর্ঘদিন রেখে দিলে, অনেক সময়ই মেয়াদ উত্তীর্ণও হয়ে যায় সেক্ষেত্রে লেবেল বদলে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বাজারে। পটনা, আগ্রা, মুম্বই, পঞ্জাব, এমনকী কলকাতাতেও রয়েছে এই জাল লেবেল তৈরির হাব!
উদ্বেগে চিকিৎসকরা-
ভারতে ওষুধের বাজার প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকার। আশঙ্কা, বাজার-চলতি ওষুধের ১০-১৫ শতাংশই জাল।প্রতিদিন কোনও না কোনও রোগীর পেটে ঢুকছে সেগুলো। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতটা? জাল ওষুধ কি প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে, তা আন্দাজও করা যায় না। ওষুধের এই জাল কারবার দেখে চিন্তিত আমজনতা। ওষুধ তো লাগবেই, ঠিক ভুল যাচাই করবেন কী করে? এই বিষয়ে চিন্তিত চিকিত্সক মহলও। এই বিষয়ে ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিত্সক জয়দীপ ঘোষ বলেন, “এটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। লাইসেন্স বিহীন প্রোডাক্ট মার্কেটে আসছে। ফলে ক্যানসার এগিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর পথে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাইড এফেক্ট কী হতে পারে, সে সম্পর্কেও কোনও ধারণা থাকছে না। ওষুধ আনার একটা প্রক্রিয়া আছে। সেটা ঠিক থাকছে কি না। জিরো টলারেন্স অ্যাপ্রোচ নিয়ে বন্ধ করা উচিত।”
কীভাবে এই জাল ওষুধ চিনবেন?
আসল-নকল ওষুধ চেনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা সহজ কয়েকটি পদ্ধতি বাতলেছেন, যার মাধ্যমে সহজেই যাচাই করা সম্ভব। কী এগুলো-
- ট্যাবলেট, বড়ি বা ক্যাপসুলের মতো ওষুধের ক্ষেত্রে সেটির কোথাও কোনও অংশ ভাঙা রয়েছে কিনা, তা ভাল করে দেখে নিতে হবে।
- ওষুধের মোড়কের আকার-আকৃতি বা তার রং-বানান ইত্যাদি সব ভাল করে দেখে নিতে হবে।
- সিরাপ-টনিকের মতো বোতলজাত ওষুধের ক্ষেত্রে বোতলের প্যাকেজিং বা সিল ঠিক আছে কিনা, তা ভাল করে দেখে নিতে হবে।
জাল ওষুধ চেনার জন্য একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকারও। এর মাধ্যমে আসল এবং নকল ওষুধগুলি সহজেই শনাক্ত করা যায়। এটি হল ইউনিক অথেন্টিকেশন কোড। যে কোনও ওষুধের মোড়কের গায়ে তার ইউনিক অথেন্টিকেশন কোড লেখা থাকে। ওষুধ কেনার পর সেটির সম্পর্কে মনে কোনও রকম সন্দেহ দানা বাঁধলে, সেই কোড ৯৯০১০৯৯০১০ নম্বরে এসএমএস করতে হবে। ওই ওষুধটি যেখানে তৈরি, সেখান থেকে একটি অথেনটিকেশন মেসেজ পাওয়া যাবে। তাহলেই বোঝা যাবে কেনা ওষুধ আসল নাকি নকল।
ড্রাগস বিধি মেনে অভিযুক্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। উত্পাদন বন্ধের পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিলও করা হয়। কিন্তু তারপরও এই প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। দিনের শেষে এর ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।