Stampede and lynching: ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন?

Stampede and lynching: ভিড়ের মাঝে পড়ে গিয়েছেন কেউ। তাঁকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন অন্যরা। আবার চোর সন্দেহে গাছে বেঁধে মারধর করা হচ্ছে কাউকে। বারবার ঘটছে এমন ঘটনা। গণপিটুনি ও পদপিষ্টের মতো ঘটনার সময় মানুষের মনে কী চলে? পদপিষ্টদের আর্তনাদ কি কারও কানে পৌঁছয়? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন।

Stampede and lynching: ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন?
পদপিষ্টদের আর্তনাদ কি পৌঁছয় কারও কানে?
Follow Us:
| Updated on: Jul 13, 2024 | 7:21 PM

কলকাতা: ভিড়টা ক্রমশ বাড়ছিল। একসময় শ্বাস নিতেও কষ্ট হতে থাকে। গরমে অস্বস্তি বাড়তে থাকে। তবুও সেই ভিড়ে মিশে থাকার আনন্দ। ‘বাবা’-র দর্শন লাভের আনন্দ। তাঁর পদধূলি মাথায় ঠেকানোর আনন্দ। সেখানে কীসের অস্বস্তি। অপরিচিতরাও যেন ভিড়ের মধ্যে আপনজন মনে হয়। সবাই তো এসেছেন ‘বাবা’-র দর্শনে। সবাই তো তাই আপনজন। কিন্তু, তাল কাটল কয়েক মুহূর্ত পর। হুড়োহুড়িতে যখন একের পর এক শিশু-নারী মাটিতে পড়ে গেলেন। আর নির্বিকারে তাঁদের মাড়িয়ে চলে যাচ্ছেন অন্যরা। মাটিতে ‘পিষে’ যাওয়ার আগে কেউ ভাবছেন, আপনজন হয়ে হাত বাড়িয়ে দেবেন কেউ। সেই হাত সত্যিই কি এগিয়ে আসে? পদপিষ্টের সময় কান্নার রোল, আর্তনাদ কি পৌঁছয় কারও কানে? কাউকে মাড়িয়ে যাওয়ার সময় পা কি দুরুদুরু করে কাঁপে? সেই ভিড়ের মাঝে কেমন অবস্থা হয় ‘আপনজনদের’? উত্তর প্রদেশের হাথরসে পদপিষ্ট হয়ে ১২১ জনের মৃত্যুর পর এমন নানা প্রশ্ন উঠছে। তবে শুধু হাথরস নয়। ভারতে পদপিষ্টের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটে? কী বলছেন মনস্তত্ত্ববিদরা?

ভারতে পদপিষ্টের ঘটনা নিয়ে যেমন শোরগোল পড়েছে, তেমনি গণপিটুনির ঘটনার বাড়বাড়ন্ত নিয়ে চিন্তিত প্রশাসন। চোর সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে কাউকে ধরে মারধর করছে একদল লোক। পশ্চিমবঙ্গে বিগত কিছুদিনে একাধিক গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসনের তরফে কড়া বার্তা দেওয়ার পরও গণপিটুনির খবর পাওয়া যাচ্ছে। কাউকে এভাবে দলবেঁধে মারার পিছনে কী মনস্তত্ত্ব কাজ করে? একজন অপরিচিতকে এভাবে নৃশংসভাবে মারতে কি কেঁপে ওঠে না হাত?

ভারতে পদপিষ্টের কয়েকটি ঘটনা-

১৯৫৪ সাল। স্বাধীনতার পর দেশে প্রথম কুম্ভমেলা। উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে সেই মহাকুম্ভ মেলায় জনসমুদ্র দেখা গিয়েছিল। ৪০ দিনের উৎসবে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ ভিড় করেছিলেন। রাজনীতিকদেরও ঢল নেমেছিল মহাকুম্ভ মেলায়। ৩ ফেব্রুয়ারি মৌনী অমাবস্যার দিন ঘটেছিল দুর্ঘটনা। মৌনী অমাবস্যায় স্নানের জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল। সাধু ও বিভিন্ন আখড়ার শোভাযাত্রার জন্য আলাদা ব্যারিকেড করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ভিড়ের চাপে রাস্তার সেই ব্যারিকেড ভেঙে পড়ে। হুড়োহুড়ি শুরু হয়। সেই পদপিষ্টের ঘটনায় বহু মানুষের মৃত্যু হয়। কারও মতে, সেই সংখ্যা ৮০০-র বেশি। আবার কোনও তথ্য বলছে, সেই সংখ্যা ৫০০-র বেশি।

১৯৯৪ সালের ২৩ নভেম্বর। মহারাষ্ট্রের নাগপুরে গোওয়াড়ি সম্প্রদায়ের একটি বিক্ষোভে ৫০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। তাতেই পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। মৃত্যু হয় ১১৪ জনের।

২০০৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার ওয়াই টাউনে মন্ধের দেবীর মন্দিরে সংকীর্ণ পথে ওঠার সময় হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছিল। আর তারই মাঝে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ২৬৫ জন পুণ্যার্থীর।

২০০৮ সালের ৩ অগস্ট। হিমাচল প্রদেশের বিলাসপুরে নয়না দেবী মন্দিরের পাহাড়ি পথে উঠছিলেন পুণ্যার্থীরা। সেইসময় ধস নেমেছে বলে গুজব ছড়ায়। তার জেরেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়। পদপিষ্ট হয়ে ১৪৫ জন মারা যান।

২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর। মধ্য প্রদেশের রত্নাগড় মন্দিরে নবরাত্রি উদযাপনের জন্য দেড় লাখের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। ব্রিজে দাঁড়িয়েছিলেন অনেকে। আচমকা রটে যায়, ব্রিজ ভেঙে পড়তে পারে। হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আর তাতেই পদপিষ্ট হয়ে ১১৫ জনের মৃত্যু হয়।

২০২৪ সালের ২ জুলাই। উত্তর প্রদেশের হাথরসের রতিভানপুর। ভোলে বাবার সৎসঙ্গে উপস্থিত হয়েছিলেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। সৎসঙ্গ শেষ হওয়ার পর হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তাতেই পদপিষ্ট হয়ে ১২১ জনের মৃত্যু হয়।

.

বাংলায় একের পর এক গণপিটুনিতে মৃত্যু-

কোথাও ছেলেধরা সন্দেহে মারধর। কোথাও মোবাইল চোর সন্দেহে গণপিটুনি। সম্প্রতি বাংলায় একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের।

২০২৪ সালের ২৭ জুন। হুগলির পাণ্ডুয়ায় সামান্য বচসা থেকে এক যুবককে রাস্তায় ফেলে মার। এলাকায় মনসাপুজো উপলক্ষে লাউডস্পিকার বাজছিল জোরে। রাস্তা পার হতে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় ওই যুবকের। তারই জেরে রাস্তায় ফেলে বেদম প্রহার করা হয় তাঁকে। পরে ওই যুবকের মৃত্যু হয়।

২০২৪ সালের ২৮ জুন। কলকাতার বউবাজারে মোবাইল চোর সন্দেহে এক যুবককে ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে গণপিটুনি। হাতপা বেঁধে বেধড়ক মারধর করা হয় ওই যুবককে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গেলেও ওই যুবককে বাঁচানো যায়নি।

২০২৪ সালের ১ জুলাই। তারকেশ্বরে গাড়ি চুরির অপবাদ দিয়ে এক যুবককে বেধড়ক মারধর। তারকেশ্বর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

২০২৪ সালের ৭ জুলাই। ভাঙড়ে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে বেঁধে মারধর করা হয়। মারধরের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই ব্যক্তি। সেই অবস্থান দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিলেন। পরে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

.

গণপিটুনির সময় মানুষের মাথায় কী চলে-

মনস্তত্ত্ববিদ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “কোনও ব্যক্তি যখন কোনও সমষ্টিতে থাকেন, তখন তাঁর ব্যবহার বদলে যেতে পারে। একে বাই-স্ট্যান্ডার্ড এফেক্ট বলে। একা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোনও অসুস্থকে পড়ে থাকতে দেখলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় আসে। কিন্তু, অনেকের মধ্যে থাকলে ডি-ইন্ডিভিজুয়েশন হয়। অর্থাৎ একা থাকলে যে কাজ করার প্রবৃত্তি হয়, সেটা ভিড়ের মধ্যে হয় না। ভিড়ে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, তাঁদের মতোই চলে বাকিরা।”

গণপিটুনির কারণ নিয়ে তিনি বলেন, “গণপিটুনির ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে তিন ধরনের অ্যাপ্রোচ দেখা যায়। প্রথমত, ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ। যা হচ্ছে তাতে নজর না দেওয়া। দ্বিতীয়ত, কৌতূহল ও মতামত দেওয়া। কী চলছে সেই বিষয়ে আগ্রহান্বিত হওয়া এবং নিজস্ব মতামত রাখা। আর তৃতীয়ত, অ্যাগ্রেসিভ অ্যাপ্রোচ। এখানে মানুষের মনে হয়, চল সবাই মিলে মারধর করি। আবার আর্থিক অনটন, পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত সমস্যা মানুষের আন-কনসাস ডমেনে থাকে। যখন গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটে, সেইসময় মানুষের রাগ, ক্ষোভ বেরিয়ে আসে।”

পদপিষ্টের মতো ঘটনার সময় মানুষের মনে কী চলে-

মনস্তত্ত্ববিদ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “পদপিষ্টের ঘটনায় মানুষের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা কাজ করে। ভয়, আতঙ্ক- এমন নানা অনুভূতির জন্ম হয় অ্যামিগডালায়। অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বেড়ে যায়। এই অ্যামিগডালার জন্য মানুষ নিজেকে বাঁচাতে দৌড়ে পালায়। মেয়েদের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা বেশি সক্রিয়। কারণ, তাঁরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়। সেজন্য দেখবেন ভিড়ে আতঙ্ক ছড়ালে মেয়েরা বেশি হুড়োহুড়ি করেন। মানুষের মধ্যে মৃত্যুভয় চলে এলে নিজেকে বাঁচাতে মানুষ পলায়ন করেন। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ান। তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।” মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্যও গণপিটুনি ও পদপিষ্টের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

পদপিষ্টের মতো পরিস্থিতি হলে কী করবেন-

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পদপিষ্টের মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে আতঙ্কিত হবেন না। আসলে পিছনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা অনেকসময় বুঝতে পারেন না, সামনে যাঁকে ঠেলছেন, তাঁর এগিয়ে যাওয়ার জায়গা রয়েছে কি না। তা থেকে অনেকসময় পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। হুড়োহুড়ি করে এদিক-ওদিক দৌড়তে নিষেধ করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে ভিড়ের মধ্যে পিছন থেকে চাপ আসলেও চুপ থাকেন। এতে পদপিষ্টের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। প্রথমেই চিৎকার করে না ঠেলার কথা বলা দরকার। অনেকে বলেন, ভিড়ের মধ্যে হাত দুটো বুকের সামনে রাখুন। এতে প্রচণ্ড ভিড়েও কিছুটা জায়গা পাবেন।

হাথরসে দুর্ঘটনার পরের ছবি

প্রশাসন বলছে, অতিরিক্ত ভিড়, বেরনোর জন্য অপর্যাপ্ত গেট। এসবের জন্যই নাকি হাথরসে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে। ‘ভোলে বাবা’-র সৎসঙ্গে যেখানে ৮০ হাজার লোকের জমায়েতের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে আড়াই লাখ মানুষ এসেছিলেন। কিন্তু, এসব যুক্তি কি বছর সাঁইত্রিশের রুবির পরিবারের কানে ঢুকছে? মর্গের সামনে রুবির দেহ নিয়ে বসেছিলেন পরিজনরা। কাঁদতে কাঁদতে একসময় চোখের জলও শুকিয়ে গিয়েছে তাঁদের। কালো ত্রিপলে ঢাকা মৃতদেহের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে বয়স্ক এক ব্যক্তি। একটা হাতের উপর অন্য হাতটা রাখা। ‘ভোলে বাবা’ নন। উনি রুবির জন্মদাতা বাবা। হয়তো ভাবছেন, মেয়েকে কেন পাঠিয়েছিলেন? কেনই বা সবাই হুড়োহুড়ি করছিল? কে দেবে তাঁকে মানুষের মনস্তত্ত্বের খবর। মেয়ের দেহ ভ্যানে চাপিয়ে রওনা দিলেন তিনি। দাহ করতে হবে যে…