কলকাতা: কোথাও চোর সন্দেহ। কোথাও ছেলেধরা সন্দেহ। কোথাও বা সামান্য বচসা। তার জেরেই গণপিটুনি। দল বেঁধে বেদম প্রহার। প্রাণ বাঁচাতে আর্তনাদ। কিন্তু, কোনও কিছুই দমাতে পারেনি একদল ‘উন্মত্ত’ মানুষকে। তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে গত কিছুদিনে কয়েক জনের প্রাণ গিয়েছে। গণপিটুনি রুখতে আসরে নেমেছে প্রশাসন। গণপিটুনিতে যুক্তদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারপরও গণপিটুনির ঘটনা সামনে আসছে। মঙ্গলবার হুগলির তারকেশ্বরে চোর সন্দেহে এক মহিলাকে গাছে বেঁধে হেনস্থা করা হয়। এদিন আবার ভাঙড়ে গণপিটুনির শিকার হন এক যুবক। এত প্রচার, কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারির পরও কেন এমন ঘটনা ঘটছে? গণপিটুনিতে কেন জড়িয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ? কী বলছে মনোবিজ্ঞান?
জুন মাসের শেষ সপ্তাহে হুগলির পাণ্ডুয়ায় গণপিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু ঘিরে শোরগোল পড়ে। রাস্তা পার হতে গিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে ওই যুবককে কয়েকজন মিলে বেদম প্রহার করে। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত যুবকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন তোলেন, সামান্য বচসার জেরে কীভাবে একটা মানুষকে খুন করে ফেলল কয়েকজন?
স্বামীহারা অন্তঃসত্ত্বা ওই যুবতীর প্রশ্নটাই রাখা হয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে। শুধু পাণ্ডুয়া নয়, জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কলকাতার বউবাজারে মোবাইল চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয়। ছাত্রদের বেদম প্রহারে মৃত্যু হয় তাঁর। একদল ছাত্র কীভাবে এমন নৃশংস কাজে যুক্ত হতে পারে?
কী বলছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “ক্রাউড সাইকোলজির অনেকগুলো ডাইমেনশন রয়েছে। তার মধ্যে একটা হল সোশ্যাল বা সামাজিক আঙ্গিক। দ্বিতীয়ত সাইকোলজিক্যাল বা মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিক। কোনও ব্যক্তি যদি কাউকে রাস্তায় জখম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন, তখন তাঁর মধ্যে সহমর্মিতা জন্মায়। কিন্তু, ভিড়ের মাঝে তাঁর নিজের ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলেন। যাকে ডি-ইন্ডিভিজুয়েশন বলে।”
বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “গণপিটুনির সময় মানুষের মধ্যে তিন ধরনের অ্যাপ্রোচ দেখা যায়। প্রথমত, ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচ। যা হচ্ছে তাতে নজর না দেওয়া। দ্বিতীয়ত, কৌতূহল ও মতামত দেওয়া। কী চলছে সেই বিষয়ে আগ্রহান্বিত হওয়া এবং নিজস্ব মতামত রাখা। আর তৃতীয়ত, অ্যাগ্রেসিভ অ্যাপ্রোচ। এখানে মানুষের মনে হয়, চল সবাই মিলে মারধর করি।”
মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নানা সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। কারও ছেলের চাকরি হচ্ছে না। কারও বাড়িতে অশান্তি। এইসব পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আমাদের অবচেতন মনে থাকে।”
বিশ্ববিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কথা উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “ফ্রয়েডের দুটি থিওরি রয়েছে। স্ট্রাকচারাল থিওরি ও টপোগ্রাফিক্যাল থিওরি। তার মধ্যে টপোগ্রাফিক্যাল থিওরি অব মাইন্ডে তিনি বলেছেন, আমাদের মনের তিনটি সত্তা থাকে। একটা কনসাস বা সচেতন মন, একটা আনকনসাস বা অচেতন মন আর তৃতীয়টা হল প্রি-কনসাস বা অবচেতন মন। গণপিটুনির সময় অবচেতন মনে আমাদের মধ্যে যে ক্ষোভ জমা থাকে, একসঙ্গে তা বিস্ফোরণ হয়ে বেরিয়ে আসে। আর স্ট্রাকচারাল থিওরিতে আমাদের তিনটে সত্তা থাকে। ইড(id), ইগো এবং সুপারইগো। এই তিনটে সত্তা একসঙ্গে মানুষের আচরণ নির্ধারণ করে। মানুষের ইচ্ছা, বাসনা পূরণের জন্য মনকে উদ্দীপ্ত করে ইড। ইগো সবসময় মানুষকে আগলে রাখে। সুপারইগো হচ্ছে মানুষের বিবেক। যে বোঝায় এটা করা ঠিক নয়। ইগো ও সুপারইগোর মধ্যে যে সন্ধিক্ষণ রয়েছে, সেটা বিচ্যুত হয়ে যায় ডি-ইন্ডিভিজুয়েশনে। তখন আমরা আত্মসংযম ধরে রাখতে পারি না।”
গণপিটুনিতে যুক্ত হওয়ার সময় আমাদের ব্রেন কীভাবে কাজ করে, তাও ব্যাখ্যা করলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রঞ্জন ভট্টাচার্য। বলেন, “আমাদের ব্রেনে রয়েছে তিন রকমের কর্টেক্স। আর্কিকর্টেক্স, পেলিওকর্টেক্স ও নিওকর্টেক্স। আর্কিকর্টেক্স হল ব্রেনের সবচেয়ে পুরনো কর্টেক্স। তারপর বিবর্তনের ফলে এসেছে পেলিওকর্টেক্স এবং শেষে নিওকর্টেক্স। নিওকর্টেক্স ব্রেনের সামনের অংশ। যা অন্যান্য প্রাণীর থেকে মানুষকে আলাদা করে রেখেছে। এই ফ্রন্টাল কর্টেক্স মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। মানে ক্লাসে মনিটরের মতো কাজ করে। এই ফ্রন্টাল কর্টেক্সে প্যাঁচালো জিলিপির মতো অংশ রয়েছে। পোশাকি নাম অ্যান্টেরিয়র সিঙ্গুলেট কর্টেক্স (ACC)। গাড়ির ব্রেকের মতো কাজ করে এসিসি। যে আমাদের বাঁধনহীন হতে দেয় না। আদিম রিপুগুলি আটকে রাখে। ক্রাউড সাইকোলজিতে এসিসি-র ইন্ডিভিজুয়েশন চলে যায়। তখন আমাদের ব্রেনের পিছন বা মাঝের দিকে থাকা অ্যামিগডালাকে উদ্দীপ্ত করে। যেটা সবসময় মার্সিডিজ গাড়ির ইঞ্জিনের মতো দৌড়াতে চায়। এসিসি বাঁধনহীন হয়ে যাওয়ায় অ্যামিগডালায় অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বেড়ে যায়। তখন আমরা নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। ভেড়ার পালের মতো আমরা একজনকে অনুসরণ করে চলি। তারই জন্য অবিমৃষ্যকারিতার মতো কাজ করি।”
কিছুটা ক্ষেদের সঙ্গেই মনোরোগ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “আমাদের মধ্যে মোশন(গতি) এসেছে, কিন্তু, ইমোশন(আবেগ) চলে গিয়েছে। গণপিটুনিতে যুক্ত থাকলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার একাধিক ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়। সেসব অনেকেই জানেন না। আর ফল না জেনেই অনেকেই গণপিটুনিতে জড়িয়ে পড়ছেন।”
সত্যিই কি আবেগ হারিয়ে গতি গ্রাস করেছে মানুষকে? এসিসি আমাদের বাঁধনহীন হতে দেয় না। সেই এসিসি-কে বাঁধনহীন না হতে দেওয়ার জন্য কী করতে হবে? এখনও কানে বাজছে কান্না জড়ানো গলায় পাণ্ডুয়ার অন্তঃসত্ত্বা যুবতীর সেই প্রশ্ন, সামান্য বচসার জেরে কীভাবে একটা মানুষকে খুন করে ফেলল কয়েকজন?