ফেসবুকের প্রোফাইল কালো করে ‘প্রতিবাদ’ কি এখন ট্রেন্ড?
প্রোফাইলের ছবিতে সাধারণত যত্নের ছাপ স্পষ্ট থাকে। কেউ আবার নিজেকে আড়ালে রাখতেও পছন্দ করেন।
ফেসবুক (Facebook) প্রোফাইলে কেমন ছবি রয়েছে আপনার? হাসিমুখের সেলফি, বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপফি, প্রিয়জনের ছবি, পোষ্যর সঙ্গে আপনি, আপনার ছাদের বাগান, আপনার অর্ধেক চোখ, পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে আপনাকে এমন কোনও ছবি…। আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্তীর্ণ বাজারে আপনার প্রোফাইলের ছবি দেখেই তো প্রাথমিক ভাবে আপনাকে চেনা ‘হয়’। তাই প্রোফাইলের ছবিতে সাধারণত যত্নের ছাপ স্পষ্ট থাকে। কেউ আবার নিজেকে আড়ালে রাখতেও পছন্দ করেন।
এই আবহে কখনও বা প্রোফাইলের ছবির জায়গাটা কালো বা অন্ধকারও থাকে অনেকের। সচেতন ভাবেই অন্ধকার। কেন ফেসবুকের প্রোফাইলে ছবি না লাগিয়ে অন্ধকার রাখেন অনেকে? খুব সহজ উত্তর। কয়েক বছর ধরে এই ট্রেন্ড বেশ জনপ্রিয়। দেশজুড়ে পার্কস্ট্রিট, কামদুনি বা হাথরস- যখনই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণের পর খুন গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে হোয়াটস্অ্যাপে, তখনই সোশ্যাল মিডিয়ার একটা বড় অংশ প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে প্রোফাইল পিকচার কালো রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সচেতন ভাবেই। যাঁরা পথে নেমে প্রতিবাদে সামিল হতে পারেননি, তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন সোশ্যাল ওয়ালে প্রোফাইল পিকচার ব্ল্যাক করার মাধ্যমে। যার প্রতিফলন ঘটেছে প্রোফাইল পিকচারের অন্ধকার হয়ে যাওয়ায়।
আরও পড়ুন, মিথিলা এবার ‘রাজনীতিবিদ’, কিন্তু কোথায়?
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও রয়েছে। এখন প্রোফাইলের ছবি কালো করে দেওয়ার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে রাজি নন অনেকেই। কারণ হিসেবে কেউ বলছেন, অনেক হল ভার্চুয়াল প্রতিবাদ। এতে কোনও দিন কোনও লাভ হয়নি, হবেও না। আবার কারও মনে হচ্ছে, যদি এভাবেই প্রতিবাদ করতে হয়, তাহলে তাতে শুধু মেয়েরা কেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা ছেলেরাও সামিল হোন। কারণ সকল পুরুষই তো ধর্ষক নন। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এ হেন প্রতিবাদে সামিল পুরুষও। কিন্তু সোশ্যাল ওয়ালে তাঁদের সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা।
অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ প্রোফাইলের ছবি কালো করলেও এখন এই ট্রেন্ডে আর গা ভাসাতে রাজি নন পেশায় দন্ত চিকিৎসক শুভশ্রী ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “শুধু ধর্ষণের ঘটনা নয়। লকডাউনের সময় শ্রমিকরা যখন ট্রেনে কাটা পড়লেন, তখনও প্রোফাইলের ছবি কালো করেছিলাম। আসলে এই কালো করার অর্থ আমি শোকগ্রস্ত। অনেক মহিলা আবার মনে করেন, এভাবে পুরুষদের বোঝানো যেতে পারে, নারী বর্জিত সমাজ কেমন। কিন্তু পুরুষ আর ধর্ষক তো সমার্থক নয়।”
আরও পড়ুন, নেপথ্যের কারিগররা কি আড়ালেই থাকবেন? হেয়ার স্টাইলিস্টের মৃত্যুতে ফের উঠল প্রশ্ন
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, “ফেসবুক আসার পর থেকে আমরা লক্ষ্য করছি কিছু জিনিস খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে প্রতিবাদ। যার জন্য রাস্তায় নামতে হয় না। তা শুধুমাত্র প্রতীকীও হতে পারে। ধিক্কার জানানোর প্রয়োজন হলে আমরা ফেসবুক প্রোফাইল কালো করে দিই। যৌন হিংসার প্রতিবাদ স্বরূপ অনেকেই এই পথ নিচ্ছেন। যার জন্য খুব একটা তলিয়ে ভাবতে হয় না। চলতি হাওয়ায় গা ভাসানো যেতে পারে। তবে এটা প্রতিবাদ জানানোর একমাত্র উপায় তো নয়। প্রতিনিয়ত বাড়িতে এবং বাইরে মেয়েদের উপর যে অত্যাচার ঘটছে, তা মাথায় রাখলে কিছু সময়ের জন্য ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার কালো করলেও কিছু আসে যায় না। কারণ ধিক্কার বা নিন্দা শুধু একদিনের হতে পারে না। বরং এটা যাতে না হয়, সেটার চেষ্টা করা সারা জীবনের লড়াই।”
স্বাতীর চলতি হাওয়ায় গা ভাসানোর উপলব্ধি যে কতটা ঠিক তার প্রমাণ, গৃহবধূ পিয়ালি মুখোপাধ্যায়ের মতো ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বড় অংশ। পিয়ালির প্রোফাইল কেন কালো তা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেন তাঁরই বন্ধু তালিকায় থাকা জনৈক ব্যক্তি। পিয়ালির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “কারণ বলতে পারব না। সকলে প্রোফাইল কালো করছে, তাই আমিও করলাম।”
বেথুন কলেজের ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া সম্প্রীতি বসুর গলায় স্পষ্ট রাগ ধরা পড়ল। “যা চলছে চারদিকে প্রোফাইল পিকচার কালো করাটা কোনও প্রতিবাদ হতেই পারে না। কিচ্ছু হবে না এসব করে। আসলে যতক্ষণ না নিজের বা ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে অসভ্যতা, অত্যাচার হবে, ততদিন ওই গা বাঁচানোর খেলাটা খেলব আমরা”, বললেন তিনি।
আরও পড়ুন, অভিষেক বচ্চনের কোন কোন সিক্রেট শেয়ার করল ইনায়ৎ?
সমাজতত্ত্ববিদ তথা বাগবাজার উওমেন্স কলেজের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা পৌলমী চক্রবর্তী বিষয়টিকে অন্য আঙ্গিকে ব্যখ্যা করলেন। তিনি মনে করেন, “যে কোনও প্রতিবাদেই একদল বুঝে প্রতিবাদ করেন। আর একদল স্রোতে গা ভাসান। আর মহিলাদের উপর অত্যাচারের নিরিখে রাস্তায় নেমেও তো প্রতিবাদ হচ্ছে। সকলে কিন্তু সেই জায়গায় পৌঁছতে পারছেন না। তার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যাঁরা রাস্তায় নেমে মিছিল করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, তাঁদের মরাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সমাজের বড় অংশের মানুষ যদি ভার্চুয়াল প্রতিবাদের অঙ্গ হিসেবে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার কিছুক্ষণের জন্য কালো করেন, এতে আপত্তির কিছু নেই।”
সামনে অনেক পথ খোলা। আপনার আচরণ কেমন হবে, সে সিদ্ধান্ত আপনারই।