মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (CM Mamata Banerjee) উত্তরবঙ্গ সফরের পরই ফের হুঁশিয়ারি দিয়ে অডিয়ো বার্তা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও)-র (KLO) প্রধান জীবন সিংহের। যদিও এই হুঁশিয়ারিকে আমল দিতে রাজি নয় নবান্ন (Nabanna)।
মায়ানমারের গোপন ডেরা থেকে পাঠানো অডিয়ো বার্তায় মালখানের সিংহের গ্রেফতারের বদলা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন কেএলও চেয়ারম্যান। শুধু তাই নয়, কেএলও-র সঙ্গে অসম এবং কেন্দ্রীয় সরকারের যে শান্তি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাও বিঘ্নিত হবে বলে দাবি করেন এই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। বৃহস্পতিবার মালখান সিংহ ওরফে মাধব মণ্ডলকে দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের গোয়েন্দারা।
মালদহের বামনগোলার বাসিন্দা মাধব কেএলও-র প্রথম দিকের নেতা। জীবনের দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা। অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটের সময় গ্রেফতার হন মালখান। পরবর্তীতে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মূল সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করে মূলস্রোতে ফিরেও আসেন তিনি।
কেএলও-র দাবি, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অসমের হিমন্ত বিশ্বশর্মা সরকারের উদ্যোগে কেএলও-কে আলোচনার টেবিলে আনার যে প্রক্রিয়া চলছে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মালখান। গুয়াহাটিতে সেই সংক্রান্ত বৈঠক সেরে ফিরে আসার পরই তাঁকে গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি শান্তি আলোচনার সঙ্গে যুক্ত কোচ-রাজবংশী পরিষদের নেতা বিশ্বজিত রায়ের।
যদিও রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের দাবি, মালখান গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কেএলও প্রধান-সহ একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। পাশাপাশি, পুরনো ক্যাডার যারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলা ও অসমের বিভিন্ন জায়গায় মূল স্রোতে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন তাঁদের ফের সংগঠিত করে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার উস্কানি দিচ্ছিলেন মালখান।
রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, গত এক বছরে মালদহ এবং দুই দিনাজপুর জেলা থেকে প্রায় ২০-২৫ জন যুবক-যুবতী কেএলও-তে যোগ দিয়েছে। তাঁদের মায়ানমার বা উত্তর পূর্ব ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্তও করেছেন মালখান। “এ রাজ্যে জীবন সিংহের মূল যোগাযোগের অস্ত্র ছিলেন মালখান। মালখানের গ্রেফতার অনেকটা বড় ধাক্কা জীবনের কাছে”, দাবি রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার।
নবান্ন সূত্রে খবর, শান্তি আলোচনা নিয়ে অসমের বিজেপি সরকারের সঙ্গে অনেকটাই কথা এগিয়েছে কেএলও-র। কিন্তু শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ পশ্চিমবঙ্গ এই আলোচনায় যোগ দিচ্ছে। কারণ কেএলও কেবল অসমের সমস্যা নয়। কেএলও-প্রভাবিত এলাকার বেশিটাই এ রাজ্যে। সূত্রের খবর কেএলও-র তরফ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল রাজ্য সরকারের সঙ্গে।
এমনকী কেএলও প্রধান সম্মানজনক শর্তে আত্মসমর্পন করে আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম ব্লকে নিজের পৈত্রিক বাড়িতেও ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কেএলও ঘনিষ্ঠ উত্তরবঙ্গের কোচ-রাজবংশী বিভিন্ন সংগঠনের অভিযোগ, জীবন সিংহের ‘সম্মানজনক’ শর্ত মানতে রাজি নয় নবান্ন। ফলে হিমন্ত-সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার কথা এগোলেও মমতার সরকারের সঙ্গে বৈরিতা গত কয়েক মাসে বেড়েছে।
গত ছ’মাসে জীবন একাধিকবার সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বহিরাগত’ বলে আক্রমণ করেছেন। তিনি বারবার উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেতাদের সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন। দু’দিন আগের একটি ভিডিয়ো বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দরাজ প্রশংসা করেছেন জীবন। নবান্ন সূত্রে খবর, জীবন এই ভাবে রাজ্য় সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু পাল্টা মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছে মমতার সরকারও।
কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীর কাছে বর্তমানে বিশ্বস্ত মুখ অনন্ত মহারাজকে উত্তরবঙ্গ সফরের সময় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা যায়। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা ইঙ্গিত দেন, মুখ্যমন্ত্রী অনন্ত মহারাজকে মঞ্চে রেখে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন কোচ-রাজবংশী জনগোষ্ঠীকে। অন্যদিকে এ রাজ্যে জীবনের ডানহাত মালখানকে গ্রেফতার করে দুর্বল করা হয়েছে জীবনকে। ফলে এখন পাল্টা চাপে জীবন।
রাজনীতির মারপ্যাঁচে কিছুটা হলেও যে জীবন বেকায়দায় তা স্পষ্ট তাঁর বয়ান থেকে। অনন্ত মহারাজকে নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে জীবনের বিবৃতি “মুখ্যমন্ত্রী নিমন্ত্রণ করেছিলেন অনন্ত মহারাজকে। এটার মধ্যে তো রাজনীতি নেই। একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন অনন্ত মহারাজ। এর মধ্যে ভুল কিছু নেই।” অর্থাৎ অনন্ত মহারাজকে বর্তমানে চটাতে নারাজ জীবন।
উত্তরবঙ্গ রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক আমলার কথায়, জীবনকে চাপ মুক্ত করতে পারে এখন অনন্ত। তাও অনন্তের বিরুদ্ধে গলা চড়াবেন না জীবন। আর সেখান থেকেই নবান্নের আশা, দ্রুত সরকারের শর্তেই আলোচনার টেবিলে আসবে কেএলও।