দীপঙ্কর ঘোষাল
নতুন তারকা কে? এই প্রশ্ন চার বছর অন্তত ঠিক ঘোরাফেরা করে মাথায়। বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে এ বারও আমরা বসব মেসি-রোনাল্ডো-নেইমারের পরবর্তী প্রজন্মের খোঁজে। বিশ্ব এমনই। তার পথচলার প্রথম দিন থেকেই জন্ম দিয়ে চলেছে একের পর নায়ক। অসংখ্য ঘটনা। আর একদল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেই সব নায়ক আর না-ভোলা ঘটনা তুলে আনল টিভি নাইন। পর্ব-১
ইতালির সর্বকালের সেরা ফুটবলার। বিশ্বের অন্যতম। পেলে, কিংবা অ্যালফ্রেড দে স্টেফানো এমনকি যোহান ক্রয়েফের চেয়েও…। যাঁরা তাঁকে খেলতে দেখেননি, এগুলো শুধুই গল্পকথা মনে হতে পারে। গলি থেকে রাজপথ। কলঙ্কের উঁচু পাহাড় টপকে সাফল্যের আকাশ ছোঁয়া। অথবা একটা ভুলতে চাওয়া শৈশব। গুইসিপে মিয়াজার জীবনে যদি ডুব দেন, সব পাবেন। ফুটবলে পা ছোঁয়ানো মানেই কথা বলানো। জড় বস্তুও নির্দেশ পালনে বাধ্য হত যেন। ক্লাব ফুটবলে সাফল্য, দেশের হয়ে? দু-দুটো বিশ্বকাপ জয়। প্রথম বার সেরা প্লেয়ার হিসেবে। পরের বার দেশের অধিনায়ক হিসেবে। একটা ফুটবলারের জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি থাকতে পারে, মিয়াজা সব অর্জন করেছেন। ফুটবলের সোনালী যুগের সেরা ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল ইতালির এই স্ট্রাইকারের জন্য। অনেক বিখ্যাত, দক্ষ গোলকিপার তাঁর সামনে পরাস্থ হয়েছেন। মিয়াজাকে আটকানোর মতো কেউ ছিলেন না? এক জনের কাছেই আটকেছিলেন মিয়াজা। রিকার্ডো জামোরা। স্প্যানিশ গোলকিপার। তাঁর বিরুদ্ধে একটি মাত্র গোল করেছিলেন গুইসিপে মিয়াজা। তাও আবার একটা প্রদর্শনী ম্যাচে। কিন্তু সরকারি ম্যাচে বারবার আটকেছেন। তাতে অবশ্য মিয়াজার শ্রেষ্ঠত্ব কমবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাবাকে হারান মিয়াজা। ছোট্ট মিয়াজার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মা ফল বিক্রি করতেন। ছেলে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে, অন্তত দুটো মুঠো খাবার জুটিয়ে নিতে পারবে, এমনটাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভাগ্য অন্য নকশা সাজিয়ে রেখেছিল। ছেলেবেলা থেকেই ফুটবলের সঙ্গে বন্ধুত্ব মিয়াজার। আজীবন থেকে গিয়েছে এই সম্পর্ক। কখনও ফুটবলে তাপ্পি মারতে হত, অনেক সময় জুতোয়। খালি পায়েও খেলতে হয়েছে। ফুটবল খেলার সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেনি। টেকনিক শেখানো যেতে পারে, কিন্তু প্রতিভা সহজাতই হয়। মিয়াজা ছিলেন সহজাত স্ট্রাইকার। অনেক তারকা ফুটবলারের ক্ষেত্রেও শোনা যায় বাঁ পায়ের প্লেয়ার কিংবা ডান পায়ের। ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলার মিয়াজার ছিল দুটোই সমান। গোল করা আসল। কোন পায়ে করলেন, হেডে করলেন কিনা, সে সব নিয়ে ভাবার সময়ই ছিল না মিয়াজার!
ফুটবলের মঞ্চে মিয়াজার প্রবেশ আচমকাই। রাস্তায় খেলছিলেন। নজরে পড়ে ইতালির অন্যতম সেরা ক্লাব ইন্টার মিলানের এক কর্তার। সিরি এ তে যখন অভিষেক হয়, উনিশও পেরোননি মিয়াজা। ২০ বছরেই ইতালি জাতীয় দলে সুযোগ। দেশের হয়ে ৫৩ ম্যাচে ৩৩ গোল। মাঠের বাইরে তাঁর জীবন বরাবর ‘বর্ণময়’। দিয়েগো মারাদোনাকে তখনও দেখেনি ফুটবল বিশ্ব। তা হলে কি বলা উচিত, মারাদোনা অনেকটা মিয়াজার মতো। কিন্তু মাঠের বাইরে যাই ঘটুক না কেন, মাঠে মনসংযোগ নষ্ট করা কার্যত অসম্ভব ছিল। এমনও হয়েছে, দল পেনাল্টি পেয়েছে। মিয়াজা শট নিতে প্রস্তুত। ইলাস্টিক ঢিলে হওয়ায় প্যান্ট খুলে গিয়েছে, তাতেও কোনও হেলদোল নেই, শট ঠিক নিয়েছেন মিয়াজা। একজন ফুটবলারের পরিচয় তাঁর খেলাতেই। ডিফেন্ডার, গোলকিপারদের ঘুম কেড়ে নেওয়া মিয়াজার জীবনে নানা মজার ঘটনাও রয়েছে। সেগুলো যে যার দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করবেন।
সেই মিয়াজাকে ঘিরে কেচ্ছাও কম ছিল না। আসলে কেচ্ছা ছাড়া মিয়াজাকে কল্পনাও করা যেত না। আচ্ছা ভাবুন তো, একজন প্লেয়ার সারা রাত নিষিদ্ধ পল্লিতে কাটিয়ে পরদিন প্রতিপক্ষের ডিফেন্স নিয়ে ছেলেখেলা করছেন, সহজেই গোল করছেন। গুইসিপে মিয়াজা ছিলেন এমনই। এমন ঘটনা অনেক বার হয়েছে। সারারাত জেগে থেকেও পরদিন মাঠে নেমে ঠিক গোল করেছেন। কখনও ম্যাচের আগে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ক্লাবের প্রতিনিধিরা তাঁকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। গিয়ে দেখছেন, ঘুমোচ্ছেন মিয়াজা। ম্যাচের হয়তো কিছুক্ষণ বাকি। সেই অবস্থাতেই তুলে আনা হয়েছে তাঁকে। পাঁচ মিনিটে প্রস্তুত হয়ে মাঠে নেমেছেন। তবু গোল করেছেন। এমন প্রতিভাবান ফুটবলার সে সময়ই পেয়ে গিয়েছিল নিজস্ব স্পনসর। সবচেয়ে বড় কথা দুটো বিশ্বকাপ (১৯৩৪, ১৯৩৮ ) জিতেছেন। আর কী অপ্রাপ্তি থাকতে পারে?
(চলবে)