গত বছর। ২০২০ সাল। বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছি আমি-আপনি, আমরা প্রত্যেকে। কারণ, বাড়ির বাইরে করোনার দাপট। বেরলেই খপাত করে ধরবে। তাই গোটা দেশ, গোটা বিশ্ব বাড়িবন্দী। রাস্তাঘাট শুনশান। লোকের হাতে কাজ নেই। কারও ওয়ার্ক ফ্রম হোম, তো কারও চাকরিতে শাটার ক্লোজ। ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলো হা-হুতাশে কাটিয়েছে দিন। জমানো পুঁজি শেষ হয়েছে তাঁদের।
এই ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষগুলোর একটা বড় অংশ বিনোদন জগতের কর্মীরা। কেউ লাইটম্যান, কেউ ড্রেসার, কেউ চুল বাঁধেন, কেউ মেক-আপ করেন, কেউ সেটে ট্রলি সামলান, কারও কাজ আর্ট ডিরেকশন বিভাগে, কেউ সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে বসেন তো কেউ টর্চ জ্বেলে হলের সিট চিনিয়ে দেন। বলা ভাল, যাঁদের কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে গোটা কর্মকাণ্ডটাই। তারকা তৈরির কারিগর বলা হয় যাঁদের। তাঁদের বেহাল দশা। লকডাউনে কোনও মতে পেট চালিয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষগুলি। তাই সিনেমা হল খোলার পর, শুটিং চালু হওয়ার পর ফের কাজের স্পৃহা ফিরে পেয়েছেন তাঁরা। ২০২০’র বিভীষিকা থেকে এখন মুক্ত হয়েছেন কোনওমতে।
কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ফের উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে তাঁদের সমীকরণ। মুম্বইয়ে কাজ বন্ধ। পশ্চিমবঙ্গেও আক্রান্ত হচ্ছে তারকারা। সম্প্রতি আক্রান্ত হয়েছেন অভিনেতা জিত্ ও শুভশ্রী। টেলি তারকাও আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। তা হলে সরকার কি ফের আর-একটি লকডাউনের পথে হাঁটছে? ফের কর্মহীন দশা হবে? কীভাবে চলবে পেট? জমানো পুঁজিও তো নেই। শুটিং বন্ধ মানে কাজও বন্ধ! এই প্রশ্নগুলোই কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছে তাঁদের।
আরও পড়ুন- দলীয় সদস্য নন, তবু নিজের কেন্দ্রের এই প্রার্থীর জন্য খুল্লামখুল্লা ভোট চাইলেন ‘রামকৃষ্ণ’ সৌরভ
জুনিয়র টেকনিশিয়ানদের একাংশের বক্তব্য, সম্পূর্ণ লকডাউন নয়, পরিস্থিতি সামালে নাইট কার্ফুই ভরসা। এতে কাজ খোয়ানোর ভয় নেই, রোজগারপাতির রাস্তাও খোলা। মেক-আপ আর্টিস্ট মণিদীপ মিত্র (সেটে পাপাই বলে পরিচিত) TV9 বাংলাকে প্রকাশ করেছেন তাঁদের দুশ্চিন্তার কথা। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “পরিস্থিতি আবার খারাপ হবে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। আমরা ফের আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। তবে আমরা চাই না পুরোপুরি লকডাউন হোক। নাইট কার্ফু হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেই আবেদনই আমরা জানাতে চাই। অন্তত কাজটা তো বন্ধ হবে না। ভোর ৬টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত কাজ চলবে। তা না হলে, না খেয়ে মরতে হবে আমাদের।” দীর্ঘদিন ফ্লোরে ইলেকট্রিকের কাজ করেন কুমার দাস (সেটে খোকন বলে পরিচিত)। তিনি TV9 বাংলাকে বলেন, “ফের অনিশ্চয় একটি ভবিষ্যতের দিকে আমরা হাঁটছি। সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে। লকডাউন না হলে সংক্রমণকেও ঠেকানো যাবে না। সেক্ষেত্রে নাইট কার্ফুর পরামর্শ দিতে চাই।”
অন্যদিকে জনপ্রিয় হেয়ার ড্রেসার হেমা মুন্সী TV9 বাংলাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। কলকাতার পাশাপাশি হিন্দি ছবিরও কাজ করেন হেমা। সম্প্রতি করোনার কারণে মুম্বইয়ের একটি বিজ্ঞাপনের কাজ হারিয়েছেন তিনি। হিন্দি ছবির কাজও ছিল। সেটাও আর হবে না কিন্তু সন্দেহ তাঁর। এসবে ফের শঙ্কিত হেমা TV9 বাংলাকে বলেন, “আমি মুম্বইয়ের একটা বিজ্ঞাপনের কাজ হারিয়েছি। ১০ তারিখ থেকে একটা হিন্দি ছবির কাজ হওয়ার কথা আছে। সেটাও মনে হয় হবে না। আগের বছর বাড়িতে বসে শুটিং করেছেন তারকারা। আমাদের সেখানে কাজ ছিল না। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাও কাজ করতে পেরেছেন। আমরা তো তাও পারিনি। অনেক ডোনেশন এসেছিল আগের বছর। কিন্তু এবার তো সেটাও মনে হয় আসবে না। কীভাবে আসবে বলুন! ক’টা শুটিং হয়েছে? ক’টা ছবি ব্যবসা করেছে? তাই এবার লকডাউন হলে আরও খারাপ পরিস্থিতি হবে বলেই আমার মনে হয়।”
এই পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই কয়েকটি বড় চ্যানেল এপিসোড ব্যাঙ্কিং করার জন্য অফিশিয়াল মেল পাঠিয়েছে প্রযোজনা সংস্থাগুলিকে। কয়েকটি চ্যানেল মেল না পাঠালেও আন-অফিশিয়ালভাবে জানিয়েছে ব্যাঙ্কিং করে রাখতে। এর ইঙ্গিত স্পষ্ট। আর কয়েকদিনের মধ্যেই লকডাউনের আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলি। যে কারণে, শো ব্যাঙ্কিং করার কথা বলছে তারা। তাই শুটিং ফ্লোরে কাজের চাপও বেড়েছে। তেমনই আভাস TV9 বাংলাকে দিয়েছেন ‘কড়িখেলা’ ধারাবাহিকের পরিচালক অমিত দাস। বলেছেন, “মুম্বইয়ের অবস্থা খুব যে ভাল না, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এদিকে এই মুহূর্তে বাংলায় শুটিং বন্ধ কার কোনও আভাস দেওয়া হয়নি। কেবল কয়েকটি চ্যানেল মেল দিয়েছে, যাতে আমরা শো ব্যাঙ্কিং করে রাখি। কেউ বলেছে ১০টি ব্যাঙ্কিং, কেউ ১৫টি। এই সংখ্যাটা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা আছে। লকডাউন হবেই, এই আশঙ্কাতেই ব্য়াঙ্কিং করে রাখার কথা বলা হয়েছে। ১৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। তাড়াহুড়ো করে কাজ হচ্ছে।”
ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কাস অফ ইসটার্ন ইন্ডিয়ার (FCTWEI) সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে TV9 বাংলাকে তিনি বলেন, “কলকাতায় এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকেই আমরা তাকিয়ে আছি। সরকার কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়, এখন সেটাই দেখতে হবে। নাইট কার্ফু না পুর্ণাঙ্গ লকডাউন—সেটা দেখেই আমরা ঠিক করব কীভাবে কাজ হবে। এক্ষেত্রে একা কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আমরা শুটিং চালু রাখারই চেষ্টা করব। দেখব জুনিয়র টেকনিশিয়নদের যেন কোনওভাবেই কোনও ক্ষতি না হয়।”