অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা দর্শককে ভীষণ বিভ্রান্ত করে দেয়: সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

স্বরলিপি ভট্টাচার্য | Edited By: অমর্ত্য মুখোপাধ্য়ায়

Jan 29, 2021 | 7:09 PM

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে একটি শর্ট ফিল্মের কাজ শুরু করতে চলেছেন তিনি। তিনি বাচিক-শিল্পী, অভিনেতা তথা লিঙ্গ-অধিকার কর্মী (জেন্ডার-রাইটস অ্য়াক্টিভিস্ট) সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছাড়াও এই ছবিতে থাকছেন সৌরসেনী মৈত্র, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, তুহিনা দাস, অপরাজিতা আঢ্য।

অভিনেতা-অভিনেত্রীদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার ব্যাপারটা দর্শককে ভীষণ বিভ্রান্ত করে দেয়: সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
খোলামেলা আড্ডা দিলেন সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

Follow Us

টেলিভিশনের ধারাবাহিকে সম্প্রতি তাঁর চরিত্র নজর কেড়েছিল। তবে আচমকা সিরিয়ালে আর দেখা যায়নি তাঁকে। বিতর্ক সুজয়প্রসাদের (Sujoy Prasad Chatterjee) সর্বক্ষণের সঙ্গী। তিনি ট্রোলের শিকারও। অরুন্ধতী সুব্রহ্মনিয়মের কবিতা অবলম্বনে তৈরি করতে চলেছেন একটি শর্ট ফিল্ম ‘হোম’। মনে করেন, শিল্পীর রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, তবে রঙ থাকাটা উচিত নয়। টেলিভিশন থেকে সিনেমা, নতুন কাজ থেকে রাজনীতি… এ সবকিছু নিয়েই TV9 বাংলার সঙ্গে খোলামেলা আড্ডা দিলেন সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

টেলিভিশন ছাড়লেন কেন?

সুজয়- ছাড়লাম কোথায়? ছাড়িয়ে দেওয়া হল। আমি তো অনেকের কাছেই ফোন করে কাজ চাই। কিন্তু কেউ দেয় না। ইনফ্যাক্ট শুটিং ফ্লোরও আমার কাছে কখনও পরিবার হয়ে ওঠেনি। বিভিন্ন গেম শো-তে বাকি কলাকুশলীরা গিয়েছেন প্রোমোশনের জন্য। আমাকে পাঠানো হয়নি। আমারও কিন্তু খারাপ লেগেছে। কিন্তু আমি কাটিয়ে উঠেছি।

অভিনেতা হিসেবে ছোট পর্দা হোক বা সিনেমা, উল্লেখযোগ্য চরিত্র করেছেন, কিন্তু সেভাবে দেখা যায় না আপনাকে। কাজ না-পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে?

সুজয়- অভিমান রয়েছে। আসলে বিষয়টা তো এমন নয় যে আমি পারি না। কাজটা আমি পারি, অথচ আমাকে দেওয়া হবে না। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘শাহজাহান রিজেন্সি’, দেবালয় ভট্টাচার্যের ‘বিদায় ব্যোমকেশ’-এ যে চরিত্র, আর সম্প্রতি ওটিটি-তে দময়ন্তী (সিজন-২)-তে যে চরিত্রে অভিনয় করেছি, এগুলো অভিনেতা হিসেবে আমায় আরও পরিণত করেছে। ডলি বসুর হাত ধরে থিয়েটারে এসেছিলাম। তারপর সোহাগ সেনের কাছ থেকে এখনও প্রতিদিন অভিনয়ের পরিমিতিবোধ শিখছি। সিরিয়ালের চরিত্রতেও যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছিলাম। কিন্তু এত কিছুর পরেও আমি কাজ পাই না।

কেন কাজ পান না? আপনার কী মনে হয়?

সুজয়- টলিউড ইন্ডাস্ট্রি আমায় হ্যান্ডেল করতে শেখেনি। প্রথাগত অভিনয় নয়, একজন শিল্পী হিসেবে আমায় অনেকেই বোঝেন না। বেশিরভাগের ধারণা আমি মেয়েলি। আমার রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো নেই। আমার স্পষ্টবাদী চরিত্র। এইসবই আমায় কাজ পেতে দেয় না। তবে আমার মেরুদণ্ড একটু বেশিই শক্ত। পুরুষালি চরিত্র আমি অনেক অভিনেতার চেয়ে ভাল অভিনয় করতে পারি। অনেক অভিনেতার চেয়ে অভিনয়ে আমি অনেক বেশি শার্প, অর্গ্যানিক্যালি সেই চরিত্রে অভিনয় করতে পারি। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়েছি। ভাল কথা বলতে পারি। তা-ও কেউ শো হোস্ট করতেও ডাকে না। অথচ আমি একসময় এই শহরের বুকেই লাইভ চ্যাট শো করেছি। অনেক সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিতে যাবেন, তাঁদের প্রশ্নপত্র তৈরি করে দিয়েছি। অথচ টেলিভিশন বা ওটিটিতে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করার জন্য ডাক পাইনি। উল্টে আমায় বলা হয়েছে, ‘ইউ আর নট টু মেনস্ট্রিম’। তাহলে কি আমি ধরে নেব আমি পারি না? আসলে আমি কাজটা পারি।

টেলিভিশনে ফিরবেন কবে?

সুজয়- যবে কেউ ডাকবে। ভাল চরিত্র দেবে। আমি তো অপেক্ষা করে আছি। তবে তৃনয়ণী-তে তো একটা ছাপ রেখেছিলাম আমার চরিত্রে অভিনয় করে। তাই সেই রকম ছাপ ফেলার মতো একটা চরিত্র আসতে হবে। আমি সাংঘাতিক স্বার্থপর এবং লোভী একজন শিল্পী। বাজপাখির চোখের মতো একটা চরিত্রকে দেখি এবং ভাবি এটা আমায় কোথায় নিয়ে যাবে। এটা আমি দেখতে পাই। এই দেখাটা না-পেলে কাজ করব না। আসলে আমার শিল্পসত্তা ভীষণ স্বতন্ত্র। আমি কারও তৈরি করা ‘প্রোডাক্ট’ নই। তাই আমায় রিপ্লেস করা সহজ নয়।

কোভিড পরবর্তীতে আপনি নতুন কিছু কাজ করছেন?

সুজয়- খুব তাড়াতাড়ি লকডাউন নিয়ে তৈরি একটা ডকুমেন্টারি দেখাতে চলেছি। ছবির নাম ‘স্পটলাইট’। উত্তর কলকাতার থিয়েটারের মানচিত্র এই ডকুমেন্টারির মূল নির্যাস। ধীরে-ধীরে এবার মঞ্চে ফিরতে চাই। তাই একঝাঁক তারকাকে নিয়ে ৩০ জানুয়ারি আইসিসিআর-এ ‘ক্রসিং ওভার’ বলে একটা শো করছি। সব শিল্পীকেই মঞ্চ ফিরিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা। ২০ ফেব্রুয়ারি জয়তী চক্রবর্তী আর কবি তন্ময় চক্রবর্তী একটি অনুষ্ঠান করব। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করার একটা চেষ্টা করব আমরা, গান আর আলেখ্যর মাধ্যমে। আমার পরিচালনায় একটা শর্ট ফিল্মের কাজ শুরু করব। অরুন্ধতী সুব্রহ্মনিয়মের কবিতার আধারে তৈরি এই শর্টের নাম ‘হোম’। এই ছবিতে থাকছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সৌরসেনী মৈত্র, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, বিদিপ্তা চক্রবর্তী, তুহিনা দাস, অপরাজিতা আঢ্য। আমার কোভিডের জন্য কাজ পিছিয়ে গিয়েছে। এবার শুটিং শুরু করব। সোহাগ সেন পরিচালিত ‘সরো অফ লাভ’-এর প্রযোজনাও করেছি এবার। প্রযোজক হিসেবে এটাই প্রথম কাজ। ভাবিনি এটা হবে। নিজে টাকা জমিয়েছি। আর সাহায্য করেছে আমার দুই বন্ধুর সংস্থা। ইচ্ছে আছে এবার ইংরেজি ভাষায় একটা সোলো নাটক মঞ্চস্থ করব।

সেলিব্রিটি মানেই হাজার বিতর্ক, ট্রোলিং… আপনিও ট্রোলড হন। এই প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?

সুজয়- এই ট্রোল এবং ট্রোলারদের নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। আমার উপর অবশ্য এইসব জিনিস কোনও প্রভাব ফেলে না। ওরা এসব করেই মজা পায়। এভাবেই বাঁচবে। তবে একটা বোধহয় ধারণা আছে যে সেলিব্রিটিরা রিয়েল নন। মানে সেলিব্রিটিদের বিবর্তন হয়নি। ডারউইনের মতবাদ সেলেবদের ক্ষেত্রে খাটে না। তাই তারকারা কীভাবে বাঁচবেন, সেটা অন্যরা বলে দেন। আমাদের নিয়ে লোকেদের বড় সমস্যা। আসলে কিছু মানুষ চিরকালই অন্যের জীবন পর্যবেক্ষণ করে বেঁচে থাকেন। ট্রোলিং একটা সামাজিক ভাইরাস, যার ভ্যাকসিন নেই, বেরোবেও না। এই ট্রোল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল নিয়েই বাঁচতে হবে।

 

বিশেষ কোনও পরিচালক আছেন যাঁর সঙ্গে কাজ করতে চান?

সুজয়- শ্যাম বেনেগাল এবং মুজফফর আলির সঙ্গে কাজ করতে চাই ভীষণভাবে। এছাড়া অসিত সেন এবং তপন সিনহার সঙ্গে কাজ করতে পারলে খুব ভাল হতো।

ইংরেজি ভাষায় আপনার দখল প্রশংসনীয়। ইংরেজি ছবিতে কাজ করার কথা ভেবে দেখেছেন কখনও?

সুজয়- ভীষণভাবে। জানি না কীভাবে করতে হয়। তবে কিছু ‘বেবিস্টেপস’ নিয়েছি। নেটফ্লিক্সের জন্য় কয়েকটা অডিশন দিয়েছি আরকি…। এখানে তো কোনও অডিশন হয় না। সবই রেকমেন্ডেশন। সবাই সবাইকে চেনে।

সুজয়প্রসাদ কি ঋতুপর্ণ ঘোষকে নকল করেন নাকি অনুসরণ করেন?

সুজয়- আমি আমার মা-কে অনুসরণ করি, আর কাউকে নয়। মায়ের শিল্পবোধ, মানবধর্ম বোধ, রাজনৈতিক চেতনা, অভিনয়ের বোধ এই সবগুলো আমার কাছে প্রায় ক্লাসরুমের মতো। আমি প্রকারান্তরে মায়ের থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমি পরিচালক ঋতুপর্ণর ফ্যান নই। লেখক ঋতুপর্ণর ফ্যান। ঋতুদার মতো যদি একটা শব্দও লিখতে পারি, ওঁর নান্দনিকতা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করব। ওঁর নান্দনিকতা অনুকরণ করা সম্ভব নয়।

ডার্ক শেড নাকি রোম্যান্টিক চরিত্র?

সুজয়- প্রচুর ডার্ক শেডের চরিত্র করে ফেলেছি। এবার রোম্যান্টিক পেলে ভাল হয়। তবে সম্প্রতি দময়ন্তী ওয়েব সিরিজের দ্বিতীয় সিজনে যে চরিত্রে অভিনয় করলাম, এমন চরিত্র এর আগে আমার কাছে আসেনি। পরিচালকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে ওঁরা আমায় সুযোগ দিয়েছেন।

তাহলে কি নতুন প্রজন্ম ইন্ডাস্ট্রিকে দিশা দেখাচ্ছে? আউট অফ দ্য বক্স ভাবতে শেখাচ্ছে?

সুজয়- অবশ্যই। এখানে আসলে সবাই চায় একজন শিল্পীকে বেঁধে ফেলতে। একেপেশে হয়ে বলে ফেলা হয়, ‘ওর দ্বারা কিছু হবে না’। অথচ সে কী করতে পারে, সেটাই জানা হল না। বিরসা দাশগুপ্তর ‘ক্রিসক্রস’ ছবিতে নুসরত জাহানকে একজন ‘শাইনিং স্টার’ লেগেছিল আমার। আর একজনের কথা বলব। অঙ্কুশ হাজরা। ওকে নিয়ে কেউ কেন ভাবে না, আমি জানি না। এই ফিল্ম ফেসটিভ্যালেও রাজকে (চক্রবর্তী) বলেছিলাম, আমি কোনওদিন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বানালে ভূতনাথের চরিত্রে অঙ্কুশকেই নেব। ওকে ছাড়া আর কাউকে আমি দেখতেই পাই না ওই চরিত্রে।

শিল্পীরা রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন, এ ব্যাপারে ভেবেছেন কখনও?

সুজয়- এই যে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, এটা অবশ্যই তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটা দর্শকদের ভীষণ বিভ্রান্ত করে দেয়। আসলে আমার মতে শিল্পীর নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, তবে রঙ থাকাটা উচিত নয়।

সুজয়প্রসাদের নামের সঙ্গে বিতর্ক জড়িয়ে থাকে। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে ‘নুসরত-যশ’ এই দুই তারকাকে নিয়ে বিতর্ক চলছে। এই প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?

সুজয়- নুসরত জাহান, নিখিল জৈন, যশ দাশগুপ্ত এঁদের জীবন কাঁটাছেড়া করে মানুষ (অবশ্যই সবাই নয়) রস পায়। তাই ট্রোল করে। আমার কাছে এগুলো ভিত্তিহীন। কারণ ওঁরা সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক। নুসরত এবং যশের মধ্যে যদি কোনও সম্পর্ক হয়েও থাকে সেটা তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কে কীভাবে বাঁচবে সেটা অন্য কেউ কেন বলে দেবে?

সুজয়প্রসাদ কি অহঙ্কারী (কারণ ইন্ডাস্ট্রির কারও-কারও মত অন্তত তাই-ই)?

সুজয়- হ্যাঁ কোথাও-কোথাও আমি অহঙ্কারী। তবে এই অহঙ্কার আসে আত্মবিশ্বাস থেকে। আমি আমার মেজাজে চলি। লোকে আমার কনফিডেন্সটা মিস করে যায়। সবটাই অহঙ্কার হিসেবে ভেবে নেয়।

অলংকরণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

Next Article