মুম্বই: ‘ইয়ে হ্যয় মুম্বই মেরি জান…’। মুম্বই শুনলে প্রথমেই মনে আসে বলিউডের কথা। প্রতিদিন প্রতি নিয়ত কত রুপোলি স্বপ্ন বোনে এই মায়ানগরী। এরপর একে একে আসে বড়াপাও, লোকাল ট্রেন, ধারাভি বস্তি, বৃষ্টি। এগুলো সবই মুম্বইয়ের সঙ্গে সমার্থক। পাশাপাশি আরও একটি শব্দ রয়েছে, যা মুম্বইয়ের সঙ্গে সেই কোন কাল থেকে জুড়ে রয়েছে আজও, অবিচ্ছেদ্য হয়ে। ডাব্বাওয়ালা…। অনেকে বলেন, এই মানুষগুলো মুম্বইয়ের অফিসপাড়ার লাইফলাইন, তাঁরা সুপারহিরো। মুম্বইয়ে যাঁরা থাকেন, বিশেষ করে যাঁরা কাজের সূত্রে এখানে বাসা বাঁধেন, তাঁরা বলেন এই ডাব্বাওয়ালারা তাঁদের ‘মানি ম্যানেজমেন্ট’ গুরু। কীভাবে?
মোটামুটি ১৮৯০ সাল থেকে মুম্বইয়ের অফিসগুলিতে এই ডাব্বাওয়ালাদের উত্থান। কয়েক হাজার ডাব্বাওয়ালা রয়েছেন এই শহরে। গুগল অন্তত তেমন তথ্যই দিচ্ছে। তাঁদের নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। অনেক অবাক হতে পারেন, কিন্তু হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলেরও গবেষণার বিষয়ে উঠে এসেছিল এই মানুষগুলোর কাজ।
এক অফিস থেকে আরেক অফিসে লাঞ্চ বক্স নিয়ে জাস্ট ছুটে বেড়ান এই মানুষগুলো। অথচ কখনও ‘ডেডলাইন’ ফেল করেন না। প্রতিদিন একই সময়ে হাজির হয়ে যান। কোনওদিন তাঁদের অর্ডার গুলিয়ে যায় না, ভুল হয় না মেনুতে, একজনের খাবারের ডাব্বা অন্যজনের হাতে তুলে দেওয়ার রেকর্ডও নেই। তাঁদের ম্যানেজমেন্ট স্কিল সত্যিই প্রশংসনীয়।
রোজ হাজার হাজার লাঞ্চ বক্স সামলানো কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু পরিচালনার দক্ষতায় অনায়াসে এই কাজটি তাঁরা করে ফেলেন। ‘অ্যাসেম্বল-সেগ্রিগেট-ডেলিভার’-এর মতো সহজ নিয়ম অনুসরণ করেই এই কাজটি তাঁরা করে থাকেন। এই ম্যানেজমেন্টের ফর্মুলাতেই জ্যামজমাট মুম্বইয়ে বাইসাইকেলে হোক বা ট্রেনে, নির্দিষ্ট সময়ে রোজ অফিসে অফিসে পৌঁছে দেন খাবার। ইনভেস্টমেন্ট পোর্টফোলিও পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনাকেও পরিচালন ক্ষমতার দক্ষতা আনতে হবে। বিনিয়োগ করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই বলে মনে করেন অনেকে। তবে এটা ভুল। প্রতিটি অ্যাসেটের উপর নজর কিন্তু রাখতেই হবে।
মুম্বইয়ের ট্রাফিকের কথা কম বেশি সকলেই জানেন। রাস্তায় বেরোনো মানে অতিরিক্ত সময় ধরে নিয়েই বেরোতে হয়। অথচ কী সুন্দরভাবে এই ডাব্বাওয়ালারা নিয়মিত ট্রাফিক জট কাটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে খাবার পৌঁছে দেন। স্নায়ুতে নিয়ন্ত্রণ কীভাবে রাখতে হয়, মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের থেকে সত্যিই শেখার।
একজন বিনিয়োগকারীরও ধৈর্য এই ডাব্বাওয়ালাদের মতোই হওয়া দরকার। সকলেরই জানা স্টক মার্কেট, মিউচুয়াল ফান্ড বা এরকম বিনিয়োগ থেকে যতটা চাইবেন, ততটাই পাবেন এমনটা নয়। পরিকল্পনা, কৌশল এবং ধৈর্যের ত্রিফলা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। মানি ম্যানেজমেন্ট, বিনিয়োগে পা বাড়ানোর আগে এই শান্ত হয়ে ধৈর্য রাখাটার গুনটা রপ্ত করা দরকার।
উপকূলের শহর মুম্বই। আর্দ্র আবহাওয়ার অস্বস্তি, সঙ্গে আবার ভারী বৃষ্টির চোখরাঙানিও থাকে বছরভর। তবে হাওয়া যাই হোক, তা ঠিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চলে আসেন এ শহরের ডাব্বাওয়ালারা। ঝড়বৃষ্টি থেকে গরম, যা-ই হোক না কেন, ডাব্বা ঠিক সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছে যাবেই। এটা আসলে বুঝিয়ে দেয় ওই ডাব্বাওয়ালারা কতটা ঝুঁকি নিতে দক্ষ।
একজন বিনিয়োগকারীকেও এরকমই ঝুঁকিপ্রবণ হতে হবে। ভাল রিটার্নের আশা করলে ঝুঁকি নিতে ভয় পেলে চলবে না। সিম্পল ফান্ডা হল, বুঝেশুনে নিন কতটা ঝুঁকি নিলে আপনিও ভেসে যাবেন না, তারপরই বিনিয়োগের পরিকল্পনা করুন। মনে রাখতে হবে, কিছু লোকসান হতেই পারে। সেইমতই ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজি ফ্লেক্সিবেল রাখতে হবে। পরিস্থিতির সঙ্গে যাতে তা বদলে ফেলা যায়।
কিছু এমন কাস্টমার থাকে, যারা নানাভাবে এই ডাব্বাওয়ালাদের গতিকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করে। মানে অফিসে খাবার পৌঁছল, অথচ সেই খাবার নেওয়ার লোক নেই, দাঁড়িয়ে আছেন ডাব্বাওয়ালা। এতে যে ওই ব্যক্তির সময় অপচয় হচ্ছে, সেই বোধটুকু কাজ করে না। অনেক সময় ডাব্বাওয়ালারা এই ধরনের কাস্টমারদের বাদ দিয়ে দেন। খাবার দিতে চান না। অর্থাৎ কোনও বিনিয়োগে যদি যথার্থ ফলই না পাওয়া যায়, তাহলে তা থেকে সরে যাওয়াই ভাল।
সময়ের হিসাবই এতটা সফল করে তুলেছে মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের। একজন বিনিয়োগকারীদেরও হিসাবি হতে হবে। আয়, ঝুঁকি, অর্থনৈতিক নানা বিষয় নজরে রেখে তারপরই বিনিয়োগ করতে হবে।
মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালাদের সুপারহিরো বলার একটাই কারণ, যে কোনও পরিস্থিতি নিজেদের কব্জায় নিয়ে রোজকার কাজ করে যান তাঁরা। পথে যাই আসুক না কেন, তাঁরা জানেন, তাঁদের কর্তব্য সঠিক সময়ে সঠিক ডাব্বাটা সঠিক টেবিলে পৌঁছে দেওয়া। একজন বিনিয়োগকারীর অনুপ্রেরণা হোক এই ডাব্বাওয়ালারা। ধৈর্য ধরে, হিসাব কষে সমস্ত ঝুঁকির দিকগুলি জেনে বিনিয়োগই বুদ্ধিমানের কাজ।