শুধু ছৌ নয়, হারাচ্ছে বাংলার আদি লোকনৃত্য ‘গোমিরা’ও!

The Masked Dance: যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আদি লোকসংস্কৃতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ছৌনাচের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য মোটেও গোমিরা বা গোম্ভীরা নৃত্যকে টেনে আনা যায় না। কারণ ছৌ নাচের মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে রঙ ও তাণ্ডব নৃত্যের প্রাধান্য। ফলে গোমিরার নৃত্যের সঙ্গে ছৌনাচের তুলনা টানা হাস্যকর। গোমিরাতে রঙ ও তাণ্ডব নৃত্যের চল নেই। মায়াবী ও রঙবেরঙের এই মুখোশ পরে যে একটি অতিপ্রাচীন লোকনৃত্য এখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে, অধিকাংশই তা জানেন না।

শুধু ছৌ নয়, হারাচ্ছে বাংলার আদি লোকনৃত্য 'গোমিরা'ও!
Follow Us:
| Updated on: Jun 30, 2024 | 4:33 PM

কোথায় যাব, কোথায় যাওয়া যায়? নিমেষের মধ্যে বেড়ানোর ইচ্ছা বহুদিনের। একা। কোনও এক নির্জনে। নিরিবিলি নিরুপদ্রব এক জায়গায়। সুফলা বাংলার একরাশ আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছে এমন এক জায়গায়, যেখানে একটা গোটা দিন নিজের মতো করে কাটানোর স্বপ্ন রয়েছে। কর্পোরেট দুনিয়া থেকে এক ছুটে কোথাও যে শান্তির জায়গায় পালিয়ে যাব, তা প্রায় অসম্ভব। সেই সংসার, সন্তান, দিনের শেষে কী রান্না হবে, সকালে উঠে কী বাজার করা বাকি রয়েছে, বিকেলে টিউশন থেকে ছেলেকে কে নিয়ে আসবে, সব নিয়ে যেন একটা গোলকধাঁধার একগলা ঘোলা জলে ডুব দিয়ে বসে আছি। এই বেড়াজাল থেকে বের হতে হলে সচেষ্ট হওয়া খুব দরকার। কিন্তু নিজের জন্য সময়টা বের করা আজকের দিনে বেশ চ্যালেঞ্জিং। ঠাণ্ডা শিরশিরানিভাব এখনও আছে। গ্রামবাংলার পরিবেশও এখন বেশ মনোরম। হোমস্টে নিয়ে একটা-দুটো দিন কাটিয়ে আসার প্ল্যান রয়েছে। কিন্তু কাছেদূরে পালিয়ে যাওয়ার পথ বাতলে দিতে পারছেন না কেউ। সকালে গিয়ে আবার সন্ধ্যের পর বাড়ি চলে আসতে পারব, এমন জায়গা খুঁজে বের করাও হ্যাপা। চিড়িয়াখানা, দীঘা নয়, আবার কাছে কোনও সাজানো কৃত্রিম গ্রামে যেতেও অনীহা। এমন একটা গ্রাম, যেখানে রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, খাঁটি বাংলার ঐতিহ্য, লোকজনের ভিড় একেবারেই নেই, গ্রামবাংলার নিজস্ব স্বাদের খাবার, সারাদিন ঘুরে ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলা, ছবি তোলা, সবটাই নিজের মতো গুছিয়ে এক সুন্দর অভিজ্ঞতা অর্জনের অপেক্ষা বার বার টানছে। অনেকদিন পর নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পূরণের নেশায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় করছি শুধু।

অনেক কিছু খোঁজার পর একটা সুন্দর জায়গা পাওয়া গেল বটে। কিন্তু সেখানে যাওয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আকাশ-পাতাল হিসেবনিকেষ করতে করতে মাথায় এল সামনেই গাজন। চৈত্রমাস শেষ। বৈশাখের শুরু। মাঝের সময়টা গোটা বাংলা জুড়ে পালিত হয় গাজন-চড়কের মেলা। শহরে শুধু মেলাই বসে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে এখনও চড়ক, গাজনের ঐতিহ্য ও রীতি মেনে পুজো, মেলা দুটোই একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। সে এক এলাহি উত্‍সব। নস্টালজিকও। কিন্তু সেই তো ভিড়ভাট্টা, সেই কোলাহল। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতেই হদিশ পেলাম এমন একটা জায়গা, যেখানে বাইরের মানুষ কেন, বাংলার বহু মানুষই নাম শোনেননি। ঠিক হল কুশমান্ডি যাওয়া হবে। একা যাব। সঙ্গে থাকবে ক্যামেরা। জলের বোতল। শুকনো খাবার, আর একটা গায়ে দেওয়ার শাল। ব্যস, যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। গাজনের দিন কবে ক্যালেন্ডার দেখে বেরিয়ে দিন ঠিক করলাম।

মাথায় আর কোনও চিন্তা নেই। মালদা যাওয়ার ট্রেন ধরে বেরিয়ে পড়া তো গেল। কিন্তু ট্রেনে উঠে বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। সকালবেলা। যাচ্ছি একা। গ্রামে গিয়ে আদৌও কিছু দেখা যাবে তো! জানলার দিকে সিট পেয়ে মনটা বেশ খুশি হয়ে গেল দ্বিগুণ। ঝালমুড়ি আর লাল চা খেয়ে আপাতত চোখ গেল বাইরের দিকে। সাঁ সাঁ করে চোখের পলকে সরে যাচ্ছে এক একটি বাড়ি, বড় বড় আম-অশ্বত্থের গাছ, পুকুর, ডোবা, ক্রসিং লেভেল…। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখটা প্রায় টেনে ধরল। মাথা-শরীর এমন একটা শান্তির কোণে বাস করছে, ঘুমের দেশে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। মালদা স্টেশন থেকে নেমে মহিষাবাথান। সেখান থেকে কুশমাণ্ডি। একা। কোনও সমস্যা ছাড়াই। তবে কুশমাণ্ডিতে গিয়ে বেশ অবাক হলাম। শহর থেকে একা এসেছে কুশমাণ্ডিতে। তাও আবার গোমিরার খোঁজে। দোকান-বাজার থেকে লোকজন উঁকিঝুঁকি মেরে তাকাচ্ছে আমার দিকে। অস্বস্তিও লাগছে। কোথায় গেলে পাব সেই গোমিরাকে? রাস্তার ধারে একদল দস্যিদের ভিড়ে প্রশ্ন করতেই একটা ছোট্ট ছেলে হাত দেখিয়ে বলল, ওই দ্যাখ, একটা বট গাছ। তার পরের রাস্তা দিয়ে ভিতরে চলে যা। পেয়ে যাবি গোমিরার গ্রাম।

ছবি সৌজন্যে পিনটারেস্ট

গেলাম। সবাই ব্যস্ত নিজনিজ কাজে। সংসারের কাজে, রুটি রোজগারের কাজে, অল্পবিস্তর সকলেই দৌড়চ্ছেন। কাঁখে করে পিতলের কলসি করে জল আনছিলেন এক মহিলা। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করাতেই বলে উঠলেন, এখন কি গো, পুজো হোক তারপর তো নাচমে। এখন কুতাও গিয়ে বসে থাকোগে। ‘ বসে থাকব! কোথায়? আমি তো সটান চলে এসেছি। এবার কী হবে? কাউকে নিয়ে এলে বোধহয় ভাল হত। নিজের উপর এবার রাগ হতে শুরু করল। পেটের মাঝখানে গুলিয়ে উঠল। খেতে হবে। মাথা কাজ করছে না। ফিরে গেলাম বাজারে। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে গরম গরমভেলপুরি, সেদ্ধ ডিম, গজা অর্ডার দিলাম। বেঞ্চে বসতেই এক ছোকরা টাইপের ছেলে এসে বলল, কোথায় যাবেন? কারওর সঙ্গে দেখা করবেন নাকি? আমি হকচকিয়ে বলে উঠলাম, গোমিরা দেখব। কোথায় যাব বলুন তো? ভেবলে গিয়ে তাড়াতাড়ি প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলাম। দোকানে সেইসময় বেশ জনাকুড়ি লোক ছিল। সকলের চোখ এক নিমেষের মধ্যে যেন আমার দিকে ঘুরে গেল। গোমিরা দেখবেন তো এখানে বসে আছেন কেন? পালা-গান এতক্ষণে চালু হয়ে গিয়েছে দেখবেন। ওরা আপনার জন্য অপেক্ষা করবে নাকি। চলুন চলুন। নিয়ে যাচ্ছি। খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে একটা মাটির বাড়ির সামনে, ভিক্ষুকের বেশে দুই মহিলা বেসুরো গলায় তারস্বরে বলে উঠল, ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে মহাদেব…। বহুদিন পর এই সুর শুনে ছোট্টবেলাটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাবা তারকনাথের কাছে যারা মানত করতেন, তাদের একাংশ ভিক্ষা করে টাকা তুলে বাবার থানে জল ঢালতে যেতেন। এই সুর এতটাই আপন,এতটাই চেনা। মনটা চলকে উঠল। চাল-আলু ঝোলাতে নিয়ে হাসি মুখে আবার অন্য বাড়ির দিকে চলে গেল তারা। রাঙা মাটির উপর গেরুয়া বসনে, গেরুয়া রঙ করা সরা নিয়ে ভিক্ষে করা দুই মহিলার ছবি এখনও মনের মধ্যে ছাপ রেখে গিয়েছে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে গাঢ় সবুজ বট গাছ, সুদূর বিস্তৃত সারি সারি তাল-সুপারির গাছ, নীল আকাশের রঙে মিশে গিয়েছে হালকা গোলাপি একটা রেখা। রাঙা মাটিতে পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে কাঁকড়ের দলা পাকানো ছোট ছোট পাথর। হাঁটার পথেই খাল-বিল পেরিয়ে চোখের সামনে এগিয়ে আসছে অপূর্ব সুন্দর একটা গ্রাম। ধানক্ষেত, তালসারি, পুকুর দিয়ে ঘেরা প্রকৃতির চেনা গ্রাম।

ছবি সৌজন্যে পিনটারেস্ট

এতটা হাঁটার পথে কথা হল প্রচুর। দেখতে ছোকরা টাইপের, কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলে। ক্লাস ফাইভে উঠতেই সংসারের হাল ধরতে হাওড়ার একটি প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করে সে। গাজনের জন্য ছুটি নিয়েছে এক সপ্তাহ। গোটা গ্রামের শ্রেষ্ঠ পরব এটা। কতকটা ঈদ-ভাইফোঁটার মতো। বাবা ক্ষেতমজুরের কাজ করেন। নিজের একচিলতে জমি আছে। নতুন ধান কাটতে এই সময় বাবা-দাদার হাতে হাতে কাজ করে দেয়। গাজন বা চড়কের সময় গ্রামে একপ্রকার উত্‍সব চলে বটে, কিন্তু আর সেই যুগ নেই। কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার। একবছর আগে জ্বর-জ্বালায় মারা গিয়েছে মা। কোভিডের সময় সঠিক চিকিত্‍সা পাননি তিনি। মাকে বাঁচাতে পারেনি। সংসারে হালও সেদিন থেকে থমকে গিয়েছে। বাবা ক্ষেতমজুরি করলেও শরীর আর দেয় না। দাদা গান করেন। গোমিরার গানও বাঁধেন। নাচের রয়েছে আলাদা লোক।

ছবি সৌজন্যে পিনটারেস্ট

নাম মহাদেব। মাথায় হালকা সোনালি রঙ করা চুলের বাহার দেখে কেউ বলবে না, ওর গলায় এত সুন্দর সুর লকিয়ে রয়েছে। নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘ঠিক সময়ে এসেছেন। গোমিরা আমাদের প্রাণ। গোমিরা আমাদের রক্তে। চৈত্র সংক্রান্তি মানেই গাজন-চড়ক। কুশমান্ডি-কৃষ্ণবাটিতে গোমিরাই সেরা। এই দুদিন ধরে একটানা আমাদের পরব চলবে। থেকে যান। ভালো লাগবে। মালদায় সরকারি গেস্ট হাউস রয়েছে, থেকে যাবেন।’ বেলা বেশ গড়িয়ে যাচ্ছে। একটি কাঠের মূর্তি নিয়ে ধানক্ষেতের মাঝখানে গিয়ে স্থাপন করল একদল লোক। পরনে ধুতি, ফতুয়া, গামছা। মূর্তির চারিপাশে গোল করে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মনের আনন্দে নাচ করতে লাগলেন তাঁরা। কারওর মুখে কালীর মুখোশ। কারওর মুখে হিংস জানোয়ারের বিস্ফারিত চোখ আঁকা একটি মখোশ। কারওর মুখে আবার নীল রঙের মহাদেবের মুখোশ। প্রতিটি মুখোশের মধ্যে ব্যবহার করা হয়েছে অত্য়াধিক উজ্জ্বল রঙ। ছৌনাচ নয়। ছৌনাচের মতোও আবার। গান গেয়ে, মুখোশ পরে লাফিয়ে লাফিয়ে, যুদ্ধ করে, নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে নাচছেন একদল যুবক। দুপুরের এই পরবে সামিল হতেই সকাল থেকে ব্যস্ততা ছিল সকলের। গানের এককলি বোঝা না গেলেও গ্রামবাংলার নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রগুলি বেশ মনে ধরেছিল। শিব-পার্বতীর নানা কাহিনি, পৌরাণিক কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল সামাজিক নানা ঘটনা। উচ্চাঙ্গ একটানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজের মধ্য়ে গানের তালে তাল মিলিয়ে গোমিরার লোকনৃত্য পরিবেশিত হচ্ছে। এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা। সূর্য ঢলে পড়লেও তাদের সেই নৃত্যের মাদকতা থামার কোনও লক্ষণ নেই। ধূপ ধুনো দিয়ে পুজোর পর গোটা গ্রাম যেন এই পরবের অপেক্ষাতেই ছিল।

চোখের পলক ফেললেই হারিয়ে যাবে অনেককিছু। দিনাজপুরের কুশমাণ্ডি গ্রামে এখনও গোমারির লোকনৃত্য পরিবেশিত হয়। এক অদ্ভুত মুখোশ পরে পৌরাণিক কাহিনি গানের কলিতে রেখে নৃত্য পরিবেশিত হয়। বাংলার অতিপ্রাচীন এই নৃত্য ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ার পথে। মালদার গোম্ভীরার কথা অনেকেই জানেন। কুশমাণ্ডি বিখ্যাতই হয়েছে গোমিরার মুখোশ বানিয়ে। যে কোনও গাছের কাঠ দিয়ে মুখোশ বানানো হয় না। গামার গাছের কাঠ দিয়ে বানানো হয় গোমিরার মুখোশ। চৈত্র সংক্রান্তির শেষ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত এই লোকনৃত্য করা ও পরব পালন করার রীতি থাকলেও এখন মাত্র দুই থেকে তিনদিন ধরে পালিত হয়। তারপর যে যার কাজে চলে যান। কেউ ধান কাটার কাজে, কেউ আবার শহরে রোজগারের আশায় পাড়ি দেন। চাষের মাঠেই পুরোহিত ডেকে শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে নৃত্য করা হয়, তাই একে গোমিরা বলা হয়। আবার মুখা খেল-ও বলেন মহাদেবরা। গ্রামের বয়স্করাও সামিল হন এতে। মহিলারা থাকেন দর্শকাসনে। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাবে এইসব দৃশ্য দেখে।

ছবি সৌজন্যে পিনটারেস্ট

বুঝলাম, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই আদি লোকসংস্কৃতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ছৌনাচের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য মোটেও গোমিরা বা গোম্ভীরা নৃত্যকে টেনে আনা যায় না। কারণ ছৌ নাচের মধ্যে রয়েছে ব্যাপকভাবে রঙ ও তাণ্ডব নৃত্যের প্রাধান্য। ফলে গোমিরার নৃত্যের সঙ্গে ছৌনাচের তুলনা টানা হাস্যকর। গোমিরাতে রঙ ও তাণ্ডব নৃত্যের চল নেই। মায়াবী ও রঙবেরঙের এই মুখোশ পরে যে একটি অতিপ্রাচীন লোকনৃত্য এখনও পর্যন্ত টিকে রয়েছে, অধিকাংশই তা জানেন না। বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে যাঁরা সচেতন, তাঁদের কাছে পরিচিত। কিন্তু সাধারণ মানুষ মোটেও এই সংস্কৃতি নিয়ে সচেতন নন। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও এই মুখোশ নাচের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। মায়াবী ও রঙবেরঙের মুখোশ এই নাচের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

চাষের ক্ষেতের একটি উঁচু জায়গায় বসে, একমনে শিবের তাণ্ডব নৃত্য় ও পালা শুনে চলেছি। খচ খচ করে চলছে ক্যামেরার শাটার। মোবাইলে ভিডিয়োও চলছে সমানভাবে। গান-নাচ সাময়িকভাবে থামলে হঠাত মহাদেব কাছে এসে বলল, ‘পুরুলিয়াতে গেছেন কখনও? ছৌনাচ দেখেছেন নাকি সামনে থেকে?’ হুমম। ঘাড়টি নেড়ে সাড়া দিলাম। মহাদেব বেশ আফসোসের সঙ্গে বলেই ফেলল মনের কথাটা। ‘পুরুলিয়ায় ছৌনাচ দেখতে সকলেই যান। কুশমাণ্ডিতে কেউ আসেন না। দার্জিলিংয়েও তো যায় সকলে। এখানে আর আসেন না কেউ। সরকারও দেখে না। গরিবই থেকে গেলাম সারাজীবন। ‘

ছবি সৌজন্যে পিনটারেস্ট

ঠিকই তো। কথাটা তো সত্যিই। গরম হোক বা ঠাণ্ডা, প্রকৃতির ডাককে অগ্রাহ্য না করার সাহস নেই বাঙালির। সমতলের দিকে যত যাওয়া যায় সেখানে লোকসংস্কৃতির আকর্ষণ বেশি। তেমনি পাহাড়ের সংস্কতি নিয়ে আবার মাথাব্যথা নেই বাঙালিদের। দার্জিলিঙে কাতারে কাতারে পর্যটক যান কিন্তু কজন জানেন দার্জিলিংয়ের লোকনৃত্যের নাম? ট্য়াগলাইন থেকে বের হতে পারে না সাধারণ মানুষ। জীবনে কে এত রিস্ক নেবে? তাই বোধহয় হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে গোমিরার মতো লোকসংস্কৃতিগুলি। ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলির উপর থেকে চোখ সরানো দায়। একমনে দেখতে দেখতে গভীর ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম।

মহাদেবই বলল, ‘জানেন,এই মুখা খেলায় প্রধান দেবী হলেন দেবী চণ্ডী। তাঁরই পুজো দেওয়া হল তখন। আমাদের গ্রামের যত রাজবংশী আছে, তারা সকলেই গামার গাছ দিয়ে মুখোশ বানিয়ে নাচ করেন। আমার বাবাও করত একটা সময়। দাদা এখন গোমিরার গান গায়। দুঃখ-কষ্ট, বিরহ, বিয়ে-ডিভোর্স নিয়েও গান বাঁধে আমার দাদা। তালিম নিতে হয়েছে। প্রতি সন্ধ্যে ঢোল-করতাল নিয়ে রিহার্সাল করেছে। আগে আরও ভাল গান লিখত। এখন কানে লাগবে, মনে লাগবে, এমন গানের লেখা লিখতে হয়।’ বুঝলাম,গানের সুরে মিশেছে ফিউশন। অন্য মাদকতা। ব্যঙ্গাত্মক নানা কথার আঁচ পাওয়া যায় আজকের গোমিরার গানে। আগে নাকি এই গোমিরার গানের কথায় যৌনতা মাখানো সুরসুরি ছিল। এখন অচিরেই তলিয়ে গিয়েছে বাংলার নিজস্ব এই লোকনৃত্য। শিবের নানা কাহিনি ও শিবপুজো এই লোকনৃত্যুর বিশেষত্ব। ধানক্ষেতের একচিলতে ফাঁকা জায়গায়, শিব ও অন্য আরও দেবদেবীর মুখোশ পরে উত্তাল এক সমুদ্রের একদল জলরাশি মতো মহানন্দে নেচে বেড়াচ্ছে যুবক থেকে বুড়ো।

মহাদেব পাশে বসে সবটাই দেখছিল। কানের কাছে এসে বলে উঠল, জানেন, এই মুখাগুলো গ্রামের মানুষরাই বানিয়েছে। গামার কাঠ দিয়ে তৈরি হালকা মুখোশগুলি তৈরি করেন বাপ-কাকারাই। মা-কাকিমারা সংসার সামলান। নাচের মহড়া চলে দিনরাত। তারপর দুদিনের পরবে নেত্য করেন তাঁরা। গান করেন। বানানো হয় ম্যাচিং ড্রেস, হার। কীসুন্দর লাগছে দ্যাখো। নাচের চিত্রনাট্য অনুযায়ী কখনও মহিলা, কখনও বনের বাঘ-ভাল্লুকও সাজেন গ্রামের ছেলে-বুড়োরা। যাওয়ার সময় একটা মুখোশ কিনে নিয়ে যাবেন। ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবেন’। মুখে একগাল হাসি। আমিও বললাম, ‘অবশ্যই কিনব। এতদূরে তোমাদের কাছে এলাম। এই স্মৃতিটুকু তো রাখতেই হবে।’

সূর্য পাটে বসেছে। হালকা শিরশিরানি হাওয়া গা ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে দূরের ধানক্ষেতগুলো গাঢ় সবুজ হয়ে আসছে। পুকুর থেকে হাঁসগুলো লাইন দিয়ে নিজের ঘরের দিকে প্যাঁক প্যাঁক করে ডাকতে ডাকতে ফিরে যাচ্ছে। গরু-ছাগলও যাচ্ছে নিজের বাসায়। একঝাঁক টিয়াপাখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডেকে উঠল। শেষ হল গোমিরার নাচ। হঠাতই মনটা বিষাদে ভরে গেল। এবার তো যাওয়ার পালা। ট্রেন ধরে ফের বাড়ি। পরের দিন আবার অফিস দৌড়ানো। একটা সুন্দর কালীমুখো মুখোশ, গ্রামের উনুনে ভাজা মুড়ির প্যাকেট দিল মহাদেব। মুখে হাসি নিয়ে বলল,’পরের পরবের সময় বাড়ির সবাই আসবেন। একটা রাত থেকে যাবেন।’ হাওড়ায় শহরের বাতাস লেগে এই গ্রাম্য ছেলেটা কী সুন্দর করে মিলেমিশে কথা বলছে। দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় সেই ছোট্ট ছেলেটা আমার হাত ধরে এক টান দিল। সকালে যে বট গাছ দেখিয়ে গোমিরার গ্রাম দেখিয়ে দিয়েছিল। কাছে যেতে বলল,’তোমার এই কালো ক্যামেলায় মোল ছবি আছে তো? ভিয়োডো করেছিস? সবাই দেখতে পাবে আমাদেল?’

তথ্যসূত্র: গৌতম বসুমল্লিক (বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক)