In Depth Story on Changing Bangladesh History: দ্বিতীয়বার ‘হত্যা করা হচ্ছে’ মুজিবকে, এবার আরও ভয়ঙ্করভাবে
Bangladesh: বাংলাদেশের নতুন সরকার পাঠ্যবইতে লিখেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নন, এই ঘোষণা করেছিলেন সেনাকর্তা জিয়াউর রহমান! তাহলে কি এতদিন ধরে ভুল জেনে এসেছে বাংলাদেশবাসী? নাকি তাদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলছে?
নতুন বাংলাদেশ। সে দেশে নাকি সংস্কারের প্রয়োজন। আর সংস্কারের ঠেলায় বদলে যাচ্ছে ইতিহাসই। বলা ভাল, বদলে দেওয়া হচ্ছে জোর করে। ২০২৪ সালের অগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে উৎখাত করে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশের জনগণ। তাদের আশা ছিল, দেশ সংস্কার হবে, পরিবর্তন আসবে। সেই সংস্কার কতটা হল, তা জানা নেই, তবে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস বদলে যাচ্ছে পদে পদে। বাংলাদেশের নতুন সরকার পাঠ্যবইতে লিখেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নন, এই ঘোষণা করেছিলেন সেনাকর্তা জিয়াউর রহমান! তাহলে কি এতদিন ধরে ভুল জেনে এসেছে বাংলাদেশবাসী? নাকি তাদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলছে? এই প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে কূটনৈতিক মহলে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস গৌরবের। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যারা নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রক্ত ঝরিয়েছিল। ভারত দুই খণ্ড হওয়ার পর ২৪ বছর ধরে তারা সহ্য করেছিল পাকিস্তানের লাঞ্ছনা, অত্যাচার। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে বাংলাদেশ, যা সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল। ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। তবে ইউনূস সরকার এসে সেই ইতিহাস বদলে ফেলছে।
নতুন করে লেখা হচ্ছে স্বাধীনতার ইতিহাস-
বাংলাদেশের প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি পড়ুয়াদের জন্য পাঠ্যবইতে যে সংশোধন করা হয়েছে, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাম থেকে “জাতির পিতা” উপাধি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে তৃতীয় শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বই থেকে ‘আমাদের জাতির পিতা’ অধ্যায়টিও সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার আমলের পাঠক্রম বদলে ২০১২ সালের পাঠ্যক্রম চালু হয়েছে ওপার বাংলায়। সেখানে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে লেখা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এরপর তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের হয়ে আবারও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।”
পঞ্চম শ্রেণিতে ‘পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা’ শীর্ষক লেখায় বলা হয়েছে, ‘‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর তিনি ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবারও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।’’
চতুর্থ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইতেও স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত পাঠ্যসূচিতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের ছবির পাশাপাশি মেজর জিয়াউর রহমানের ছবিও রাখা হয়েছে।
জানা গিয়েছে, ৪১ জন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে পাঠ্যবইতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। মোট ৪৪১টি পাঠ্যবইয়ে বদল ও সংশোধন করেছে বাংলাদেশের জাতীয় বোর্ড।
চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইতিহাস?
যে ৪১ জন পাঠ্যবই সংশোধন করেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন লেখক-গবেষক রাখাল রাহা। তিনি দাবি করেছেন, বইতে ‘অতিরঞ্জিত’ ইতিহাস ছিল। সেই চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাস থেকেই পাঠ্যবইকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। যারা সংশোধন করেছেন, তারা যুক্তি দিয়েছেন, পাক সেনার হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর শেখ মুজিবর রহমান ওয়ারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। এটা সঠিক নয়। স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন জিয়াউর রহমানই।
কী বলছে আওয়ামি লীগ?
ইউনূস সরকারের এই সংশোধনকে চ্যালেঞ্জ করে আওয়ামি লীগ দাবি করেছে, ইতিহাস বদলে দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানই। তাঁর নির্দেশেই তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান শুধুমাত্র ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন।
কে এই জিয়াউর রহমান?
যাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করছে বাংলাদেশের নতুন সরকার, তিনি ৭১-এ বাংলাদেশ সেনার মেজর জেনারেল ছিলেন। শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সেনা প্রধান হন। পরে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন ভোটের নামে কার্যত প্রহসন করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন।
তার আরেক পরিচয়ও রয়েছে। তিনি খালেদা জিয়ার স্বামী। তাঁর হাত ধরেই তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে জিয়াউরের ভূমিকা ছিল, এ কথা কখনও অস্বীকার করেনি শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার। বাংলাদেশ গঠনের পর তাঁকে প্রথমে সেনাপদক ও পরে বীর উত্তম উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছিল।
তবে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তাদের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। শোনা যায়, যে মুজিবর রহমান জিয়াউরকে নিজে হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন, সেই জিয়াউরই মুজিবরের হত্যার অন্যতম চক্রী ছিলেন। মুজিবের হত্যাকারীদের মদত ও আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ১৯৭৫ সালে ৩১ ডিসেম্বর মুজিবের হত্যাকারীদেরও মুক্তি দিয়েছিলেন এই জিয়াউরই। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০২২ সালে তাঁর পদক ও খেতাব ফিরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।
অনেক আগেই শুরু হয়েছিল ইউনূসের ফন্দি-
বাংলাদেশের ইতিহাস বদল এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা কিন্তু এই কদিন ধরে হচ্ছে, তা নয়। গত বছরের জুলাই-অগস্ট মাসে যখন বাংলাদেশ উত্তাল হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী গণ আন্দোলনে, সেই সময় থেকেই কাজ শুরু হয়েছিল। ৫ অগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরই আন্দোলনকারীরা গণভবনে ঢুকে লুঠপাট চালায়। সেইদিন এক ভয়ঙ্কর চিত্র দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। জায়গায় জায়গায় ভাঙা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি।
ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই ১৫ অগস্ট, শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার দিনটি জাতীয় ছুটির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের নোট থেকেও বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এই ঘটনাগুলি দেখে ইতিহাসবিদদের প্রশ্ন, সংস্কারের নামে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানো হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ?