সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কতটা মিস করেছি জানো?’: ঐন্দ্রিলা শর্মা 

দ্বিতীয় কেমোথেরাপি শুরু হবে আর কয়েক দিন পরেই। প্রথম কেমোর পরেই নিয়মিত শুট করছেন ঐন্দ্রিলা শর্মা। শুটের মাঝেই তাঁর ক্যানসার-যন্ত্রণা ও ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিয়ে TV9 Bangla-র জন্য কলম ধরলেন অভিনেত্রী স্বয়ং।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘কতটা মিস করেছি জানো?’: ঐন্দ্রিলা শর্মা 
Follow Us:
| Updated on: Mar 11, 2021 | 6:36 PM

ঐন্দ্রিলা শর্মা:

সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এত দিনে সবাই জেনে গিয়েছেন প্রথম কেমো নিয়ে আবার শুটে ফিরেছি আমি। সবাই এত ভালবাসা জানিয়েছেন, এত মেসেজ এসেছে, ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন এত মানুষ… অসুখটা না হলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না আপনারা এত ভালবাসেন আমাকে। বুঝতেই পারতাম না, একবারের জন্য হলেও এত মানুষ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন যে ঐন্দ্রিলা যাতে ঠিক হয়ে যায়… অনেকেই ইনবক্সে প্রশ্ন করেছেন, “এত মনের জোর কী করে পেলে ঐন্দ্রিলা?” আবার অনেকে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও জানতে চেয়েছেন। বুঝতে পারছি, চিন্তা হচ্ছে আপনাদের। আর সেই জন্যই এই কলম ধরা…

দিনটা ১৪ ফেব্রুয়ারি। ক্যালেন্ডার জানান দিয়েছিল সে দিন নাকি প্রেম দিবস। ও দিকে, মাসের দ্বিতীয় রবিবার বলে শুটও ছিল না সে দিন। প্ল্যান ছিল বিকেলবেলা সব্যসাচীর (ঐন্দ্রিলার বিশেষ বন্ধু ও অভিনেতা ) সঙ্গে ঘুরতে যাব। দুপুরবেলা একটু শুয়েছি। উঠে দেখছি ডান কাঁধে হঠাৎ করে খুব ব্যথা হচ্ছে। ক্রমশ ব্যথাটা এত বাড়তে শুরু করল দেখলাম যে উঠতেই পারছি না। আমার দিদিভাই পেইনকিলার-টিলার দিল। সাময়িক ভাবে ব্য়থা একটু কম হলেও আবার যে কে সেই।

পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্যথা নিয়েই শুটে গেলাম। কিন্তু এত ব্যথা হচ্ছিল যে শুটিং শেষ না করেই ফিরে আসতে হল। ব্যথা নিয়েই কেটে গেল ওই দিনটাও। পরের দিনটা ছিল সরস্বতী পুজো। সবাই শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বেরিয়েছে, আর আমি তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আর দেরি না করে ওই দিনই হাওড়ার এক নার্সিংহোমে চেস্ট এক্স-রে করালাম। বাবা-মা বহরমপুরে। ওদের ফোন করে জানালাম গোটা বিষয়টা। নার্সিং হোমে তখন দিদি, ভাই, আর সব্যসাচী ছিল। আর বাবা-মা সবটা শোনার পর ওই দিনই রওনা হয়ে যায় কলকাতার উদ্দেশে।

হার না মানার অন্য নাম… 

পরের দিন টেস্টের রিপোর্ট এল। ডাক্তাররা জানালেন বুকে জল জমেছে। জলটা বের করতে হবে। জল বার করা হল। এ দিকে, বাবা-মা’ও কলকাতা চলে এসেছেন। বাবা বললেন, বাকি চিকিৎসাটা বাইরে মানে দিল্লিতে গিয়েই হবে। আমি, বাবা-মা, আর পিসতুতো দাদা মিলে দিল্লি চলে গেলাম। আগের বার ক্যানসারের সময় যে ডাক্তার আমার চিকিৎসা করেছিলেন সেই দোদুল মণ্ডলের সঙ্গেই আবার যোগাযোগ করা হল। সেখানেও টেস্ট। বুকের বাকি জলটা বের করা হল। ডাক্তার বললেন, বুকে একটা ‘মাস’ পাওয়া গিয়েছে। সেই দিনই বায়োপসি করা হল। ওরা জানাল রিপোর্ট আসতে দু’-তিন দিন সময় লাগবে। ওই অপেক্ষাটা যে কী ভয়ঙ্কর, তা আর নতুন করে কী লিখব। ওই সময় একবার লাইভে এসেছিলাম, আপনাদের হয়তো মনে থাকবে। ততদিনে অনেকেই জেনে গিয়েছেন আমি অসুস্থ। অনেকে ফোন করে খোঁজ-খবরও নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই লাইভেও নিজেকে সামলাতে পারিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম। তবে আশার আলো ছিল। বায়োপসি ছাড়া বাকি রিপোর্টে কোথাও কিন্তু ম্যালিগন্য়ান্সির আভাস পর্যন্ত ছিল না। আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম হয়তো টিউমারটা বিনাইন হবে। অপারেশন করিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসব। যা হয় মানুষের মন…

রিপোর্ট এল। আর আসার পরেই একটা বিশাল ধাক্কা। আমার কাছে আমার পরিবারের কাছেও। রিপোর্ট বলল, ডান দিকের ফুসফুসের রাইট লোবে জাঁকিয়ে বসা টিউমারটি বিনাইন নয়, ক্যানসারাস। ছোটবেলা থেকেই খুব ডানপিটে আমি। অল্পেতে ভেঙে পড়ি না। অনেকে আছে দেখবেন, জীবন নিয়ে তাঁদের হাজার অভিযোগ। আমার কিন্তু নেই। আসলে কষ্টটা একবার দেখেছি তো… তাই ওই যে মেনে নেওয়াটা, আমার আবার ক্যানসার হয়েছে, আমাকে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে– সেটা বড় ভয়ঙ্কর। সেটা মেনে নিতেই সময় লেগে গেল অনেকটা। বলেছিলাম, চিকিৎসা করাব না।

সব্যসাচীর সঙ্গে 

প্রথম বার যখন ক্যানসার হয়েছিল (২০১৫ সালে ক্যানসার ধরা পড়েছিল ঐন্দ্রিলার। কেমো-রেডিয়েশনের পর সুস্থ হয়ে আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিলেন তিনি) এখনও মনে আছে মা কাঁদছিল। আমি উল্টে সাহসের সঙ্গে মা’কে বলছিলাম, “মা, কোনও ব্যাপার না। সব ঠিক হয়ে যাবে।” এ বার নিজেকে প্রথমে বোঝাতে পারিনি। কী করব? আমার কাছে তো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ব্যাপার। ওই সময়টাতেই সব্যসাচী দিল্লি এল। আমি ভাবতে পারিনি মেগার লিড চরিত্রে কাজ করেও চার-পাঁচ দিনের জন্য ছুটি নিয়ে আমার কাছে চলে আসবে ও। এ ভাবে পাশে থাকবে। ও এসে বোঝাল অনেক। মা-বাবা-দিদি-দাদা… গোটা পরিবার সঙ্গে ছিল। শুরু হল চিকিৎসা। ২৬ তারিখ প্রথম কেমো নিলাম আমি। আমার প্রতিটা কেমো চার দিন করে চলছে। একটা জিনিস বুঝলাম, আমার কাছে তো আর কোনও অপশন নেই। আমাকে ট্রিটমেন্ট করাতেই হবে। এক হয় আমি পজ়েটিভ্লি ট্রিট্মেন্ট করাতে পারি আর অন্যটা ঘ্যানঘ্যান করে ট্রিটমেন্ট করাতে পারি। আমি প্রথমটা বেছে নিয়েছি। অসুখ হয়েছে। চিকিৎসা করাতে হবে। বাঁচতে হবে।

শুট শুরু করা নিয়ে অনেকে অনেক প্রশ্ন করেছেন। অনেকে চিন্তাও করছেন। আমার কেমো শিডিউল যিনি বানিয়েছেন, সেই ডক্টর মহাজনের ব্যাপারে একটা ছোট্ট কথা শেয়ার করি। তখন আমি উঠতেই পারছি না। বাথরুমেও মা নিয়ে যাচ্ছে। এমনি আমার কেমোতে অনেক সাইড এফেক্টস হয়। আমায় বললেন, “আপ তো শুট কর সকতে হো।” আমি তো অবাক। কী বলছে রে বাবা! কী করে বলছে এ সব! ওর কথাই সত্যি হল। সেই আমিই একটু ঠিক হয়েই শুটিং ফ্লোরে।

শটের ফাঁকে 

‘জিয়নকাঠি’র ফ্লোরে যেদিন প্রথম ঢুকলাম, টেকনিশিয়ান থেকে কলাকুশলী সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, কেঁদে ফেলেছিলাম। সবাই জড়িয়ে ধরে বলছে, ‘তোমাকে আমরা কত মিস করেছি জান?’ এই ছোট ছোট মুহূর্ত, ভালবাসাগুলো যে কী ম্যাটার করে বুঝেছি প্রতিটা মুহূর্তে। এই যে শুটিং করছি, সবাই এত হেল্প করছ… ছোট-ছোট সিন রাখছে যাতে আমার অসুবিধে না হয়, তাড়াতাড়ি প্যাক আপ করে দিচ্ছে। আমি কৃতজ্ঞ আমার ‘জিয়নকাঠি’ টিমের কাছে।

সেকেন্ড কেমোর দিন আসছে। এর পর চুল উঠবে। তখন আর ধারাবাহিকের কাজ চালিয়ে যেতে পারব না। সে কথা ওঁদের জানিয়ে দিয়েছি। তবে ওটা সাময়িক। কষ্ট হবে, কষ্ট সহ্য করতে হবে… এর পরেই খুশির দিন আসবে। লড়াইটা এখন আর শুধু আমার নেই… আপনাদেরও… তা আপনাদের এত এত ভালবাসাতেই বেশ বুঝতে পেরেছি…।