‘অমর্ত্য সেন নোবেল লরিয়েট নন’, বিশ্বভারতীর উপাচার্যের এই বক্তব্য নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। যাঁকে ‘নোবেলজয়ী’ বলেই এতদিন বাঙালি চিনে এসেছে, তিনি আদৌ নোবেলই পাননি! এমন একটি বক্তব্য পেশ করার পিছনে যথেষ্ট যুক্তিও দিয়েছেন উপাচার্য। কেউ কেউ বলছেন, উপাচার্যের যুক্তি সঠিক। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অর্থনীতির ‘নোবেল’ কি ‘নোবেল’ নয়?
‘দ্য সোয়েরিয়েজ রিক্সব্যাঙ্ক প্রাইজ ইন ইকনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’ (The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel)।
তবে নাম বদলেছে বারবার। প্রথমে এই পুরস্কারের নাম ছিল, ‘প্রাইজ ইন ইকনমিক সায়েন্স ডেডিকেটেড টু দ্য মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’। কখনও নাম বদলে হয়েছে, ‘প্রাইজ ইন ইকনমিক সায়েন্স’। অমর্ত্য সেন যে সময়ে নোবেল পেয়েছিলেন সেই সময় নাম ছিল ‘ব্যাঙ্ক অব সুইডেন প্রাইজ ইন ইকনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’। আবার আর এক বাঙালি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পুরস্কার পান তখন নাম বদলে গিয়েছে। বর্তমান নামেই পুরস্কার পান তিনি।
এই ‘সোয়েরিয়েজ রিক্সব্যাঙ্ক’ হল সুইডেনের সবথেকে পুরনো সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। আরও ভাল করে বলতে গেলে, এটি বিশ্বের সবথেকে পুরনো সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। ওই ব্যাঙ্কের বয়স যখন ৩০০ বছর পূর্ণ হল, তখন তারা ঠিক করে অর্থনীতিতে গবেষণার জন্য কোনও যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়া হবে। নোবেল কমিটির সঙ্গে সে ব্যাপারে কথা বলার পর ১৯৬৯ থেকে প্রথম এই পুরস্কার চালু হয়। এই পুরস্কার কে পাবেন? তা বেছে নেওয়ার দায়িত্বে থাকে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস।
আলফ্রেড নোবেল, যিনি নোবেল পুরস্কার চালু করেন, তাঁর দলিলে ‘অর্থনীতি’র কথা লেখা ছিল না। তিনি মোট ৫ টি ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মেডিসিন, সাহিত্য ও শান্তি। সেই অর্থে ‘অর্থনীতি’র নোবেল আদতে তথাকথিত নোবেল নয় বলেই মত অনেকের।
* যে মঞ্চে ওই পাঁচ বিষয়ে (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মেডিসিন, সাহিত্য ও শান্তি) নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই একই মঞ্চ থেকেই অর্থনীতির ওই নোবেল সমতুল্য পুরস্কার দেওয়া হয়।
* যে যোগ্যতার বিচারে ওই পাঁচ বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রাপককে বেছে নেওয়া হয়, সেই একই যোগ্যতার মাপকাঠিই রাখা হয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও।
* নোবেল কমিটির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেই ঘোষণা হয় অর্থনীতির ‘নোবেল’ প্রাপকের নাম। অফিশিয়াল টুইটার পেজেও (@NobelPrize) থেকেও সেই পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা করা হয়।
* আসল নোবেল পুরস্কারের মতো একই অর্থমূল্য দেওয়া হয় অর্থনীতির ক্ষেত্রেও।
সুতরাং নোবেল পুরস্কার ও ‘মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’ পুরস্কারের মধ্যে যে সেই অর্থে কোনও তফাৎ যে করা হয় না, তা অনেকটাই স্পষ্ট।
নোবেল কমিটির ওয়েবসাইট www.nobelprize.org -এ বাকি পাঁচ বিষয়ের সঙ্গেই Economic Science বা অর্থনীতির জায়গা রয়েছে। তবে অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে Nobel Prize লেখা থাকলেও, অর্থনীতির ক্ষেত্রে লেখা রয়েছে পুরস্কারটি আসল নাম। রয়েছে পুরস্কারের আসল গল্পটাও।
কারও কারও মতে, অর্থনীতিতে যাঁরা নোবেল পান, তাঁদেরকে নোবেল ‘লরিয়েট’ বলা যায় না। প্রাচীন গ্রিসে লরেল পাতার মুকুট দিয়ে সম্মান প্রদানের রীতি ছিল। সেখান থেকেই এই ‘লরিয়েট’ শব্দটি উদ্ভুত। বিশেষ বা সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপকদের ‘লরিয়েট’ বলে অভিহিত করা হয়।
এ ক্ষেত্রে নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে ‘নোবেল লরিয়েটস’ বিভাগের মধ্যেই অর্থনীতির জায়গা রয়েছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্যাজেটে অর্থনীতির নোবেল প্রাপকদের ‘নোবেল লরিয়েট’ বলেই অভিহিত করা হয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন অমর্ত্য সেনও। শুধু অমর্ত্য সেনকে নয়, মার্কিন অর্থনীতিবিদ এরিক মাসকিনকেও সেখানে ‘নোবেল লরিয়েট’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
সাধারণত প্রতিটি নোবেল পুরস্কারেই আলফ্রেড নোবেলের ছবি খোদাই করা থাকে। অর্থনীতির নোবেলের ক্ষেত্রেও সেই ছবি থাকে, তবে চেহারায় কিছুটা আলাদা। মেডালের ওপরের দিকে আলফ্রেড নোবেলের ছবি থাকে, তবে সেই সঙ্গে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের একটি প্রতীকও খোদাই থাকে।
আলফ্রেড নোবেলের অন্যতম উত্তরসূরী পিটার নোবেল দাবি করেন, আলফ্রেড নোবেল নাকি চেয়েছিলেন যে গবেষণায় লাভের বিষয় জড়িয়ে থাকে সেই বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হবে না। সে কারণেই নাকি তিনি অর্থনীতি বাদ রেখেছিলেন। তাঁকে এমনটাও বলতে শোনা গিয়েছে যে, অর্থনীতিতে নোবেলের ক্ষেত্রে নাকি তাঁদের পরিবারের নামের অপব্যবহার করা হচ্ছে।
সুতরাং, অর্থনীতির নোবেল নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত আজ নয়। কখনও বদলেছে নাম, কখনও উঠেছে প্রশ্ন। তবে বিশিষ্টদের মতে, অর্থনীতির নোবেল প্রাপকদের মেধা বা পাণ্ডিত্য নিয়ে বোধ হয় প্রশ্ন তোলা যায় না।